রূপান্তরের গল্প ৩১৫ | Rupantorer Golpo 315

ভাসছি আড়পাঙ্গাসিয়ার মোহনায় | রূপান্তরের গল্প ৩১৫

ভাসছি আড়পাঙ্গাসিয়ার মোহনায় | রূপান্তরের গল্প ৩১৫ | Rupantorer Golpo 315 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ৩১৫ : সাথে একটা ডিঙ্গি নৌকা থাকলে দারুণ হতো! তাহলে এই সময়টা ট্রলারে বসে থাকতাম না। সামনের ওই খাল ধরে চলে যেতাম দ্বীপচরের ওই প্রান্তে। ওদিকে যে কেওড়া বন আছে সেই বনের দক্ষিণে একটা ছোট্ট বসতি আছে।

অভয়াশ্রমে এই দ্বীপে অবৈধ সেই বসতির মালিক একজন মাছ ব্যবসায়ী। জেলেরা বললো, ডাঙ্গায় তাদের নৌকা আছে। বললাম, আপাতত থাক। শিকারের কাহিনী জেনে গেছি বলে আড়ষ্ঠ তারা। নামলে আর নাও ফিরতে পারে।

দ্বীপে নামতে নামতে ভোর হবে। মানে ভরা জোয়ার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। জেলেদের এখন আর ঘাটালাম না। কথা ঘুরিয়ে জানতে চাইলাম, এদিকের বইশেলরা কেওড়া দিয়ে বিশাল বিশাল পাঙ্গাস ধরে ফেলে। সেটা কেমন করে হয়? একজন বললো, পুষ্ট বা পাকা কেওড়া সেদ্ধ করা হয়। তারপর দাওন বড়শিতে গেঁথে নদীতে ফেলে।

আরেক জেলে বললো, ভরা মৌসুমে এক দাওনে শতাধিক পাঙ্গাসও ধরা পড়ে যায়। বললাম, তাহলে তো এক বড়শিতেই লাখ টাকার মালিক হয়ে যায় ওরা। রান্নাঘর থেকে আমার কথা শুনে হেসে দিলেন সর্দার। বললেন, জঙ্গলে এই মাছের কোনো দাম নাই ভাই।

কেজি সাইজের মাছের দাম ১৫-২০ টাকা। আর বড় পাঙ্গাসের দাম জেলেরা পায় খুব বেশি হলে কেজিতে ৬০-৭০ দেয়। সবচেয়ে দামি বড় মাছের দাম তখন সর্বোচ্চ ১২০ টাকা। পাঙ্গাস এতো ধরা পড়ে যে মাঝে মাঝে মহাজনে নিতেও চায় না। আসলে অনীহা প্রকাশ হলো কৌশল। বাজারে মাছের চাহিদা নাই, দাম নাই, লোকে খায় না, মাছে কোয়ালিটি নাই ইত্যাদি বলে দাম কমায় মহাজনেরা।

সুন্দরবনে মাছের দাম নাই। কথাটি আগে বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু এই অঞ্চলে ঘুরতে ঘুরতে বিষয়টি জানতে পেরেছি, দেখছি নিজের চোখে। আর এটুকু বুঝতে পারছি যে সুন্দরবনে যতোদিন দস্যুতা থাকবে ততোদিন দাম এমনই থাকবে।

মাছের দাম এমন পানির মতো দাম থাকলে চলে কী করে? পোষায় তাদের? ওরা বললো, অনেক বেশি মাছ না ধরলে লোকসান হয়। অনেক বেশি মাছ ধরতে হয়। সেজন্য নিষিদ্ধ এলাকায়, নিষিদ্ধ পদ্ধতিতে মাছ শিকার করে জেলেরা। এজন্যই সুন্দরবনে বিষ দিয়ে মাছ ধরার প্রবণতা বেড়েছে।

পশ্চিম সুন্দরবনের অভয়াশ্রমগুলোতে মাছ বেশি। তাই জেলেদের প্রবেশ ঠেকানো যায় না। মনে মনে ভাবি, বাজার দর পেলে নিশ্চয়ই জেলেদের আর মণকে মণ মাছ ধরতে হতো না। অল্প মাছ ধরে যদি তাদের সংসার চলে তাহলে বাড়তি চাপ কেন নিবে তারা? বাঘ কুমির, ডাকাতের ঝুঁকি আর ফরেস্টের ঝামেলা কে পোহাতে চায়?

