রূপান্তরের গল্প ৩১ | Rupantorer Golpo 31

ফিরেছি দস্যুদলের আত্মসমর্পনের প্রস্তাব নিয়ে | রূপান্তরের গল্প ৩১

ফিরেছি দস্যুদলের আত্মসমর্পনের প্রস্তাব নিয়ে | রূপান্তরের গল্প ৩১ | Rupantorer Golpo 31 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ৩১ : সুন্দরবনে দীর্ঘ এক সফর গেলো। শুধু দীর্ঘ না, ঘটনাবহুল সময় ছিলো। শুধু ঘটনাবহুল না, দুর্ঘটনাবহুল সফর পার করেছিলাম সেবার। দস্যুদল আর কোস্টগার্ডের মধ্যকার গোলাগুলির ভিতর থেকে জীবন নিয়ে ফিরেছিলাম। সঙ্গে ছিলো একগুচ্ছ অভিজ্ঞতা আর জলদস্যু বাহিনীর আত্মসমর্পণের আবেদন। সুন্দরবনের সবচেয়ে বড় দস্যুদল আত্মসমর্পণ করতে চায়। ক্যামেরায় সাক্ষাতকার আর লিখিত আবেদনের মধ্য দিয়ে সেই যাত্রার শুরু।

পরিচয় গোপন করে রাস মেলার দর্শনার্থী সেজে দুবলার চরে গেছি। মেলা শেষে গোপনে লুকিয়ে থেকেছি চারদিন। তারপর পশ্চিম সুন্দরবনে দেখা করেছি সে সময়ের সবচেয়ে বড় দস্যুদল মাস্টার বাহিনীর সঙ্গে। ঝাইলোর খালে পড়েছি গোলাগুলির মধ্যে। তারপর পথ ভুলে উল্টো দিকে গেছি। আবার ফিরেছিও লোকালয়ে।

মংলার একটু হোটেলে রাত কাটালাম। সহযাত্রী বেলায়েত সরদার, ফারুক ভাই আর সুজনকে বিদায় দিয়েছি রাতেই। সকাল সকাল উঠে পড়লাম। ফোন দিলাম কোস্টগার্ড এর পশ্চিম জোন এর কমান্ডার ক্যাপ্টেন মেহেদী মাসুদকে। বললাম দেখা করতে চাই, একটি সাক্ষাতকারও নিতে চাই।

সুন্দরবনের জলদস্যু বনদস্যুদের দমনে তখন একটি বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। RAB মহাপরিচালককে প্রধান করে সেই টাস্কফোর্স কাজ করছিলো। তখনকার জোরদার আভিযানিক কর্মকান্ডে কোণঠাসা দস্যুরা। যৌক্তিক কারণেই দস্যুদের আত্মসমর্পণের আবেদন নিয়ে আমার RAB এর সঙ্গে যোগাযোগ করার কথা। কিন্তু আমার বিষয়ে তাঁদের মনোভাব তখনও নেতিবাচক। চরম পর্যায়ের নেতিবাচক বললে অত্যুক্তি হবে না। তাই কোস্টগার্ড এর সঙ্গে প্রথমে আলাপ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। ২০১৫ সালের নভেম্বরের শেষ সপ্তাহের কথা।

আমার সঙ্গে আছেন ভিডিওগ্রাফার বায়েজিদ ইসলাম পলিন, সাতক্ষীরার আহাসান রাজীব। মংলায় তখনও মানসম্মত খাবারের রেস্তোঁরা ছিলো না। তাই চা বিস্কিট খেয়ে রওনা হলাম। পথে পড়বে দিগরাজ। সেখানে কোস্টগার্ড পশ্চিম জোন এর সদর দপ্তর।

ঢুকে পড়লাম। আগে থেকে কথা বলা ছিলো বলে গাড়ি নিয়ে সরাসরি ঢুকে পড়লাম। জোনাল কমান্ডারের দফতরটি তখন নতুন, ঝকঝকে। আমরা সেখানে বেমানান। কারণ আমাদের পরনে তখনও সেই ছেঁড়া জামা কাপড়। সবাই অবাক দৃষ্টিতে তাকানো।

কোস্টগার্ড এর জোনাল কমান্ডারের অফিসে ঢুকলাম। আমার কাপড়চোপড় দেখে তিনিও অবাক। জিজ্ঞেস করার আগেই বললাম, “আপনাদের গোলাগুলির মধ্যে পড়েছিলাম। কোনো রকমে বেঁচে ফিরেছি”। নৌবাহিনী থেকে প্রেষণে আসা ক্যাপ্টেন মেহেদী মাসুদ জিজ্ঞেস করলেন, “ঝাইলোর খালের গোলাগুলিতে? সেখানে আপনিও ছিলেন? যাওয়ার সময় বলেননি কেন? কত বড় একটা দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারতো”! বললাম, যা গেছে গেছে। বেঁচে ফিরেছি। এখন কাজের কথায় আসি।

আদ্যোপান্ত জানালাম তাঁকে। তারপর ইন্টারভিউ নিলাম। দস্যুদের আত্মসমর্পণের প্রস্তাব তাঁর হাতে তুলে দিয়ে বিদায় নিলাম। সেদিনই ঢাকা ফিরবো। বিশ্রাম নিতে হবে। তারপর সময় সুযোগ মিলিয়ে সংবাদটি প্রচার করবো। আমি তখন সংবাদ ভিত্তিক টেলিভিশন- যমুনা টেলিভিশনে কাজ করি। এখনও সেখানেই আছি।

চলতি পথে ফোন আসলো জঙ্গল থেকে। মাস্টার বাহিনী জায়গা বদল করে আরও গভীরে চলে গেছে গত রাতেই। সোহাগ আকনের সঙ্গে দীর্ঘ সময় কথা হলো। বুঝতে চেষ্টা করলাম যে তারা এখনও আগের চিন্তাতেই আছে কী না! আমাকে কোনো ভাবে সন্দেহ করছে কী না! মনের মধ্যে নানা সংশয় চলতে থাকলো। জিজ্ঞেস করলাম দস্যুদলের সবাই দলে ফিরেছে? জানলাম, গালকাটা রবিউল নিরুদ্দেশ। তার কাছে আছে একটি দোনলা বন্দুক আর দুইশ’ রাউন্ড গুলি। কয়েকজন অপহৃত জেলেও নিখোঁজ!!!

(ছবিতে আত্মসমর্পণের লিখিত প্রস্তাব আমার হাতে তুলে দিচ্ছেন সোহাগ আকন। দলের প্রধান কাদের মাস্টার হলেও সোহাগই নিতেন সিদ্ধান্ত)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top