রূপান্তরের গল্প ৩১২ | Rupantorer Golpo 312

দ্বীপচরের গান ফাইট | রূপান্তরের গল্প ৩১২

দ্বীপচরের গান ফাইট | রূপান্তরের গল্প ৩১২ | Rupantorer Golpo 312 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ৩১২ : হুম হুম করে ডেকে চললো বাঘ। বুঝতে পারছি খুব কাছে সে। কিন্তু ঠিক কোন দিকে সেটা বুঝতে পারছি না। পর পর কয়েক বার ডাক দিলো মামা। কিন্তু কিছুতেই তার অবস্থানের দিকটা বুঝতে পারলাম না। শুধু এটুকু বুঝলাম, মাটি ফুঁড়ে বের হচ্ছে ভয়ঙ্কর শব্দ। মনে হলো মাটি শুদ্ধো সবকিছু থরথর করে কেঁপে উঠেছে!

বাঘের ডাকের পর চারপাশ স্তব্ধ হয়ে আছে। পাখির ডাকাডাকি বন্ধ। কিছুক্ষণ আগে বন মোরগের ডাকাডাকি ছিলো। সেটিও বন্ধ। বাতাসের সাথে শুধু ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শুনছি। হরিণ আর বানরেরা কোথায় হারিয়েছে কে জানে!

আমরা কি এই খালেই থাকবো? সরদার বললেন, এখানে থাকলে এমনিতে সমস্যা নাই। তবে মামা যেহেতু পাশেই আছে, এই জায়গা ছেড়ে দেওয়া ভালো। যদি মাদী বাঘ হয় তবে সে এখানেআ থাকবে। কারণ এই ডাক শুনে মর্দা বাঘ এখানেই আসবে। এখন ওদের প্রজণন মৌসুম, ডিস্টার্ব করা ঠিক হবে না।

আমাদের রান্না বান্নার আয়োজন বন্ধ। কী করবো, কোথায় যাবো সেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে আগে। তারপর ট্রলারসহ জায়গায় পৌঁছে আবার শুরু হবে রান্নার কাজ। সরদারকে নিয়ে বসলাম। উনি বললেন, বড় খালে উঠে আবার পূর্ব দিকে যাবো। মানে যেদিক থেকে এসেছি, সেদিকেই। কিন্তু আমি আর ওদিকে ফিরতে চাই না।

ট্রলার চালু হলো। সরু খাল থেকে বেরিয়ে পড়লাম বালির গাঙ-এ। সুকানিতে আমি দাঁড়ানো। পাশে বসা বেলায়েত সরদার। এর মধ্যে বাতাসের চাপ কমে এসেছে। বড় নদীর দিকে ট্রলারের মুখ ঘোরালাম। সরদার কিছু বলতে যাচ্ছেন। তার আগেই বললাম, একটু বড় নদীটা দেখে আসি।

হাল্কা উত্তরা বাতাস। ভাটা চলছে। স্রোত আর বাতাস এক তালে চলছে। এতো বড় নদীর মোহনাটিকে মনে হচ্ছে পুকুরের মতো ঠান্ডা। দুজনের মধ্যে চোখাচোখি হলো। সরদার বুঝে গেছেন, আড়পাঙ্গাসিয়া নদী পাড়ি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। চিৎকার করে মামুনকে সামনে যেতে বললেন তিনি।

বড় নদীতে নামার আগে কিছু প্রস্তুতি লাগে। ট্রলারের জিনিষ-পত্র গুছিয়ে ফেলতে হয়। বিশেষ করে সামনে পেছনে রাখা নোঙ্গর আর দড়ি গুছিয়ে ফেললো মামুন। শহীদুল কাকু ঘুরে ঘুরে কাপড় আর বাসনপত্র গুছিয়ে রাখলেন।

শক্ত হাতে হাল ধরলাম। গিয়ার দিয়ে গতি বাড়ালাম। এক টানে এই নদী পার হতে সময় লাগে প্রায় দুই ঘন্টা। কারণ মাঝখানে একটি দ্বীপ আছে যার নাম পুতনীর দ্বীপ। জেলেরা কেউ বলে দ্বীপচর, কেউ চিনে বিবির মাইধে নামে।

মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, পরের গন্তব্য পুতনীর দ্বীপ। কারণ বড় নদী পার হতে হতে অন্ধকার নেমে যাবে। হঠাৎ বাতাস বাড়লে রাতের বেলা সামাল দিতে পারবো না। সরদারের কথাটা মনে পড়লো। ভাটার সময় এই মোহনায় ট্রলার ডুবলে কুলে ফিরতে পারবো না।

পুতনীর দ্বীপে বিরতি নিবো আজ। সে পর্যন্ত যেতে সময় লাগবে ঘন্টা খানেক। দ্রুত টানতে হবে কারণ সোজা গিয়ে দ্বীপে ঢুকতে পারবো না। এদিকটা ঘন জঙ্গল। দ্বীপের পশ্চিম পাশে মানে বিপরীত দিকে একটি ছোট্ট খাল আছে। আমরা সেই খাল ধরে দ্বীপে উঠবো। কিন্তু ভাটার যে অবস্থা তাতে ওই খালে উঠতে পারবো কী না জানি না। অর্ধেক ভাটার আগেই খালের মুখ জেগে ওঠে।

দ্বীপের উত্তর দিক দিয়ে ঘুরে পশ্চিম পাশে গেলাম। ততোক্ষণে অন্ধকার নেমে গেছে। দ্বীপের তীর ধরে ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে হবে। সুকানি দিলাম সরদারের হাতে। এখন দক্ষ হাতে ট্রলার চালাতে না পারলে ঝামেলা হতে পারে।

খালের মুখে এসে ট্রলারের মুখ ঘুরিয়ে খালে ওঠার চেষ্টা করলেন সরদার। কিন্তু ততোক্ষণে পানি কমে এসেছে। বেশ কয়েক বার চেষ্টা চললো। গলুই থেকে পানিতে নামলো মামুন। চিৎকার করে জানালো, সম্ভব না।

কী করবো এখন? সরদার বললেন, নদীর পশ্চিম পাড়ে যাবেন? মানে বেহালা-কয়লার ওদিকে? বললাম, ঝুঁকি নিবো না ভাই। যদি বড় ঝড় না আসে তবে এখানেই নোঙ্গর করেন। সরদার বললেন, এখানে পানি আছে একশ হাতের ওপর। নোঙ্গরের দড়ি তো এতো বড় না! বললাম, বিকল্প কিছু করা যায় না? কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করে উনি বললেন, কিছু একটা তো করা যাবেই!

আমার হাতে সুকানি অর্থাৎ হালটি ধরিয়ে দিয়ে সামনে চলে গেলেন সরদার। দ্বীপটির খালের মুখে হাঁটু পানিতে মামুন তখনও দাঁড়ানো। লোহার নোঙ্গর তুলে তার হাতে দিলেন সরদার। নোঙ্গর নিয়ে দ্বীপের চরে গেঁথে দিলো মামুন। তারপর ব্যাক গিয়ার দিয়ে ট্রলার নামানো হলো নদীতে। এভাবেই এই রাত ভাসবো আমরা। আবহাওয়া খারাপ হলে চরে গিয়ে উঠবো।

এই দ্বীপে মানুষ থাকার কথা না। তবে দূর থেকে কিছু আলোর নড়াচড়া দেখছি। সম্ভবত কাঁকড়ার জেলেরা আছে। এই দ্বীপে হরিণ শিকারীরাও মাঝে মাঝে আসে। আগে দস্যুদলের আসা যাওয়া ছিলো। কিন্তু একটি ঘটনার পর পুতনীর দ্বীপে ওঠে না তারা।

বেলায়েত সরদার বললেন, এই দ্বীপে একবার বিরাট গোলাগুলি হলো ভাই। কয়েক বছর আগে। কিন্তু কার সাথে কার বন্দুক যুদ্ধ হলো জারা নাই। বললাম, আমার জানা আছে। গোলাগুলি হয় মোতালেব বাহিনী আর রাজু বাহিনীর মধ্যে। সরদার বললেন, গল্পটা শুনি তো ভাই! বললাম, এক কাপ চা না হলে গল্প জমে?

