রূপান্তরের গল্প ৩০৬ | Rupantorer Golpo 306

জঙ্গলের খাল ভরা মাছ! | রূপান্তরের গল্প ৩০৬

জঙ্গলের খাল ভরা মাছ! | রূপান্তরের গল্প ৩০৬ | Rupantorer Golpo 306 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ৩০৬ : বড় মাছ আটকা পড়েছে জালে। সরু খালের ভেতর থেকে মাছের লেজের বাড়ির আওয়া আসছে। সেই শব্দে চোখমুখ জ্বলজ্বল করে উঠছে জেলেদের। এক দুইটি বড় মাছ উঠলে ওদের চালান উঠে যায়।

বড় মাছের মধ্যে খালপাটায় সাধারণত ভেটকী মাছ আটকা পড়ে। কখনও কখনও কই ভোল নামে বিশাল আকৃতির মাছও আটকা পড়ে। অবশ্য ওরা জাবা মাছের আশায় থাকে সব সময়। তিন কেজির বড় মর্দা জাবা অনেক দামে বিক্রি হয়।

মাছের শব্দ শুনে আমি তাড়াতাড়ি তৈরি হতে লাগলাম। জেলেরা বললো, তাড়া নাই ভাই। ভাটার পানি আরেকটু না নামলে মাছ ধরা যাবে না। বললাম, বড় মাছ চলে যাবে না? বললো, মাছ যাবে না। খালের মুখে জাল আছে।

জানতে চাইলাম এদিকে আর কী কী মাছ ধরা পড়ে আপনাদের জালে? ওরা বললো, পাতাড়ী অর্থাৎ ভেটকী, জাবা, কই ভোল, কাউইন, ভাঙ্গন, পায়রা, সাদা দাতিনা, কালো দাতিনা, রুছো, কাকিলাসহ আরও নানা জাতের মাছ। গলদা, বাগদা, চাকা, হরিণা, কাঁঠালী, চামি, চালিসহ আরও কয়েক জাতের চিংড়ি ধরা পড়ে।

আরও আধা ঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে। এই জেলে বহরের সবাই আগের পরিচিত না। তবে আসার পর পরিচয় পেয়ে উচ্ছসিত তারা। ডাকসাইটে দস্যুনেতা ইলিয়াস, হারুনসহ কয়রার বেশ কয়েকজন বনদস্যু আমার মাধ্যমে আত্মসমর্পণ করেছে। সেই গল্প শুনেছে তারা।

একজন তো বলেই বসলো যে ইলিয়াসের দেওয়া কুড়ি লাখ টাকা আমি ফিরিয়ে দিয়েছি। বললো, ইলিয়াস নিজেই নাকী তাদের সাথে এই গল্প করেছে। আমি বললাম, ওই টাকা আমি নেই কী করে বলেন? ওরা বললো, আপনার কথা অনেক শুনছি। আজকে দেখা হলো।

জেলেদের এই বহরের নেতার নাম সফিকুল। বয়স পঞ্চাশের মতো হবে। বললেন, আপনাকে বন বিভাগ তাড়াচ্ছে কেন? বললাম, তা তো জানি না। তবে কালাবগীর ওই জেলে বহরের মহাজন চাচ্ছে না আমি এদিকে থাকি। ওরাই বন বিভাগের লোকজনকে বলেছে আমাকে ধরতে। জেলেরা বললো, আসুক দেখি ধরতে। মনে মনে ভাবছি এতো সাহস এদের?

কিছুক্ষণের মধ্যে একটি বিষয় পরিস্কার হলো। এই জেলেরা বনদস্যু নোয়া বাহিনীর ঘনিষ্ঠ। এদের মধ্যে নোয়া মিয়ার আত্মীয় স্বজনও আছে। তাই বনরক্ষীদের গণার সময় নাই। ওরা বললো, আমাদের কাছে এদিকের ফরেস্টাররা আসে না। আপনি নিশ্চিন্তে থাকেন। বললাম, আমি যে বনদস্যুদের নিয়ে কাজ করছি সেটা এদিকের সবাই জানে। তারপরও কেন এমন করবে তারা?

জেলে বহরের প্রধান সফিকুল বললেন, আপনি যা শুরু করছেন তা শেষ করতে পারলে মহাজনেরা বিপদে পড়বে। ওরাই তো ডাকাত বানায়, ডাকাত পোষে, আবার ডাকাত মারেও। এক বাহিনী সরিয়ে অন্য দস্যুদল নামায়। একজনকে মারায়, আরেক জনকে তোলে। জঙ্গলের দস্যু জগতের খেলাধূলা তাদের হাতেই চলে।

এসব নিয়ে কথাবার্তা পরে হবে। চা খাওয়ান। শীতে জমে যাচ্ছি। সাথে সাথে চুলা জ্বললো। ডিঙ্গি নৌকাগুলোর খোলের ভেতর টিনের তৈরি চুলা থাকে। কাঠ কয়লায় আগুনও থাকে। চায়ের কথা বলতে বলতে চুলায় পানি উঠলো। মাছ ধরতে নামার আগে তারাও এক কাপ করে চা খাবে। কড়া লিকারের চা খেয়ে অভ্যস্ত তারা। ব্যাগ থেকে গুঁড়া দুধের প্যাকেট বের করে দিলেন বেলায়েত সরদার। আমার জন্য হবে দুধ চা।

