মন খারাপ করা এক বেলা | রূপান্তরের গল্প ৩১০ | Rupantorer Golpo 310 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ৩১০ : ট্রলারের সহযাত্রীদের মন বেশ খারাপ। একদম দমে গেছে সবাই। দস্যুমুক্ত সুন্দরবনের এই যাত্রায় এমন প্রতিবন্ধকতা আশা করা যায় না। ভাবছি, বনরক্ষীরা আমাকে এতো অসম্মান করলো? কেউ মেনে নিতে পারছে না। আমি হাসছি। কারণ জানি এই পথ অনেক কঠিন। মৌচাকে ঢিল পড়েছে।
ভয়ের রাজ্যে ভয়ের ব্যবসায় বড় ধাক্কা দিয়ে ফেলেছি। শুরুতে সুন্দরবনের সিন্ডিকেট ভেবেছিলো এই সাংবাদিক বেশি দিন থাকবে না। আমি যেন সুন্দরবনে না আসি সেজন্য অনেক কিছুই করেছে তারা। আমি না থামলে সামনে আরও কিছু করবে।
প্রথমে তারা আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করেছে। বলতো, ঢাকার সাংবাদিক সুন্দরবনে আর কয়দিন টিকবে? তারপর যখন বনদস্যুদের আত্মসমর্পণের প্রস্তাব নিয়ে আসলাম, তখন বললো বড় অংকের লেনদেন হয়েছে। তারপর প্রথম দস্যুদল আত্মসমর্পণ করলো। তারা বললো, দুই কোটি টাকার ডিল ছিলো, এখানেই শেষ। সাংবাদিক এবার ঘরে ফিরবে।
এরপর একে একে আটটি দস্যুদল সারেন্ডার করলো। সিন্ডিকেটের লোকজন নড়েচড়ে বসলো। দুবলা থেকে খুলনা, সাতক্ষীরা থেকে বরিশালের কিছু মানুষ বলতে লাগলো, বনদস্যুদের নিয়ে সাংবাদিকের বিরাট ব্যবসা চলছে। স্থানীয় পুলিশ থেকে সাংবাদিক, কিছু মাছ ব্যবসায়ী কটুকথা ছড়ানো শুরু করলো।
কথাগুলো ঘুরে বেড়ালো ঢাকা শহরের দফতরে দফতরে। খবর পেলাম আমাকে নিয়ে একটি সংস্থা বেশ খোঁজ খবর নিচ্ছে। ঢাকার উত্তরায় আমার অ্যাপার্টমেন্ট আর একাধিক গাড়ির খবর তখন বেশ চলছিলো। কানাঘুষা চললেও কেউ আমার কোনো সম্পদ খুঁজে পাচ্ছে না। কঠিন পথে প্রতিবন্ধকতা থাকবেই। অনেকে বিরোধীতা করবে। কিন্তু বনরক্ষীদের অসহযোগিতা বেশ ভাবাচ্ছে আমায়।
ভাবছি, সহযাত্রীদের মন খারাপ করা ভাবটা কাটাতে হবে। কী করা যায়? বেলায়েত সরদারও একটু মন খারাপ করে বসে আছেন। রান্না চলছে ট্রলারের রান্নাঘরে। সরদার বললেন, সবাই একটু গোসল করে নেন। গায়ে, পায়ে আর কাপড়ের কাদাগুলো ধুয়ে ফেলেন। শুকিয়ে গেলে এই কাদা কিন্তু আর পরিস্কার হবে না। উঠে বসলাম। সরদার বললেন, এই কাদার নাম জানেন? এর নাম প্রেম কাদা। গায়ে-কাপড়ে লাগলে আর উঠতে চায় না।
ট্রলারের গলুই-এ চলে গেলাম। জোয়ারে সাগর থেকে নতুন পানি ঢুকেছে খালে। বেশ পরিস্কার। আমরা খালের পানি তুলে গোসল করবো। সুন্দরবনের এদিকটা সাগরের সাথে লাগানো। পানি বেশ লবণাক্ত। তারপরও এই পানিতেই গোসল করা ছাড়া আপাতত উপায় নাই। এই পানিতে সাবান কাজ করে না। শুধু এক প্রকারের শ্যাম্পুর ফেনা হয়। মামুন এসে কয়েকটি মিনিপ্যাক শ্যাম্পু দিলো। এরপর বালতি দিয়ে খালের পানি তুলে দিলো গোসলের জন্য।
খালের পানি দিয়ে সবাই গোসল সারলাম। কিন্তু কেমন জানি অস্বস্তি লাগছে। লবণ পানির কারণে মনে হয় চামড়া পুড়ে যাচ্ছে। সেই সাথে রোদ লেগে চুলগুলোও চটচট করছে।
