আমাকে অ্যারেস্ট করতে এসেছে | রূপান্তরের গল্প ৩০৫ | Rupantorer Golpo 305 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ৩০৫ : এই কারা তোমরা? কুয়াশার আড়াল থেকে ফুঁড়ে বের হয়ে কানে আসলো। ভোর হলেও কুয়াশায় কিছুই দেখছি না। ট্রলারের সঙ্গীরা সবাই ঘুম। ডেক এর উপর হেলান দিয়ে বসে আছি। মাথায় এলোমেলো ভাবনা ঘুরছিলো। একটু তন্দ্রাও ছিলো চোখে। হঠাৎ অপরিচিত কণ্ঠের ডাক শুনে উঠে বসলাম। চারপাশে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কাউকে দেখছি না।
আবার সেই একই প্রশ্ন। কারা তোমরা? কথা বলো না কেন? এবার সাড়া দিলাম। বললাম, আমরা জেলে। জানতে চাইলো, কার জেলে? বললাম, বেলায়েত সরদারের জেলে। ওরা বললো, এই জায়গায় কী করো? বললাম, কুয়াশায় পথ ভুলে চলে আসছি। ওরা বললো, এখনই এলাকা ছাড়ো। বললাম, আলো ফুটুক। বের হয়ে যাবো।
এবার ওপাশ থেকে একজন গালি দিলো আমাদের। বললো, অতো কথা বলিস কেন? এই কারা তোরা? এখনই স্টার্ট দে।
এর মধ্যে সরদারের ঘুম ভাঙ্গলো। উঠে বসলেন। চোখ ডলতে ডলতে জিজ্ঞেস করলেন, কী হইছে ভাই? বললাম, মনে হয় ফরেস্ট অথবা ডাকাত। এর মধ্যে ওই পাশ থেকে বলা হলো, গুলি করে উড়ায়ে দিবানে। এই তোরা দাঁড়া। কোথাও যাবি না।
ওদের নিজেদের মধ্যে যে কথাবার্তা চলছে, তাতে বুঝলাম, উনারা বন বিভাগের লোকজন। সরদারকে বললাম, আপনি কথা বলেন না। চিৎকার করে বললাম, আমরা চলে যাবো। বলেই সরদারকে বললাম, শহীদুল কাকুকে ডাক দেন। আমরা রওনা দিবো।
কুয়াশার আড়ালে থাকা নৌকাটিকে এখন আবছা দেখতে পাচ্ছি। আরেকটু কাছে আসার পর দেখি ডিঙ্গি নৌকা না। সেটি বন বিভাগের ট্রলার। ছোট্ট একটি ট্রলার। সামনে একটি পতাকা লাগানো।
লগি বেয়ে এগিয়ে আসছিলো ওরা। হঠাৎ করেই ইঞ্জিন চালু হলো। মুখ ঘুরিয়ে বিপরীত দিকে রওনা হলো তারা। সরদার বললেন, বসে বসে গালি শুনলেন ভাই? বললাম, খেলাম না হয় কিছু গালি। উনারা ফরেস্টের লোক। ভাবলাম দেখা হলে ভুল ভেঙ্গে যেতো। কিন্তু ওরা তো চলে গেলো।
বনরক্ষীরা এদিকে কড়া টহল দেন। মাঝে মাঝেই বড় কর্তারা আসেন। সাতক্ষীরা বা খুলনা থেকে স্পিডবোটে আড়পাঙ্গাসিয়া। নদীর পশ্চিম পাশ সাতক্ষীরা রেঞ্জ। পূর্ব দিকে খুলনা রেঞ্জ। আমরা আছি খুলনা রেঞ্জ এর দক্ষিণে। যে খালে আছে সেই খাল দিয়ে যেতে হয় নীল কমল বন বিভাগের অফিসে। যেকোনো সময় বড় স্যাররা আসতে পারেন। তাই এই বালির গাঙ সব সময় নজরদারিতে রাখেন বনরক্ষীরা।
বনরক্ষীদের ট্রলারের শব্দদ মিলিয়ে গেলো। ভাবছি, জেলেদের সাথে কতো কুৎসিত ভাষায় কথা বলেন উনারা। এর মধ্যে এক কাপ চা নিয়ে সামনে আসলেন শহীদুল কাকু। চায়ে চুমুক দিলাম। বললাম, ফরেস্টের লোকজন এতো খারাপ ভাষায় গালি দেয়? কাকু বললেন, গালি আর মারপিটের কোনো হিসাব নাই। এই জঙ্গলে জেলেদের কপালে এসব ছাড়া আর কিছু নাই।
মামুন এসে রান্নাঘরের জিনিষপত্র গোছাচ্ছে। আমার কথা শুনে হাতের কনুই-এর একটি দাগ দেখিয়ে বললো, গড়ানের লাঠি দিয়ে মেরে একবার তার হাত প্রায় ভেঙ্গে ফেলেছিলো ফরেস্টাররা। পরে টাকা পয়সা দিয়ে দফারফা হয়। মারও খেলাম, টাকাও নিলো। ডাকাতে ধরলেও তাই করে। এখানে প্রশাসন আর ডাকাতের মধ্যে তাহলে পার্থক্য কী থাকলো?
