রূপান্তরের গল্প ৩১৩ | Rupantorer Golpo 313

নিষিদ্ধ দ্বীপে মানুষের দেখা | রূপান্তরের গল্প ৩১৩

নিষিদ্ধ দ্বীপে মানুষের দেখা | রূপান্তরের গল্প ৩১৩ | Rupantorer Golpo 313 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ৩১৩ : কারা জানি হাঁটাচলা করছে। আমাদের বরাবর যে খালটি আছে সেই খালের পাশ দিয়ে হেঁটে আসছে তারা। হাতে ছোট টর্চ। কি যেন কুড়াতে কুড়াতে আসছে। আমরা এখনও আলো জ্বালাইনি। চাঁদ ওঠেনি বলে চারপাশ অন্ধকার। পাশে বসে মামুন ফিসফিস করে বললো, আমাদের দেখতে পায়নি ওরা।

বড়শি হাতে বসে আছি। এই ভাটায় কিছু মাছ ধরবো বড় নদী থেকে। শহীদুল কাকু ট্রলারের খোলের ভেতরে ঢুকেছেন। বরফের বাক্স থেকে চিংড়ি মাছ বের করলেন। বড়শির আধার এই চিংড়ি মাছ। তবে বড়শি ফেলার আগে ওই জেলেদের গতিবিধি দেখতে চাই। সবাইকে চুপচাপ থাকতে বললাম।

ট্রলার ভাসছে নদীতে। ইচ্ছা করেই অন্ধকার করে রেখেছি। যাতে দূর থেকে আমাদের কেউ দেখতে না পায়। চারপাশ বেশ অন্ধকার। কুয়াশাও আছে। যতোক্ষণ চাঁদ না ওঠে ততোক্ষণ আমাদের কেউ দেখতে পাবে না। যখন চাঁদ উঠবে তখন জোয়ার হবে। সেই জোয়ারে আমরা সামনের খাল ধরে ঢুকে পড়বো দীপের উপর। ভিতরে কোনো জায়গায় গিয়ে নিজেদের আড়াল করবো।

লোকগুলো এগিয়ে আসছে। কাছে আসতেই বুঝলাম, কাঁকড়ার দাওন চেক করতে করতে আসছে তারা। তার মানে কাঁকড়ার জেলে। তিনজন পর পর হাঁটছে। গ্যাস লাইটারের সাথে যে ছোট ছোট এলইডি বাতি থাকে সেই আলো দিয়ে কাজ সারছে। দেখতে দেখতে আরও কাছে চলে এলো। এখন হুট করে ডাক দিলে ভয়ে দৌড়ে পালাবে। তাই আরেকটু অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিলাম।

আমরা ভাসছি আড়পাঙ্গাসিয়ার নদীতে। পুতনীর দ্বীপের পশ্চিম পাশে। জেলেরা আমাদের দেখতে পেলো একদম নদীর কাছে এসে। ওরা কিছু বলার আগেই বললাম, ভয়ের কিছু নাই। কারা তোমরা? ওরা থমকে গেলো। মনে হলো এখনই দৌড় দিবে। এর মধ্যে বেলায়েত সরদার কথা বলে উঠলেন। একজনের নাম ধরে ডাক দিলেন। বললেন, আমি বেলায়েত সর্দার।

দাঁড়িয়ে পড়লো ওরা। ওপাশ থেকে একজন বললো, আমাগের বিলায়েত? চিলা বাজারের বিলায়েত? সর্দার বললেন, হয়। তোমরা এখানে করো কী? ওরা এবার একদম নদীর পাড়ে চলে আসলো। জানতে চাইলো, সাথে কারা? এবার আমিও চিনতে পারলাম ওদের। বললাম, আমাকে চিনতে পারোনি? একজন বললো, মোহসীন ভাই?

হুমম। আমি। কী খবর তোমাদের? এবার পরিস্কার চিনতে পারছি। মংলার চিলা বাজারেই বাড়ি ওদের। সুন্দরবনে মাছ-কাঁকড়া ধরে বেড়ায়। এক সময় হরিণ শিকার করতো, গাছ চুরির সাথেও জড়িত ছিলো তারা। জানতে চাইলাম, কী করছো তোমরা? এই দ্বীপে আসলে কী করে? হাসতে হাসতে বললো, এই ঘুরতে ঘুরতে চলে আসছি ভাই। এখানে ভালো কাঁকড়া পাওয়া যায়। বললাম, ট্রলারে আসো। চা খেয়ে যাও।