ট্রলারের পেছনের দিকে রাখা ড্রাম থেকে এক বালতি পুকুরের পানি এনে মাথায় ঢেলে দিলো। এরপর কাদায় ভরা জামা কাপড় ভালো করে ধুয়ে নিলাম, শুকাতে দিলাম। রোদ থাকলে সুন্দরবনে বা সাগরে ভেজা কাপড় শুকাতে সময় লাগে না। ট্রলার বা নৌকার ছইয়ের সাথে শক্ত করে বেঁধে রাখলে আধা ঘন্টার মধ্যেই শুকিয়ে যায় ভেজা লুঙ্গি বা গামছা।
এদিকে লবণাক্ততা বিরাট এক সমস্যার নাম। বর্ষা কাল ছাড়া বাকী সময় সুন্দরবনের সবকিছুই থাকে লবণাক্ত। খাওয়ার পানি আমরা লোকালয় থেকে নিয়ে আসি। রান্নার জন্য ব্যবহার করি পুকুরের পানি। লোকালয় থেকে আনার পর যদি আরও প্রয়োজন হয় তবে ড্রামে করে বনের ভেতরের বিভিন্ন পুকুর থেকে পানি আনা হয়। সেজন্য অবশ্য সুন্দরবনের কোথায় কোথায় মিঠা পানির পুকুর আছে তা জানতে হয়। দীর্ঘদিন ঘুরতে ঘুরতে এটা জানা হয়েছে।
মামুন জানালো, আমাদের রান্নার পানি শেষের দিকে। শেষ ড্রামের তলানীতে চলে এসেছে পানি। তাই আমাদের প্রথম কাজ হবে পানি সংগ্রহ। আবারও পানি ভরানোর আগ পর্যন্ত ড্রামের পানি ব্যবহার আপাতত নিষেধ। পানি যা আছে তাতে রাতের রান্না হবে। কিন্তু সকালের জন্য নতুন করে পানি তুলতে হবে।
আমরা আছি বালির গাঙ-এ। পশ্চিমে আড়পাঙ্গাসিয়া নদী। তার পশ্চিমে দুটি খাল ঢুকে গেছে। বড়টির নাম বেহালা। আর সেই খালের মুখ থেকে উত্তরে যে মাঝারি খালটি গেছে তার নাম কয়লা।
বেহালার দক্ষিণের জঙ্গলের নাম মান্দারবাড়িয়া। খালের শুরুতেই দক্ষিণে জঙ্গলের ভেতর একটি পুকুর আছে। বাঘ ও বন্যপ্রাণিদের পানি খাওয়ার জন্য পুকুরটি করেছে বন বিভাগ। এদিকের জেলেরা, সাগরের জেলেরা মাঝে মাঝে এখানে আসে, খাওয়ার পানি নিয়ে আবার ফিরে যায়। ওদিকে আরেকটি পুকুর আছে, মান্দারবাড়িয়ার পরিত্যাক্ত ফরেস্ট অফিসের সামনে।
গোসল সেরে রোদে বসলাম। রান্না বান্না শেষ করে সরদারসহ অন্যরা গোসল করে নিলো। আমরা এই জোয়ারেই বড় নদীতে যাবো। তাই ট্রলারের তলার ফাটা অংশটা ঠিকঠাক আছে কী না দেখে নিলো একজন। আরেকজন ইঞ্জিনের মবিল আর ডিজেল চেক করলো। খালে নেমে গোসল করার সময় প্রোপেলার ঠিকঠাক আছে কী না তা দেখে নিলেন বেলায়েত সরদার।
সবার গোসল শেষ হলো। ট্রলারের সামনের দিকে ভাত-তরকারি নিয়ে বসে পড়লাম। সবাই মিলে দুপুরের খাওয়া সেরে নিবো। তারপর পাড়ি দিবো বড় নদী-আড়পাঙ্গাসিয়া। এদিকের নদী-সাগর বেশ ঝামেলার। বেশি উত্তাল থাকলে পুতনীর দ্বীপে যাত্রা বিরতি নিবো। পরিস্থিতি ঠান্ডা থাকলে চলে যাবো বেহালা হয়ে মান্দারবাড়িয়া।
দুপুর গড়িয়ে গেলো। জোয়ারের পানি প্রায় জঙ্গল ছুঁই ছুঁই অবস্থায়। তার মানে আর বেশি হলে ঘন্টা খানেক জোয়ার আছে। শেষ জোয়ার বা শেষ ভাটায় নদী-সাগরের পানির স্রোত নরম হয়ে আসে। এসময় বড় নদীর মোহনাগুলোতে চলাফেরা করা সহজ। তবে একটু উল্টাপাল্টা বাতাস হলে বিশাল বিশাল রোলিং-এর মধ্যে পড়তে হয়।
দুপুরের খাবার শেষে চা খেলাম। দুধ চায়ের দুধ আর বেশি নাই। তাই সাশ্রয়ী হতে বললাম। ওদিকে গেলে কিছুই পাবো না। পশ্চিম সুন্দরবনের এদিকটা অভয়াশ্রম। বনদস্যুদের সাথে দেখা হওয়া ছাড়া আপাতত আর কারও সাথে দেখা হওয়ার সুযোগ কম। বেলায়েত সরদার বললেন, দেখা হবে না মানে? অভয়াশ্রমের ওই দিকে তো আরও বেশি জেলে থাকে। এখন মরা গোন শুরু হবে। দেখবেন ফাঁস জাল, বড়শি আর কাঁকড়ার জেলেদের অভাব নাই।
