রূপান্তরের গল্প ৩০৮ | Rupantorer Golpo 308

বেলায়েত সরদার অ্যারেস্ট! | রূপান্তরের গল্প ৩০৮

বেলায়েত সরদার অ্যারেস্ট! | রূপান্তরের গল্প ৩০৮ | Rupantorer Golpo 308 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ৩০৮ : টুপটাপ শব্দে পানি পড়ছে। ঘন কুয়াশা জমছে গাছের পাতায়। সেখান থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরে পড়ছে খালের পানিতে। এমনিতে চারপাশ স্তব্ধ হয়ে আছে। পাখিও ডাকছে না। সুন্দরবনের এই নিরবতা এমনিতে ভালো লাগে। সেই সাথে বিপদের আভাসও দেয়।

মাঝ খালে নোঙ্গর করেছি আমরা। পানির ওপর দিয়ে ঘুরছে কাকিলা মাছের ঝাঁক। পারশের পোণারা ছুটে বেড়াচ্ছে। খালের তীর দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে চলছে চাকা চিংড়ি। পানি বেশ ঘোলা।

এই বহরের আরেকটি নৌকা আসবে। দুশ্চিন্তা হচ্ছে ওদের জন্য। শিকার ধরতে না পেরে বাঘটি ওই খালের দিকে গেলো না তো? জেলেরা বললো, সেরকম কিছু হলে আওয়াজ পেতাম। তবুও দুশ্চিন্তা হচ্ছে। বুকটা ধকধক করছে।

বাঘের আক্রমণ থেকে বেঁচে আসা জেলেরা বললো, ওরা হলো চোর। চোরের মতো হিঁটাচলা করে, শিকার করে। পেছন থেকে শিকার ধরে। আমরা ওকে দেখে ফেলছি বলে আর ধরতে আসেনি। কাঠ ভাঙ্গার শব্দটা খেয়াল না করলে এতোক্ষণে সাইজ হয়ে যেতাম।

কিছুক্ষণ পর কালাবগীর জেলেরা আসলো। ওদের কাছে বাঘের কোনো গল্প নাই। ভালো মাছ পড়েছে ওদের জালেও। মন মেজাজ ভালোই ছিলো। কিন্তু আমাদের দেখে চেহারা অন্ধকার হয়ে গেলো।

আমরা এখনও যাইনি দেখে দুশ্চিন্তায় পড়লো তারা। নিচু স্বরে কথা বলছে নিজেদের মধ্যে। কাছে এসে নৌকা ভিড়ালো। বললো, যেকোনো সময় ফরেস্টাররা আসবে। জানতে চাইলাম কেন? রাতেই না আসছিলো ওরা! জেলেরা বললো, রাতে তো আপনাদের তাড়াতে আসছিলো। এখন আসবে মাছ নিতে।

মাছ নিতে আসবে মানে? ওরা কেন মাছ নিবে? জেলেরা বললো, বনে আসি মাছ ধরতে। উনাদের খাওয়ার মাছ দিতে হবে না? এছাড়া বড় স্যাররা আসলে তো বড় বড় মাছ আমরাই দেই। আমাদের দেখলে বিপদ হবে। তাহলে ওদের বিপদে ফেলবো না।

জেলে ভাইদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছিলাম। এমন সময় ট্রলারের শব্দ কানে এলো। ওরা একটু বিচলিত। জানতে চাইলাম, কতোক্ষণ লাগবে ওদের? জেলেরা বললো, দশ থেকে পনেরো মিনিট। বললাম, তাহলে তো অনেক সময় হাতে।

আমাদের প্রথম নৌকাটি নিয়ে আমরা পাশের একটি খালে ঢুকে পড়লাম। একটু আড়াল করে বসে থাকবো। এর মধ্যে চুলা জ্বালানো হলো। চায়ের পানি তুললেন সরদার।

ট্রলারের শব্দ কাছাকাছি। নৌকা বহরের কাছে এসে ইঞ্জিন থামলো। জঙ্গলের ভেতর থেকে ওদের কথোপকথন শুনছি। বনরক্ষীরা বেশ রুষ্ঠ। আসার সময় বড় খালে আমাদের ট্রলার দেখেছেন তাঁরা। বেশ রেগে আছেন।

