রূপান্তরের গল্প ৩০৩ | Rupantorer Golpo 303

বাঘের ডাক, গুলির শব্দ | রূপান্তরের গল্প ৩০৩

বাঘের ডাক, গুলির শব্দ | রূপান্তরের গল্প ৩০৩ | Rupantorer Golpo 303 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ৩০৩ : দূর থেকে ট্রলার চলার শব্দ আসছে। মামুন বললো, পশ্চিম দিকের কোনো খাল ধরে চলছে ট্রলার। বললাম, ওদিকটা তো অভয়াশ্রম। এই সন্ধ্যাবেলা জেলেদের ট্রলার তো চলার কথা না। হতে পারে কোনো দস্যুদল যাচ্ছে ওদিক দিয়ে। আড়পাঙ্গাসিয়া নদীর এপাশ ওপাশ দস্যুদের নিরাপদ চলাচলের পথ।

নীল কমল অর্থাৎ হিরণ পয়েন্টের ভেতরটা এমনিতে নিরাপদ। তবে সেটি দিনের বেলা। অন্ধকারে পুরো বন থাকে দস্যুদের নিয়ন্ত্রণে। চলাফেরার কাজ তারা রাতেই করে। শীত মৌসুমে ওদের টার্গেট থাকে বঙ্গোপসাগর। তাই অবস্থান নেয় সাগরের কাছাকাছি কোনো খালে।

পূর্ব দিকের দস্যুরা সচরাচর ছাপড়াখালী দিয়ে সাগরে যায়। জেলে অপহরণ করে আবার একই পথে ফিরে আসে। পশ্চিমের দস্যুরা আড়পাঙ্গাসিয়া ও মান্দারবাড়িয়া দিয়ে সাগরে যায়। দুই একটি দস্যুদল চলাফেরা করে সীমান্ত ঘেঁষা মামদো নদী দিয়ে। পশুর নদীতে নিয়মিত সব ধরনের নৌযান চলাচল করে। বন্দরের জাহাজ, নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডের জাহাজ এখানে নোঙ্গর করা থাকে। তাই পশুর মোহনা এড়িয়ে চলে বনদস্যুরা।

আমরা আছি পশুর আর আড়পাঙ্গাসিয়া নদীর মাঝখানে। ভোরবেলা যাবো পশ্চিম দিকে অর্থাৎ আড়পাঙ্গাসিয়া নদীর কাছে। ওখানে বালির গাঙ নামে যে খালটি রয়েছে সেখানেই থাকবো। খালপাটার জেলেদের মাছ ধরা দেখবো।

একটা গুলি হলো। বেশি দূরে না। মনে হচ্ছে কাগা অথবা বালির গাঙ এর ওদিক থেকে আসলো শব্দ। শিকারী হতে পারে, বনদস্যুও হতে পারে। সরদার বললেন, যে হয় হোক। আসলে দেখা যাবে।

এখন জোয়ার চলছে। ঘন্টা খানেক বড়শি নিয়ে বসে আছি। মাছের খবর নাই। জোয়ারের সময় পানিতে স্রোত বেড়ে যায়। মাছেরা দৌড়ঝাঁপ করে। তাই এসময় বড়শিতে মাছ হয় না। তবুও সময় কাটানোর জন্য বসেছি। একটু পর পর চা আসছে, আড্ডা চলছে।

রাত এগারোটা। দূর থেকে বাঘের ডাকের শব্দ ভেসে এলো। পর পর তিন বার। জেলেরা বলে, এখন নাকী বাঘের প্রজনন মৌসুম। ছেলে বাঘ মেয়ে বাঘ খোঁজে। ডাক দিয়ে তারা নিজের অবস্থানের কথা জানান দেয়। অদ্ভুত ব্যাপার। বাঘের ডাকের উত্তরে বাঘিনীও ডাক দেয়। গহীন বন, খাল, নদী পেরিয়ে ঠিক সেখানে পৌঁছে যায় বাঘ মামা।

এই মৌসুমকে নাকী বাঘ শিকারীরা কাজে লাগায়। বাঘ শিকারী পচাব্দী গাজী কিংবা আরজান সরদারের গল্পে পড়েছি, মাটির হাঁড়িতে মুখ দিয়ে বাঘিনীর ডাক দিতে পারতো তারা। সাড়া দিয়ে সেখানে বাঘ আসতো।

শিকারীরা গাছের উপর বন্দুক হাতে অপেক্ষা করতো। তারপর বাঘ এলে গুলি করতো। এসব অনেক পুরনো গল্প। তখন বাঘ শিকারের জন্য বন বিভাগ শিকারী ভাড়া করতো। বাঘ মারতে পারলে মোটা অংকের পুরস্কার দিতো সরকার। শিকারীদের তখন সম্মান দিতো সবাই।

বাঘ শিকারের গল্প শুনতে বেশ লাগে। আবার ভাবি যে অতীতে এভাবে শিকার না করালে হয়তো সুন্দরবনের বাঘ নিয়ে এতো দুশ্চিন্তায় পড়তে হতো না। মূলত মানুষখেকো বাঘ মারতেই সরকারি ভাবে শিকারকে উৎসাহিত করা হতো। কিন্তু মানুষখেকো মারতে গিয়ে সুন্দরবনের অসংখ্য বাঘের মৃত্যু হয়েছে।

অনেকে বলেন, মানুষখেকো বাঘ বলে কিছু নাই। সব বাঘই পেট ভরানোর জন্য শিকার করে। সুবিধা মতো যাকে পায় তাকেই ধরে। আলাদা করে মানুষ শিকার করে এমন বাঘ নাই।