নোঙরের দড়ি ধরে ট্রলারটিকে টেনে নিলো তারা। তীরের সাথে ভিড়িয়ে এক লাফে উঠে পড়লো। কাঁকড়া ধরার সরঞ্জাম, একটি বস্তা আর একটি ঝুড়ি পাড়ে রেখে উঠে পড়লো। এসময় একজন আবার লাফিয়ে নামলো। বললো, খালের ওইদিকে কাঁকড়া ভর্তি একটি বস্তা রেখে আসছি। সেটা আনতে হবে।

বললাম, থাক না ওখানে। যাওয়ার সময় নিয়েন। জেলেরা বললো, এই দ্বীপে বাঘ নাই। আছে হরিণ, বানর, বন্য শুকর আর সাপ। কাঁকড়ার খবর পেলে শুকরে এসে সব খেয়ে ফেলবে। বানরেরাও কম যায় না। এই দ্বীপের উত্তরে সব গড়ান গাছ। গভীর বন। দক্ষিণে কেওড়ার বন, বাকীটা বালির চর। হরিণ দেখা যায় প্রচুর। বন্য শুকর ঘুরে বেড়ায় মনের মতো করে।

লাফ দিয়ে চরে নেমে হাঁটা দিলো একজন। বাকীরা বসলো পাশে। পায়ে কাদা, কাপড়ে কাদা। বালতি দিয়ে নদী থেকে পানি তুলে ধুয়ে নিলো। মামুনকে চা দিতে বললাম। আধার গেঁথে বড়শি ফেললাম। এখন নদীর পানি একদম ঠান্ডা। স্রোত বলতে কিছুই নাই।

আড়পাঙ্গাসিয়া নদীটির সেভাবে পরিচিতি নাই। এদিকটা অভয়াশ্রম। সাধারণ পর্যটকদের আনাগোণা নাই। সাতক্ষীরা থেকে আসা পর্যটকবাহী ট্রলার বা লঞ্চ মাঝে মাঝে আসে। অনুকুল পরিবেশ থাকলে তারা নামে এখানে। তবে একবার যারা এই পুতনীর দ্বীপে এসেছে তারা সুন্দরবনে ঘুরতে গেলে বার বার এই জায়গায় আসে।

সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার শ্রেষ্ঠ জায়গা এটি। আমরা মাঝে মাঝে আসি। চলতি পথে পড়লে এক-দুই দিন থেকে যাই। কখনও নেহায়েত বিশ্রাম নিতে আসি। এক দুই দিন নিরিবিলি কাটাতে বেশ ভালো লাগে। কেওড়ার মৌসুম এখন। জোয়ারে পাকা কেওড়া খেতে বড় নদী থেকে উঠে আসে পাঙ্গাস মাছের ঝাঁক। সামনে বসে ওই মাছের লাফঝাঁপ দেখেছি কয়েক বার। এছাড়া ছোট মাছের ঝাঁকও উঠে এখানে। তাদের ধাওয়া করে ভেটকী জাতীয় মাছ।

বড়শি ও ফাঁস জালের জেলেদের কাছে এই দ্বীপ ভীষণ আকর্ষণীয়। এর উত্তরে প্রায় কুড়ি কিলোমিটারের মধ্যে কিছু নাই। দুই পাশের সুন্দরবনও কম করে হলেও এক ঘন্টার পথ। দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। উত্তরে ঘন্টা দুই এগুলে আরেকটি দ্বীপ আছে, তার নাম কালির চর।

কালির চর বেশ বড়, গভীর, জঙ্গলময়। ওই চরে বাঘের চাপ খুব বেশি। মাঝে মাঝেই নাকী জেলেরা ধাওয়া খায়। সুন্দরবনের এদিকটাতে বেশ ভালো মাছ পাওয়া যায়। তাই মাছ সিন্ডিকেটের হোমড়া চোমড়াদের জেলেরা এখানে মাছ ধরে।

পুতনীর দ্বীপের চারপাশে ফাঁস জালে বড় বড় মাছ হয়। দাওন বড়শিতে ধরা পড়ে মেদ আর মোচন মাছ। দ্বীপের ভিতর একটি লম্বা খাল আছে। এখানে ঝাঁকিজাল দিয়ে বড় বড় দাতিনা মাছ ধরা যায়। পারশের ঝাঁক পড়লে কখনও নৌকা ভরে যায়। চিংড়ি মাছেরও অভাব নাই।

গল্প করতে করতে টান পড়লো বড়শিতে। বেশ ভালো টান। বড় কোনো মাছ পড়েছে মনে হয়। বড়শি টানতে টানতে দাঁড়িয়ে পড়লাম। তারপর এক টানে ছিঁড়ে গেলো সূতা। বেশ মজা পাচ্ছি। এখানে তাহলে বড় মাছ আছে!