এই জঙ্গলের আকাশে বাতাসে কতো যে দীর্ঘশ্বাস ঘুরে বেড়ায়! মনে মনে ভাবি, এতো বড় এক দুনিয়ার কোনো খবরই আমরা রাখি না। খালি বাঘ নিয়ে আমরা কথা বলি। বন বিভাগও মনে হয় যেন বাঘের হিসাবটা বুঝিয়ে দিতে পারলেই বাঁচে। আমরা বাঘের সংখ্যার সাথে সুন্দরবনের ভালো থাকা হিসাব করি। অথচ এই গহীন জঙ্গলের প্রাণবৈচিত্র কতো ভাবে ধ্বংস হচ্ছে!
কুয়াশা আরও গভীর এখন। আবছা করেও কিছু দেখার উপায় নাই। ভাটা আছে আর বড় জোর এক ঘন্টা। গতকালের পরুকল্পনা অনুযায়ী কিছুই হলো না। খালপাটার জেলেদের কোনো খবর নাই। এর মধ্যে তীব্র শীত পড়েছে। ভাবছি কম্বলের ভেতরে ঢুকে পড়ি। আজ আর না নামি জঙ্গলে।
সবাই একটু চুপ করেন। নৌকার শব্দ পাচ্ছি মনে হয়। সবাই চুপ করলো। ডান পাশ থেকে ছপছপ শব্দে নৌকা আসছে। মিনিট খানেকের মধ্যে আমাদের ট্রলার অতিক্রম করলো ওরা। ওদের ডাক দিলাম। শুনলো না। এবার হাঁক দিলেন সরদার।
কুয়াশার কারণে আমাদের দেখেনি। ডাক শুনলেও আসতে চায়নি। দ্রুত সরে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলো। তবে কাছে আসতেই ভুল ভাঙ্গলো। ওরা কয়রার জেলে। আমার পরিচিত।
কই যাচ্ছেন আপনারা? জেলেরা বললো, ভেতরে খালপাটা দেওয়া। অন্যরা গেছে। খালে ফরেস্টার থাকায় তাদের একটু দেরি হয়ে গেছে। বললাম, কালাবগীর জেলেরা এদিকে পাটা দিলো শুনলাম। ওরা বললো, তারাও আছে অন্য কোনো খালে। সরদার বললেন, কালকের জেলেরা ইচ্ছা করে আমাদের ডাকেনি ভাই। মহাজনে ওদের ভয় দেখাইছে।
নৌকায় উঠে বসলাম। সরদার সঙ্গে নামলেন। শুকনা খাবার, পানি আর দুধ চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে রওনা হলাম। নৌকা চলছে এবার পানি আর কুয়াশা ঠেলে।
ট্রলার থেকে নামার সময় ভারী কাপড় নিয়েছি। তারপরও ঠকঠক করে কাঁপছি। উত্তরের তীব্র বাতাসে চারপাশ এখন হীম শীতল। হাতমোজা, পায়ের মোজা, মাফলার, কানটুপি পড়েছি। কিন্তু কয়েক মিনিটের মধ্যে সবকিছু কুয়াশায় ভিজে গেলো।
একটু পর হাতের বাম পাশের ছোট খালে ঢুকলাম। খালটিকে ছোট বলছি। তবে খুব ছোট না। আমাদের সাধারণ নদীগুলোর চেয়ে বড়। এই খালের আগার দিকে তিনটি খালে জাল দিয়েছে এই জেলেরা। ওরা বললো, কালাবগীর জেলেরাও এই খালেই আছে।
নৌকা চলছে। জবুথবু হয়ে বসে আছি আমি। সারা রাত ঘুম নাই। শীতে কাতর। তার মধ্যে কুয়াশা পড়ছে টপটপ করে। গাছপালা, মাটি সবকিছুই ভেজা। যে নৌকায় বসে আছি সেটিও ভিজে গেছে। এক বাঁক ঘুরে দ্বিতীয় বাঁকে উঠতেই কয়েকজন জেলেদের দেখা পেলাম। নৌকায় বসা। গতকালকের জেলেরাও আছে তাদের মধ্যে।