জেলেদের কাছ থেকে মাছ নিয়ে বনরক্ষীরা রওনা দিলেন। একটু দুশ্চিন্তা হচ্ছে। আমাদের ট্রলারে গিয়ে আবার ঝামেলা না করে! সরদারকে বললাম, দ্রুত তৈরি হন। তাড়াতাড়ি ট্রলারে যেতে হবে।

বন বিভাগের ট্রলারটি ছোটখাটো। তবে চলে বিকট শব্দে। এই দূর সুন্দরবনে কেন যে এতো ছোট ট্রলার দেয়! নীল কমল ফরেস্ট অফিসের দুই দিকে দুটি বড় নদীর মোহনা। পশুর ও আড়পাঙ্গাসিয়া নদীর মোহনা বেশ প্রশস্ত।

আমাদের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। এই অঞ্চলে বড় ট্রলার বা স্পিটবোট ছাড়া চলাফেরা করা মুশকিল। ভাবি, উপযুক্ত নৌযান না থাকলে চোরদের কেমন করে তাড়া করবে তারা? জ্বালানী তেলের বরাদ্দ নিয়েও অনেক সমস্যা এই বিভাগে।

এমনিতে বনরক্ষীদের সাথে আমার সম্পর্ক বেশ ভালো। কিন্তু আজ উনারা আমাদের তাড়া দিচ্ছেন। টহলে থাকা কারও সাথে দেখা হয়নি। আমাদের নিয়ে বনরক্ষীদের কাছে কী তথ্য দিয়েছে মহাজনেরা তা বুঝতে পারছি না।

ওদের ট্রলার আমাদের ট্রলারের দিকে যাচ্ছে ভাই। বেলায়েত সরদার বললেন, বালির গাঙ খাল ধরে ওরা মনে হয় আড়পাঙ্গাসিয়ায় যাচ্ছে। এক জেলে বললো, কলাতলা, বৈন্দে, চান্দাবুনিয়া ঘুরে ওরা আবার নীল কমল ফরেস্ট অফিসে ফিরবে। জেলেদের কাছ থেকে ঘুরে ঘুরে তারা খাওয়ার মাছ নিবে।

সরু খাল থেকে বের হলাম। বললাম, খাওয়ার মাছ কতোগুলো লাগে? ওরা বললো, খাওয়ার মাছ আর ডিউটির টাকা সব সময় দিতে হয়। ফরেস্টাররাও নেয়, ডাকাতরাও নেয়। কাউকে ছাড় দেয় না। কারও দয়া হলে বড় মাছ নেয় না। কিন্তু সেরকম মানুষ খুব কম। বেশির ভাগই বড় মাছে টান দেয়।

আমরাও টান দিলাম। মাছ না, আমাদের নৌকা। সোজা যাবো ট্রলারের কাছে। মনে হয় বনরক্ষীদের ট্রলার এখন আমাদের ট্রলারের কাছে। জোরে জোরে নৌকা বাইছে জেলেরা। একজন বললো,
এখানকার সব জেলের কাছ থেকে প্রতিদিন খাওয়ার মাছ নেয় স্যারেরা। কিছু বলার নাই। মজা করে বললাম, আজ আমরা তাদের কাছ থেকে খাওয়ার মাছ নিবো!

বালির গাঙ-এ বের হলাম। কুয়াশা কেটে গেছে। সূর্য উঠেছে। রোদে ঝলমল করছে চারপাশ। পশ্চিমে বেয়ে গেলাম। এক বাঁক ঘুরতেই একটু দূরে আমাদের ট্রলার নজরে আসলো। পাশে বন বিভাগের ট্রলার।

নৌকা নিয়ে গিয়ে ভিড়লাম ট্রলারের গায়ে। বনরক্ষীরা আমাদের ট্রলারে দাঁড়ানো। একজন বেশ হম্বিতম্বি করছেন। ট্রলারের সহযোগীদের একজনের গায়ে একজন লাঠি দিয়ে ভয় দেখাচ্ছেন। দুইজন ট্রলারের ভেতরে চেক করছেন। অবৈধ কিছু আছে কী না দেখছেন। দেখে মনটা বেশ খারাপ হলো।