ট্রলারের পাটাতনে বসে গল্প হচ্ছে। সুন্দরবনের মানুষদের কাছ থেকে মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতাগুলো শুনছি। বাঘের আচরণ সম্পর্কে জানছি। তার সাথে বই পড়ে জানা বাঘের আচরণ মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করি।

সুন্দরবন ও সুন্দরবনের বাঘ নিয়ে বই খুঁজি, পড়ি। তোহা খান ও খসরু চৌধুরীর বই আমাকে আলোড়িত করে। বিশেষ করে সুন্দরবনের বাঘ নিয়ে খসরু চৌধুরীর বই আমার কাছে সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়। বাঘ নিয়ে তাঁর দীর্ঘ অভিজ্ঞতা সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলেছেন। এই লেখক দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা করেছেন, ফটোগ্রাফি করেছেন। শুনেছি এখন কানাডায় থাকেন। উনার সাথে দেখা হয়নি, পরিচয়ও নাই।

সুন্দরবনের বাঘের পিছুপিছু নামে খসরু চৌধুরীর একটি বই পড়েছি। বাঘ নিয়ে আমার জ্ঞানের দৌড় মোটামুটি সে পর্যন্তই ছিলো। এরপর সুন্দরবনে অবাধ চলাফেরা করতে গিয়ে নিত্য নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছি। বইয়ের সাথে জঙ্গলের বাঘের চরিত্র মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করছি।

জঙ্গল করা জেলে, মৌয়াল, গোলপাতা সংগ্রহকারীদের কাছে বাঘ নিয়ে তাদের অভিজ্ঞতা শুনি। বনদস্যুদের মুখে শুনেছি বাঘ শিকারের গল্প, পেশাদার শিকারীদের মুখেও শুনেছি তাদের গল্প। অবশ্য সুন্দরবনে বাঘ শিকারের গল্প কেউ করতে চায় না।

আবারও বাঘ ডাকলো। একটু আগে যেদিক থেকে শব্দ এসেছিলো এবারেরটাও সেদিক থেকেই আসলো। জেলেরা বলে, প্রজণন মৌসুমে তারা খালের আগায় থাকে না। বাঘের চলাফেরা এসময় বেশি থাকে, মামারা উত্তেজিতও থাকে। তাই বনদস্যু বা ফরেস্টের হাতে ধরা পড়ার ঝুঁকি থাকলেও এই মৌসুমে তারা রাতের বেলা বড় খালে এসে থাকে। একটু আড়াল খুঁজে নিলেই হয়।

রাতের বেলা চিংড়ি দিয়ে খিচুরি রান্না করার কথা। চরপাটার জেলেরা এদিকে ফিরবে। বললাম, সবার জন্য রান্না করতে হবে। সরদার বললেন, জেলেরা আর ফিরবে না ভাই। এদিকের পরিবেশ একটু ঘোলাটে। জেলেদের ব্যাপক ভয়ে দেখিয়েছে তাদের মহাজন। বললাম, যদি আসে তখন কী হবে? সরদার বললেন, আসলে তখন নতুন বরে রান্না চড়াবো।

বাঘের গল্প থেকে মহাজনের গল্প শুরু হলো। দাদন আর সূদের কারবারের ভয়ঙ্কর রূপ এই বাদা বনে না আসলে কখনও জানতে পারতাম না। এখানে বাঘের চেয়ে সূদে মহাজনের ভয় অনেক তীব্র।

এখানে ডাকাতের ভয়ে বাঘের রাজ্যে আশ্রয় নেয় মানুষ। কারণ বাঘে ধরলে বাঁচার সম্ভাবনা থাকে। ডাকাতে ধরলে মুক্তিপণের টাকা দিতেই হবে। আর সেই অর্থ জোগাড় করতে ঋণ করতে হবে।

সূদে ধার নেওয়া টাকা এক জীবনে শোধ করা যায় না। চেক এর মামলায় পড়ে সর্বস্ব হারানো মানুষের সংখ্যা এদিকে গণে শেষ করা যাবে না। দেনা শোধ করতে না পেরে কেউ দস্যুতায় নামে, কেউ দেশান্তরী হয়। দেনার দায়ে আত্মহত্যার খবরও শুনি।

ছপ ছপ ছপ ছপ শব্দ তুলে নৌকা আসছে। উজান ঠেলে বেশ দ্রুত চলছে মনে হচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে বাঁক ঘুরলো। হাল্কা চাঁদের আলোয় আবছা দেখছি। পর পর দুটি নৌকা। উল্টো পাশের তীর ধরে আসছে। বাঁক ঘুরতেই ওদের দেখা গেলো। ওরাও দেখলো আমাদের ট্রলার। সাথে সাথে বৈঠা থামলো। কয়েক মুহুর্ত দাঁড়ালো। সাথে সাথে রওনা দিলো উল্টো দিকে।

বুকটা ধক ধক করছে। সরদারকে বললাম, ডাকাতের নৌকা মনে হচ্ছে? সরদার বললেন, কোনো সন্দেহ নাই। ওরা চলে যাক ভাই। আসলে খামোখা ঝামেলা বাড়বে। চিৎকার করে ডাক দিলাম। ও ভাই, কারা আপনারা? আসেন, চা খেয়ে যান!

কোনো উত্তর এলো না। ছপ ছপ শব্দ তুলে হারিয়ে গেলো তারা। কারা ওরা জানি না। হতেও পারে কোনো বনদস্যু দল।

(সুন্দরবন ২০১৬)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top