রওনা দেওয়ার আগে সবাই বিশ্রামে পাঠালাম। আমি বসলাম বড়শি নিয়ে। বরফের বাক্স থেকে চিংড়ি মাছ বের করে আনলো মামুন। এখানে পানি আছে না হলেও পঞ্চাশ ফুট। জোয়ারের স্রোত কম থাকায় এখন মাছ পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
আধার গেঁথে বড়শি ফেললাম। নিচের কাদায় পড়তে পড়তেই মাছ দিলো টান। হেঁচকা টান দিয়ে তুলে আনলাম বেশ বড় সাইজের গাঙ টেংড়া। একের পর এক মাছ তুলতে তুলতে হয়রান হয়ে গেলাম। ঘন্টা খানেকের মধ্যে না হলেও ত্রিশটি মাছ ধরে ফেললাম। সবগুলোই গাঙ টেংড়া বা ঘাগড়া টেংড়া।
পাশের একটি ছোট খাল থেকে দুটি জেলে নৌকা বের হলো। রওনা দিলো পূর্ব দিকে, মানে আমাদের বিপরীত দিকে। সম্ভবত আমাদের কারণে এতোক্ষণ বের হয়নি ওরা। কিন্তু এখন সম্ভবত আর দেরি করলে চলবে না। মামুন বললো, ওরা কাঁকড়ার জেলে। আমি ডাক দিলাম। কানে নিলো না। এরপর মামুন চিৎকার করে ডাক দিলো ওদের। সাথে কিছু গালিগালাজও ছুড়লো। এবার থামলো ওরা। ইশারা দিয়ে কাছে ডাকলাম। ওরা বৈঠা বেয়ে এগিয়ে এলো।
আপনারা পালাচ্ছেন কেন? মনে হলো আমার এই প্রশ্নের জন্য তারা প্রস্তুত ছিলো না। একটু পরে বুঝলাম, সুন্দরবনের এই মানুষদের কেউ আপনি করে বলে না। সবাই তুই-তোকারি করে। এমনিতেই চোরের মতো থাকে তারা। আতঙ্গে থাকে। তার মধ্যে ডাক দিয়ে আপনি করে কথা বলায় বেশ বিচলিত তারা। ট্রলারের কাছে নৌকা ভিড়লো। বললাম, নৌকা বাঁধেন। চা খেয়ে যান।
জেলেরা বললো, এখন সময় নাই। ভাটা লাগার আগে তাদের চেরাগখালী পৌঁছাতে হবে। তারপর প্রথম ভাটিতে পশুর নদী পাড়ি দিয়ে তারা যাবে দুবলার চরের আগুন জ্বলার মুখে। এই ভাটা সেখানে থাকবে। রাতের জোয়ারে টান দিবে।
ওদের মহাজনের কাঁকড়া টানার ট্রলার রাখা চরাপূঁটিয়া খালে। ফরেস্ট অফিসের সামনে গেলেই দেখা হবে পরিবহনের ট্রলারের সাথে। বললাম, ট্রলার দিয়ে কাঁকড়া টানা তো এখানে নিষেধ! বিস্কুট খেতে খেতে ওরা বললো, এই বাদাবনে নিষেধ বলে কিছু আছে? টাকা দিলে এখানে সবকিছুই বৈধ।
চা খাইয়ে ওদের বিদায় দিলাম। যাওয়ার সময় ওরা বেশ কয়েকটি কাঁকড়া দিলো। বিনিময়ে আমরা দিলাম চাল-ডাল, পানি আর পান-সুপাড়ি। একটু আগে বড়শিতে ধরা মাছগুলোও দিয়ে দিলাম। মহা খুশি হয়ে ওরা রওনা দিলো। লম্বা পথ পাড়ি দিতে হবে। অবশ্য পুরোটা পথই তারা স্রোতের সাথে সাথে যাবে। বেশি কষ্ট হবে না, সময়ও লাগবে না।
বাঁক ঘুরতেই চোখের আড়ালে চলে গেলো জেলেদের নৌকা। ট্রলারের সবাই ঘুম। আপাতত বাতাস আর পাখির শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নাই। চারপাশটা থমথমে। শেষ জোয়ারের পানি যেন দম মেরে গেছে। কিছুক্ষণ এভাবে স্থির থাকবে পানি। তারপর ভাটা হলেও স্রোত ঘুরে যাবে উল্টো দিকে। ভাটার পানি নামবে খাল থেকে নদী হয়ে বঙ্গোপসাগরে।
একটু পর আমরা রওনা হবো। সন্ধ্যা নামার আগে কোনো একটি জায়গায় গিয়ে নোঙ্গর করবো।
(সুন্দরবন, নভেম্বর ২০১৬)