জেলেরা বলে, মহাজনে বাজার দরে মাছের দাম দিলে ওরা অভয়াশ্রমে আসতো না। তাহলে বনের ওপরও চাপ কমতো। এলোমেলো ভাবে ভাবনাগুলো আসে। তাই যখন যেভাবে পারি ভাবনাগুলোর সাথে বাস্তবতা মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করি।

দ্বীপের উত্তরে জমাট বাঁধা গেওয়া বন। গড়ান আর গেওয়ার মিশেলে বনটি দেখতেই অন্য রকম। অদ্ভুত লাগে, মায়াবী মনে হয়। অন্ধকারে এই বনের অবয়বটা দেখছিলাম এতোক্ষণ। কিন্তু চাঁদ যখন উঁকি দিলো তখন থেকে সবকিছু পাল্টে গেলো।

গেওয়া বনের উপর দিয়ে চাঁদ উঠছে। সেই সাথে জোয়ারও এসেছে। নদীর পানি ফুলতে শুরু করেছে। সাগরের পানি ঢুকতে শুরু করেছে নদীতে। স্রোত ঘুরে গেছে। দক্ষিণ থেকে উত্তরে যাচ্ছে পানি। সময়ের সাথে সাথে বাড়ছে পানির চাপ। বড়শি গুটিয়ে ফেললাম।

ট্রলারের পেছনের রান্নাঘরের সামনে ল্যাটা দিয়ে বসা বেলায়েত সর্দার। বাতাসের কারণে ভালো মতো চুলা জ্বলছে না। দুই পাশে কম্বল টেনে দিয়ে ঠেকানো হয়েছে বাতাস। সেখানে গিয়ে বসলাম। দারুণ উষ্ণ পরিবেশ। বললাম, আমাদেরকে উত্তরা বাতাসের মধ্যে রেখে আপনারা আগুন পোহাচ্ছেন ভাই?

হাসতে হাসতে সর্দার বললেন, আপনারা আসলে রান্নার সমস্যা হবে, তাই ডাকিনি। রান্নাটা তাড়াতাড়ি সারতে হবে। কারণ এই নদীতে বড় বড় ঢেউ হবে একটু পর। কী খাওয়াবেন আজ? সর্দার বললেন, ভাতের সাথে কাঁকড়া ভুনা হবে। একটু ঝোল রাখবো। সাথে কেওড়া দিবো কয়টা। দেখবেন অমৃত লাগবে।

গল্প করছিলাম। এসময় মামুন এসে ডাক দিলো। বললো, একটা জিনিষ দেখে যান ভাই। দ্বীপের পূর্ব দিকের কেওড়া বনে টর্চের আলো ফেললো মামুন। জ্বলজ্বল করে জ্বলছে শত শত চোখ।

মনে হয় কয়েকশ হরিণ দাঁড়ানো। টর্চের আলোয় তাদের চোখ জ্বলছে। টর্চের আলোকে একদম পাত্তা দিচ্ছে না তারা। আপন মনে দাঁড়িয়ে আছে কেউ। যেন কোথাও কোনো তাড়া নাই। টর্চের আলোয় দেখছি, হরিণেরা কেওড়া পাতা ছিঁড়ে খাচ্ছে।

কেওড়া ফলও হরিণের সবচেয়ে প্রিয় খাবার। সুন্দরবনের যেখানে সেখানে হরিণ খুঁজলে পাবেন না। কেওড়া গাছ বা কেওড়া বনের কাছাকাছি ওরা ঝাঁক বেঁধে বিচরণ করে। বাঘ বা মানুষের চাপ না থাকলে ওরা সারাদিনই এমন জায়গায় থাকতে পছন্দ করে। শুধু জোয়ারের পানি উঠলে সরে যায় উঁচু কোনো জায়গায়।