সুন্দরবনের এই জায়গাটি অসম্ভব সুন্দর। কুয়াশা ঢাকা চারপাশ। তার মধ্যেও যেটুকু দেখতে পাচ্ছি তার সাথে পৃথিবীর কোনো সৌন্দর্যের তুলনা হয় না। স্নিগ্ধতার সাথে বন্য পরিবেশ মিলিয়ে অদ্ভুত এক পরিবেশ তৈরি হয়েছে। তীব্র শীতের মধ্যে জেলেরা যে যার মতো ভারী কাপড় পড়ে বসে আছে।

সকলের গায়ে ভারী জ্যাকেট। মাফলার আর কানটুপিও আছে সবার গায়ে। কিন্তু কোমড় থেকে নিচের দিকটা ভেজা। কেউ কাছা মারা লুঙ্গি পড়ে আছে, কেউ শর্টস বা হাফ পান্ট পড়া।

একটু আগে খালপাটা দেওয়া খালে নেমে ঘুরে এসেছে তারা। বললো, খালে মাছ আছে। তবে পরিবেশ খুব ভালো না। আশেপাশে বাঘ মামা থাকতে পারে।

চা খেয়ে যে যার মতো রওনা দিলো। তিন নৌকা যাবে তিনটি খালে। আমাদের নৌকাটি যাবে সবচেয়ে কাছের খালটিতে। সেখান থেকেই বড় মাছের লেজ ঝাপটানির শব্দ আসছে।

জেলেরা আমাকে খালে নামতে দিতে চায় না। বলে বাঘের চাপ খুব। কিন্তু আমি তো মাছ ধরা দেখতে এসেছি। না নেমে থাকতে পারি? সরদার বললেন, সরু খালে বাঘের ঝুঁকি ‌একশো তে একশো।

জেলেরা বললো, সাপও আটকা পড়ে জালে। এছাড়া কাউইন মাছ, টেংড়া মাছের কাঁটা পায়ে ঢুকলে ব্যাথায় মরে যাবেন। বললাম, এসব বলে আমাকে আটকানো যাবে ভাই? সরদার বললেন, আটকানো যাবে না জানি। তারপরও ভাবলাম ঝুঁকি না নেই। বললাম, তাহলে চলেন ফিরে যাই। হেসে দিলেন সরদার। বললেন, আপনার জন্য এখন আমারও এই কাদায় নামা লাগবে। বললাম, আপনি না গেলে চলবে?

জামা কাপড় বদলে নিলাম। সরদারও হাফ প্যান্ট পড়ে তৈরি হলেন। নৌকা নিয়ে খালের মুখে নোঙ্গর করলাম। একজন নেমে ভেতরের দিকে গেলো। মিনিট দশ পর ফিরে আসলো। গামছায় বেশ কয়েকটি পায়রা মাছ বাঁধা। নৌকার খোলে সেগুলো রাখতে রাখতে সে বললো, ভাইয়ের রাশি ভালো মনে হচ্ছে। খালে আজ মেলা মাছ! একই সাথে বললো, জঙ্গলের ভাব চক্কর ভালো না। মামা মনে হয় কাছেকূলে কোথাও আছে।

মনে মনে বেশ খুশি হলাম। আজ তাহলে প্রচুর মাছ দেখতে পাবো! আবার দুশ্চিন্তাও হচ্ছে। বাঘ মামার আলামত থাকা মানে ভালো খবর না। বিপদের শংকা অনেক বেশি। সবাইকে বললাম, সতর্ক থাকবেন।

জেলেরা বললো, চলেন ভাই। কোনো সমস্যা হবে না। আমরা আছি না? বললাম, সেই সাহসেই তো জঙ্গলে নামি। আপনারা থাকলে আমার কোনো ভয় নাই। ওরা বললো, এদিকে মামার চাপ সব সময়ই একটু বেশি। কখনও একা থাকবেন না। সরদার বললেন, আপনার সামনে থাকবে জেলেরা। আর পেছনে থাকবো আমি। তারপরও চোখ আর কান খোলা রাখবেন।

জঙ্গলে নামলাম। খালের মুখে কাদা এক হাঁটুর বেশি। কোনো রকমে হাঁচড়ে পাঁচড়ে এগিয়ে গেলাম। খালের যেখানে জাল বাঁধা সেখানে গিয়ে দাঁড়ালাম। সেখানে যা দেখলাম তা অভাবনীয়। জালের সামনে পানি আর মাছ সমান সমান। মনে হয় কয়েক মণ মাছ এখানেই আছে। চাকা চিংড়িগুলো ছটফট করছে। লাফিয়ে লাফিয়ে জালে বাড়ি খাচ্ছে আর পানিতে পড়ছে। কাকিলার মাছগুলো কিলবিল করছে। জালের সাথে আটকে আছে একটি সাপ।