সালাম দিলাম। উত্তর দিলেন না কেউ। জানতে চাইলেন, ট্রলার কার? সরদার বললেন, আমার। ওরা ট্রলারের বৈধতার কাগজ পত্র চাইলেন। সরদার বের করে দেখালেন। তারপর উনারা বললেন, কাগজ ঠিক থাকলেও আপনারা নিয়ম ভেঙ্গেছেন। এজন্য ট্রলার মালিককে কঠিন শাস্তি পেতে হবে।

বললাম, শাস্তি যা দেওয়ার আমাকে দেন। উনারা বললেন, ভোর রাতে আপনাদের চলে যেতে বলছি। বললাম, আমরা খালপাটা জেলেদের মাছ ধরা দেখতে আসছি। একজন বললেন, আপনার সে অনুমতি নাই।

ট্রলারে উঠলাম। হাতে পায়ে কাদা। সেগুলো পরিস্কার করতে করতে মামুনকে চা উঠাতে বললাম। মেহমানদের বিস্কিট আর চা দিতে বললাম। উনারা না করলেন। এদিকে ট্রলার চেক করা শেষ করে দুইজন ফরেস্ট গার্ড বের হয়ে আসলেন। বললেন, কিছু মাছ ছাড়া আর কিছু নাই স্যার। সেই স্যার বললেন, আরও ভালো করে চেক করো।

মাথাটা একটু গরম হলো এবার। বললাম, এবার আপনাদের ট্রলার চেক করেন। অবাক হয়ে তাকালো সবাই। বললাম, আপনাদের ট্রলারে এতো মাছ কেন? আপনারা কি জাল ফেলেছেন? এই অভয়াশ্রমে জেলেরা মাছ ধরে কী করে? কোনো খাল তো জেলে আর জাল ছাড়া দেখলাম না। ওরা কাদের কতো টাকা দিয়ে এখানে মাছ ধরে? বনরক্ষীরা এবার একটু বিচলিত। বললাম, অবৈধ জাল, অবৈধ জেলে, অভয়াশ্রমে আসে কী করে? আপনারা তাদের ধরেন না। মহাজনেরা কার সাথে চুক্তি করে, কতো টাকা দেয় জানি আমি।

বেলায়েত সরদার বললেন, আমার নামে মামলা দেন। অনেক বড় অপরাধ করেছি। আমাদের ধরতে এসেছেন, ধরেন। এতো কথা বলে লাভ আছে? উনারা বললেন, এখনই আপনারা বের হয়ে যান। তা না হলে অ্যারেস্ট করতে বাধ্য হবো। অবশ্য গলায় এখন আর অতো জোর নাই। বললাম, আমি একটা কাজ করছি আপনাদের এই সৃন্দরবনে। আপনারা অসহযোগিতা করলে, সেই কাজ শেষ করবো কী করে?

কোনো উত্তর নাই। উনারা সবাই ট্রলারে ফিরলেন। বললাম, যাবেন না। এক কাপ চা খেয়ে যান। বেশ বিরক্ত আমার ওপর। রেগেও আছেন স্যারেরা। ট্রলার চালিয়ে বিদায় নিলেন তাঁরা।

বনরক্ষীদের ট্রলার চলে গেলো চোখের আড়ালে। শব্দও মিলিয়ে গেলো। ওরা আড়পাঙ্গাসিয়া নদী ধরে দক্ষিণে নেমে গেলেন। ট্রলারে অবৈধ কিছু ছিলো না বলে বেঁচে গেছি। সরদার বললেন, আমার ট্রলার এখন একদম ক্লিয়ার থাকে ভাই। নিয়ম কানুন ভাঙ্গি শুধু আপনি যখন আসেন। বললাম, ডাকাত দলগুলোর কাছে তো নিয়ম কানুন মেনে যাওয়া সম্ভব না।

বেলায়েত সরদার বললেন, তাহলে কী করবো আমরা? চলে যাবো? বললাম, আজ যাওয়ার ইচ্ছা ছিলো। কিন্তু ওই স্যারদের কাজকর্ম না দেখে আর যেতে ইচ্ছা করছে না। ট্রলারে বাজার সদা আছে তো? মামুন বললো, আরও সাতদিন চলবে ভাই। বললাম, তাহলে আরও কয়দিন থাকি এদিকে, কী বলো?

(নভেম্বর ২০১৬, সুন্দরবন)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top