কাঁকড়ার জেলেরা বললো, খালের মুখে নদীর এই জায়গাটিতে খাঁড়ি আছে। তাই বড় মাছ সব এখানে এসে থাকে। পানি বেশি বলে ফাঁস জাল ফেললেও এখানকার মাছ জালে আসে না। অভয়াশ্রম বলে এখানে চুরি করে মাছ ধরতে হয়। বনরক্ষীরা ধরলে জেল জরিমানা হয়ে যায়।

বললাম, চুরি করে আর মাছ ধরে কোথায়? সবই তো চলছে খোলামেলা! ওরা বললো, বনদস্যুদের কাছের লোক যারা তারা এখানে সারা বছর থাকে। ফরেস্টের সাথেও তাদের বিরাট সম্পর্ক। এই চরের দক্ষিণ দিকের কেওড়া বনের ভিতর ওদের বাড়িঘরও আছে। জানতে চাইলাম, এখনও কি ঘর আছে? ওরা বললো, সারা বছরই ঘর তুলে ওরা বসবাস করে। এমন কী সাগরে সিগন্যাল পড়লেও এরা জায়গা ছাড়ে না। বর্ষায় এখানে প্রচুর ইলিশ পড়ে। বিকাশ বাবুর ভাই সে সময় ইলিশের জেলেদের নিয়ে এখানেই পড়ে থাকে।

বেলায়েত সর্দারকে বললাম, বিকাশ বাবুর ঘরে যেতে হবে ভাই। সর্দার বললেন, ভোর রাতে জোয়ার আসবে। তখন যাবোনে। আপাতত আপনি মাছ ধরেন। আমি রান্না করি। বললাম, মাছে তো বড়শি ছিঁড়ে নিয়ে গেছে। এছাড়া আমার হুইলের সূতা মজবুত না।

সর্দার বললেন, এখানে এই সূতা কাজ করবে না। তারপরও ফেলেন। মনে হয় শাপলা পাতা মাছ ধরছিলো ভাই। এদিকে কয়েক মণ ওজনের শাপলা পাতা ধরা পড়ে মাঝে মাঝে। আগে বেন্দী জাল বাইতো জেলেরা। তাদের জালে এই শাপলা পাতা, হাঙ্গর আর ডলফিনও ধরা পড়তো।

নতুন করে বড়শি বেঁধে পানিতে ফেললাম। এবার মাটিতে পড়ার আগেই টান পড়লো। টেনে তুললাম। বেশ বড় আকৃতির মোচন টেংড়া উঠলো। বললাম, এই সাইজের কয়টা মাছ পেলেই তো আমাদের দুই বেলা চলে যাবে।

জেলেরা মাছ ছাড়িয়ে আধার গেঁথে দিলো। বড়শি ফেলতেই আবার টান পড়লো। এবার উঠলো কেজি দুই সাইজের পাঙ্গাস মাছ। আমি তো খুশিতে আত্মহারা। মাছ দেখে সবাই সামনে চলে এসেছে। সে এক বিরাট আনন্দের ব্যাপার। সর্দার বললেন, আর আলো না জ্বালায়ে থাকতে পারলাম না ভাই। বলতেই শহীদুল কাকু ভিতরে গিয়ে আলো জ্বাললেন। ট্রলারের আলো জ্বলে সৌর বিদ্যুৎ দিয়ে।

জেলেরা বললো, জোয়ারের সময় এই চরে বুক সমান পানি উঠে যায়। সামনের খাল ধরে পাঙ্গাসের ঝাঁক উঠে পড়ে। আবার ভাটায় নেমে যায়। সে সময় যদি ফাঁসজাল ফেলা যায় ভাই তাহলে পাঙ্গাস মাছ ছাড়ায়ে শেষ করতে পারবেন না। কেওড়া পাকার মৌসুমে এই অঞ্চলের চরগুলোকে হাজার হাজার পাঙ্গাস মাছ ঘুরে বেড়ায়।

এখন তো কেওড়া পাকার সময়। আমরা কি দেখতে পারবো মাছ? মানে চরপাটার কোনো জাল কি আছে আশেপাশে? সর্দার বললেন, কাল তাহলে চলেন পশ্চিম পাশে! দেখবেন পাঙ্গাস মাছের খেলা!

ছবি: পুতনীর দ্বীপ
(নভেম্বর ২০১৬, সুন্দরবন)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top