শিকারীরা এই সময়টিকে কাজে লাগায়। জোয়ারের সময় পানি উঠে যায় বনে। স্থলভাগ কমে আসে। সরু হয়ে আসে ওদের চলাচলের পথ। জায়গা মতো দড়ি দিয়ে বানানো হরিণ ধরার ফাঁদ- ডোয়া পেতে রাখে শিকারী। ডোয়ায় কখনও ৩০-৪০টি হরিণও আটকা পড়ে একসাথে।

দূর থেকে হরিণ দেখছি। এর মধ্যে আমাদের কাছাকাছি একটি বন্যশুকরের পাল ঘুরাঘুরি করছে খেয়াল করিনি। হঠাৎ ওদের চিৎকারে চমকে উঠলাম!

টর্চ ফেলে দেখি মোটামুটি মহিষের মতো লম্বা দুটি মর্দা বুনোশুয়োর মারামারি করছে। আছে আরও কয়েকটি মাদী শুকর আছে। ছোট ছোট বাচ্চাও আছে কয়েকটা। জেলেরা বললো, এদের ভয়ে ডাঙ্গায় থাকা যায় না ভাই। বাঘেরও ধর্ম আছে। শুকরের কোনো ধর্ম নাই। যখন তখন অ্যাটাক করে বসে!

অবশ্য জোয়ার হলে ওরা আর এদিকে থাকবে না। চর ছেড়ে চলে যাবে ওই গেওয়া বনে। ওই বনের ভিতর আমি একবারই গেছি। ঢুকতেই বিরাট বড় এক কেউটে সাপ দেখে ভড়কে গেছিলাম। সাপ আমি ভীষণ ভয় পাই।

জেলেরা বললো, পুতনীর দ্বীপের ওই জঙ্গলের প্রতিটি গাছের গোঁড়ায় গোঁড়ায় সাপ থাকে। সেগুলো জাত সাপ। আবার জোয়ারের পানি যখন নেমে যায় তখন খালের পাড় ধরে হাঁটতে গেলেও দেখি সাপ আর সাপ! সেগুলো পানির সাপ। আগের জানতাম, পানির সাপে বিষ নাই। কিন্তু এদিকের লবণ পানিতে ভয়ঙ্কর এক জাতের সাপ দেখি। সাগরের এই সাপকে জেলেরা বলে কেরেল সাপ! বিষধর এই সাপের অ্যান্টিভেনম নাই। প্রতি বছর এর দংশনে জেলেদের মৃত্যু হয়।

সুন্দরবনের জেলেরা মরে পানিতে ডুবে, ঝড় জলোচ্ছাসে। বাঘ কুমিরের পেটে যায় মানুষ। ডাকাতের অত্যাচারেও মৃত্যু হয় জেলেদের। ডাঙ্গার বিষধর কালো কেউটে কিংবা লবণ জলের কেরেল সাপের দংশনে মৃত্যুর সংখ্যাও কম না। বন উপকূল ঘুরে দেখলাম, এদিকের জেলে বাওয়ালীদের জীবনের মূল্য সবচেয়ে কম।

বেলায়েত সর্দারের রান্নাঘরে ফিরলাম। সেখানে বসেই ভাত খেয়ে নিবো। গরম ভাতের সাথে ঝাল করে করা কাঁকড়া ভুনা! কেওড়া দিয়ে সেই তরকারিতে আলাদা একটা ব্যাপার এসেছে। জঙ্গলের ভিতর সর্দারের রান্নায় কেমন জানি বুনো বুনো একটা ভাব এসেছে! ওদিকে চাঁদ উঠছে গেওয়া বনের মাথার উপর। সে এক অদ্ভুত মায়াবী বুনো পরিবেশ!

(সুন্দরবন, নভেম্বর ২০১৬)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top