আঁৎকে উঠলাম। সাপ ভয় পাই। জেলেরা বললো, ভয় নাই ভাই। আপনি এখানেই থাকেন। বললাম, সাপটাকে সরান। বলতে বলতে একজন হাত দিয়ে ধরে সাপটিকে ছুঁড়ে ফেললো জঙ্গলের ভেতর। মনে একটু সাহস নিয়ে এগিয়ে গেলাম। যেমন কথা ছিলো সেভাবেই সামনে পেছনে দুইজনকে রেখে এগিয়ে চললাম।

ছোট্ট খালটি সামনে গিয়ে একটু বড়। একটি দোয়া মানে তিন মোহনা পড়লো। সেখান থেকে তিন দিকে তিনটি খাল চলে গেছে। আমরা বড়টি ধরে এগিয়ে যাবো। বললাম, এই দোয়ার কাদায় আটকে থাকা মাছগুলো ধরবেন না? ওরা বললো, খালের আগা থেকে মাছ ধরতে ধরতে নামবো। বড় মাছগুলো একদম আগার দিকে থাকে।

কাদা ও পানি এখানে সমান সমান। আগে ধারণা ছিলো যে বড় মাছ থাকে বেশি পানিতে আর ছোট মাছ থাকে অল্প পানিতে। কিন্তু এই সুন্দরবনে এসে ধারণা পাল্টে গেছে। বড় মাছগুলো ছোট ছোট খালে ঘুরে বেড়ায়।

পারশে মাছের পোণা খেতে বড় মাছগুলো ছোট ছোট খালে আসে। জোয়ারের সময় যখন পানি বেশি থাকে তখন মাছ খেতে খেতে এসব জোলা খালে ঢুকে পড়ে। তারপর ভাটায় আবার বেরিয়ে যায় বড় খাল-নদীতে।

শেষ জোয়ার অর্থাৎ ভাটা শুরুর আগে খালের মুখে জাল টেনে দেয় জেলেরা। এরপর পানি নামে। কিন্তু মাছগুলো আর বের হতে পারে না। জালে বাড়ি খেয়ে বড় মাছগুলো আবার খালের আগার দিকে ছুটে যায়। ওরা আর নিচে নামে না। জেলেরা বলে, ওরা চিন্তা করে যে কোনো রকমে শেষ ভাটার সময়টুকু কাদায় মিশে থাকবে। তারপর আবার জোয়ার আসলে ভেসে নেমে যাবে।

সুন্দরবনের মাছের আচার আচরণ সম্পর্কে খুব ভালো জানে জেলেরা। আমার মনে হয় এই অঞ্চলের মাছসহ জলজ প্রাণিদের নিয়ে তাদের চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না। বিজ্ঞানী বা সংশ্লিষ্টদের তেমন কোনো গবেষণাও করতে দেখি না। করলেও জানতে পারি না। যদি সেরকম গবেষণা হতো তাহলে নিশ্চয়ই সুন্দরবনের মাছ সুরক্ষায়, লবণ জলের প্রাণবৈচিত্র রক্ষায় বাড়তি উদ্যোগ দেখতাম।

যদি সংশ্লিষ্ট সকলে জানতেন যে বিষ দিয়ে মাছ শিকারের প্রবণতা বেড়ে গেছে তাহলে নিশ্চয়ই বিষের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান গড়ে উঠতো। এই জেলেরা এখন বিষ দিয়ে মাছ ধরছে না। কিন্তু ধরে না সেই কথা নিশ্চিত ভাবে বলা যায় না।

খালের একদম আগায় চলে এসেছি। এখন শুরু হবে মাছ ধরা। ফিরতি পথ পুরোটা জুড়ে হাত আর জালতি দিয়ে মাছ তুলবে জেলেরা। ধরা মাছগুলো রাখার জন্য জায়গায় জায়গায় ড্রাম রাখা। জেলেরা বললো, নিচের বাদার খালে বিষ দেওয়ার দরকার পড়ে না। এদিকে এমনিতেই মাছ বেশি। তবে লোকালয়ের কাছাকাছি জঙ্গলের খালে বিষ ছাড়া মাছ ধরে না কেউ।

খালের ভেতর যে পরিমান মাছ দেখছি তার সবগুলো তুললে নৌকায় জায়গা হবে না। জেলেরা বললো, এতো মাছ তুলতেও পারবো না। সাগর কূলের খাল তো! দেখতে দেখতে জোয়ারের পানি ঢুকে যাবে। তার আগে যেটুকু তোলা যায়। সময় কম পাবে বলে শুধু বড় মাছগুলো ধরছে তারা।

আধা ঘন্টা একটানা মাছ তুলছি আমরা আর ফিরছি খালের মুখের দিকে। জানতে চাইলাম বড় মাছগুলো কই? ওরা বললো, একটু ধৈর্য ধরেন ভাই!

(নভেম্বর ২০১৬ | সুন্দরবন)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top