চা উঠলো চুলায়। উত্তরা বাতাসের সাথে একটু একটু দুলছি আমরা। ঠান্ডা বাতাসে কাঁপন ধরে গেছে। এক কাপ চা না খেলে শীত লাগাটা কমবে না। এবার ঘটনা যা শুনেছি তা বলতে শুরু করলাম।

২০০৭ বা ২০০৮ সালের ঘটনা। তখন পশ্চিম সুন্দরবনের রাজা ছিলো মোতালেব বাহিনী। রাজু বাহিনী শাসন করতো মধ্যাঞ্চল। পূর্ব সুন্দরবন ছিলো জুলফু বাহিনীর দখলে। আরও কিছু দস্যুদল ছিলো তারা ছোট ছোট জায়গায় দস্যুতা করতো।

ইলিশের মৌসুম। পুতনীর দ্বীপ তখন বিকাশ বাবু নামের এক মাছ ব্যবসায়ীর দখলে। বড় দস্যু দলগুলোর সাথে সমঝোতা করে এই অঞ্চলে ইলিশ ধরতো তার জেলেরা। মাঝে মাঝে দস্যুদলগুলো তার আস্তানায় গিয়ে বিশ্রাম নিতো। সেবার সাগরে দস্যুতা করতে যাওয়ার সময় ঝড় ওঠে। সাগর থেকে ফিরে আসে মোতালেবের ট্রলার। রাতে পুতনীর দ্বীপে আশ্রয় নেয় তারা। বিকাশ বাবুর এক জেলে এই খবর জানিয়ে দেয় রাজু বাহিনীকে।

ওই রাতে ভরা জোয়ার ছিলো। তাই ট্রলার দ্বীপের উপর তুলে দেয়। পরিকল্পনা ছিলো, জেলেদের কাছ থেকে ইলিশ মাছ নিয়ে নেমে যাবে। কিন্তু ততোক্ষণে ভাটা হয়ে যায়। আটকা পড়ে মোতালেব বাহিনী। বিকাশ বাবুর এক জেলে রাজু বাহিনীকে খবর দেয়। রাতেই রওনা দেয় সুন্দরবনের দস্যু সম্রাট রাজু। ভোর বেলা আক্রমণ করে বসে। দুই পক্ষের মধ্যে ব্যাপক গোলাগুলি হয়।

ওই সংঘর্ষে অংশ নেওয়া কয়েকজন বনদস্যুর কাছ থেকে ওই বন্দুক যুদ্ধের গল্প শুনেছি। দস্যু জগতে এই বন্দুকযুদ্ধের নাম ছিলো- দ্বীপচরের ফাইট। সংঘর্ষে মোতালেব বাহিনী পরাস্ত হয়। কয়েক জনের মৃত্যু হয়। বাকীরা জঙ্গলের ভেতর পালিয়ে যায়। তখন ভরা জোয়ার। মোতালেবের ট্রলার ও কয়েকটি বন্দুক নিয়ে ফিরে যায় রাজু বাহিনী। সাথে নিয়ে যায় দ্বীপচরে সাময়িক ঘর করে বসবাস করা মাছের কারবারী বিকাশ বাবুকে।

বিকাশ বাবুকে কয়দিন বেঁধে রেখে মারপিট করে রাজু। প্রতিপক্ষ দস্যুদলের সাথে সখ্য থাকায় তাকে বেশ কিছুদিন ধরে রাখে তারা। পরে খুলনার এক বড় ভাইয়ের অনুরোধে ছেড়ে দেয় তাকে।

সরদার বললেন, বিকাশ বাবুকে তো চিনি ভাই। বললাম, আমিও চিনি। এখনও এই দ্বীপের দক্ষিণের জঙ্গলের ভেতর তাদের ঘর পাওয়া যাবে। ওরা বর্ষায় ইলিশ ধরে। শীতকালে ফাঁসজাল ফেলে দ্বীপের চারপাশে। অভয়াশ্রম হলেও এই পুতনীর দ্বীপ সারা বছরই ওই দাদার নিয়ন্ত্রণে থাকে। শুনেছি দস্যু দলের চাঁদা কালেকশনের দায়িত্বও পালন করেন তিনি।

চা খেতে খেতে গল্প চলছে। রাত প্রায় আটটা বাজে। নদীর পানির স্রোত কমে এসেছে। মানে ভাটা শেষের দিকে। শহীদুল কাকুকে নিয়ে রান্নায় বসলেন তিনি। মামুনকে নিয়ে আমি চলে গেলাম গলুইয়ের দিকে। বড়শি নিয়ে বসলাম। শেষ ভাটায় এখানে ভালো মাছ পাওয়া যায়।

(ছবি: পুতনীর দ্বীপ/ দীপচর, সুন্দরবন, নভেম্বর ২০১৬)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top