কী ব্যাপার ভাই? ট্রলার নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম। আপনারা গেলেন না তো! বললো, রাতের বেলা খুঁজে পাইনি ভাই। বললাম, সত্যি কথাটা বলেন। আপনাদের সাথে আমার কোনো বিরোধ নাই।
জেলেরা বললো, ফরেস্টাররা আসছিলো। ওরা আপনাদের খুঁজছে। ভাবলাম, ঝামেলার মধ্যে জড়ায়ে লাভ কী? মুহুরি বলে দিছে আপনাদের সাথে যেন কথা না বলি। মহাজনে বলছে, আপনার সাথে যেন দেখা না করি আর। বললাম, দেখা তো হয়েই গেলো! যাক। আপনারা কাজ করেন।
নৌকা বেয়ে সামনে এগুবো। এমন সময় ওই জেলে ডাক দিলো। দাঁড়ালাম আমরা। নৌকা বেয়ে আমাদের নৌকার পাশে ভিড়লো ওরা। নিচু স্বরে বললো, আপনারা চলে যান ভাই। এখানে থাকলে আপনার বিপদ আমাদেরও বিপদ। মুহুরি কাল ফরেস্ট অফিসে গেছিলো। সেই তাদের বলে দিয়েছে যে আপনারা রাতে এই খালে থাকবেন।
মহাজনও নাকী ফরেস্ট অফিসে ফোন দিছিলো। বলছে, সাংবাদিক খালের ভেতর ঘোরাঘুরি করছে। নিউজ করলে সবার বিপদ হবে। তারপর মুহুরি গিয়েও একই কথা বলছে। রাতের বেলাতেই তাই টহলে বের হইছিলো বনরক্ষীরা। জেলে ভাই বললো, আপনাকে অ্যারেস্ট করতেই আসছিলো তারা। আমি বললাম, মাছ ধরার সময় হয়েছে। আপনারা মাছ ধরেন। আমি সামনের দিকে যাচ্ছি।
জেলেরা বললো, মাছ ধরা শুরু হবে আরও ঘন্টা খানেক পর। খালের পানি এখনও পুরোটা নামেনি। মাছ ধরা শেষ হলে আবার আসবে ফরেস্টাররা। খাওয়ার মাছ নিতে আসবে। বললাম, আপনারা না চুরি করে মাছ ধরছেন? হাসি দিয়ে ওরা বললো, মাছ তো ধরি টাকা দিয়ে। বললাম, এই জেলেদের সাথে আছি। খালের আগার দিকে ওদের খালপাটা দেওয়া। ফরেস্টাররা আসলে পাঠিয়ে দিয়েন।
নৌকা চলছে উত্তর দিকে। শেষ ভাটায় পানি নেমে এসেছে তলানিতে। সরদার বললেন, উত্তরা বাতাসে বাড়ি দিচ্ছে ভাই। আজ মনে হয় ফরেস্টাররাও আপনাকে বাড়ি দিবে। বললাম, আমাকে বাড়ি দেয় দেক। জেলেদের গায়ে বাড়ি দেওয়া বন্ধ হোক।
এই জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো আমার শখ না। বনদস্যুদের আত্মসমর্পণ করানোই আমার লক্ষ। সেটি করতে গিয়ে ঘুরছি। বিশাল এই বন উপকূলের বিচিত্র জীবন দেখছি। চোখের সামনে নিপীড়নের অসংখ্য উদাহরণ।
এই গহীন বনে না আসলে মা জানতেও পারতাম না ভয়ঙ্কর সব নিপীড়নের কথা। আমরা না জানলে দেশের মানুষও জানতো না ভেতরের খবরগুলো। নিপীড়নের শিকার এই প্রান্তিক মানুষেরা। আইনের মার, টাকার মার, লাঠির মার, সবকিছুই যায় তাদের পিঠের উপর দিয়ে।
দেখতে দেখতে খালের আগায় চলে আসলাম। দুইটি নৌকায় ছয়জন বসা। সাথে যোগ হলো আমাদের নৌকাটি। তিন নৌকার এই জেলে বহর এদিকে খালপাটা জাল দিয়ে মাছ ধরে। একটু পর জাল দেওয়া সরু খালে ঢুকবে তারা। আমিও নামবো। আজ দেখবো খালপাটা জালে মাছ ধরার দৃশ্য।
(সুন্দরবন, নভেম্বর ২০১৬)