খাল ভর্তি সাপ, জঙ্গলেও সাপ | রূপান্তরের গল্প ৩১৬ | Rupantorer Golpo 316 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ৩১৬ : আমাদের এখন যেতে হবে ভাই, ছেড়ে দেন। বলছিলো পুতনীর দ্বীপে দেখা হওয়া কাঁকড়ার জেলেরা। রাতের খাওয়া শেষ। এখন দ্বীপে ফিরে যাওয়ার জন্য ছটফট করছে ওরা। মাঝে মাঝে মামুনের সাথে নিচু স্বরে কথা বলছে। কিন্তু ঘুরেফিরে আমার কাছেই আসছে।
এখন ওদের ট্রলার থেকে নামতে দিবো না। ছাড়বো না। ওরা বলছে, কাঁকড়ার দাওন-দড়িগুলো তুলতে হবে। ওই পাশের ছোট খালের এমাথা ওমাথা দাওন চেক করা লাগবে। কয়টা চারো দেওয়া আছে চরের উপর দিয়ে। সেগুলোও চেক করবো। দেরি করলে কাঁকড়াগুলো নষ্ট হয়ে যাবে। বললাম, নষ্ট হলে দাম দিয়ে দিবো।
ওরা ট্রলার ছেড়ে যাওয়ার ছুতো খুঁজছে। আর আমি সেটা বুঝে ফেলেছি। ওরাও জানে শিকারের কাহিনী ফাঁস হয়ে গেছে। ফাঁদশুদ্ধো এখন দিয়ে দিতে হবে। আর শিকার করা যাবে না এটা বুঝে গেছে তারা। তাই কোনো রকমে সটকে পড়ার তালে আছে তারা।
জোয়ার হয়েছে প্রায় তিন ঘন্টা। চাঁদের আলো বেড়েছে। বাতাস কমেছে। সেই সাথে পড়ছে ভারী কুয়াশা। শীতকালে বাতাস কমলে সাধারণত ভারী কুয়াশা পড়ে। ভোর রাতে ভরা জোয়ার হবে। তখন কুয়াশায় চারপাশে আর কিছু দেখা যাবে না। বললাম, দেখা যাক বা না যাক আমরা জোয়ারে এই দ্বীপে উঠবো। খাল ধরে ট্রলারসহ উঠে পড়বো, মাঝের কোনো জায়গায় গিয়ে নোঙর করবো।
রাতের খাবার শেষে থালা বাসন ধুয়ে নিচ্ছে মামুন। নৌকা জীবনে যখনকার কাজ তখন সেরে নেওয়া অভ্যাস তাদের। শীত, গরম বা বর্ষা বলে কোনো কথা নাই। ওদিকে চুলায় গরম পানি তুলেছেন। আরেক দফা চা হবে।
গল্প করতে করতে সরদারকে বললাম, কাঁকড়া ভুনা ভালোই হয়েছে। তবে সাথে একটু ডাল থাকলে ভালো হতো। কাঁকড়া এমনি খেতে ভালো লাগে। ভাতের সাথে ঠিক পোষায় না। সর্দার বললেন, রান্না কি খারাপ হইছে ভাই? বললাম, না না, স্বাদ হইছে।
হা হা হা। হেসে দিলেন সর্দার। বললেন, ট্রলারে পেঁয়াজ ফুরায়ে গেছে ভাই। রান্নাটা এজন্য একটু জঙলা জঙলা লাগছে। পেঁয়াজ ছাড়া রান্না খারাপ হয় না। অন্যান্য মসলা একটু বাড়িয়ে দিলে আর টের পান না আপনি! বললাম, পেঁয়াজ ছাড়া ডাল রান্না করতে পারবেন? উনি বলেন, সে আর বলা লাগে ভাই! সকালে ডাল করবোনে। খেয়ে টেরও পাবেন না যে পেঁয়াজ নাই।
জঙ্গল জীবনে মাঝে মাঝে এমন হয়। অতি প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র মাঝে মাঝে ফুরিয়ে যায়। তবে লবণ আর মরিচ থাকলে কোনো না কোনো ভাবে দুই বেলার খাবার হয়ে যায়। শহীদুল কাকু বললেন, সুন্দরবনে পান সুপারি আর বিড়ি থাকলে দুই-চারদিন কাটিয়ে দেওয়া যায়।
রাতে আর ঘুমাবো না। আর ঘন্টা খানেক পর ট্রলার চালাবো। বড় নদী থেকে দ্বীপে উঠবো। যে করে হোক, চরের ওই মাথায় আজ যেতেই হবে। যদি এরা সত্যি ফাঁদ পাতে তবে তাতে হরিণ আটকা পড়বেই। আমাদের প্রথম কাজ হবে সেই হরিণ ছেড়ে দেওয়া। বেকায়দায় না ফাঁসলে ডোয়ায় আটকা পড়া হরিণ বাঁচানো যায়।
ঠিক এক ঘন্টা পর নোঙর তুললাম। আমাদের বরাবর একটি খাল আছে। সেই খাল ধরে ঢুকতে গেলাম। আবারও ঠেকে গেলো ট্রলারের তলা। ফিরে আসলাম নদীতে। এবার কাঁকড়ার জেলেরা পথ দেখালো। খালটির মুখে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় খাঁড়ি। দ্বীপে উঠতে হলে সেদিক দিয়ে যেতে হয়।
বড় নদীতে একটা চক্কর দিয়ে সোজা টান দিলাম। ঠেকতে ঠেকতে কোনো রকমে উঠে পড়লো ট্রলার। এরপর ধীরে ধীরে এগিয়ে খাঁড়ি পেলাম। সামনে গিয়ে দক্ষিণে নেমে গেছে ছোট আরেকটি খাল। সেই খাল ধরে এগিয়ে নোঙর করলাম। খালটির এক পূর্ব আর দক্ষিণ দিকে কেওড়ার বন। পশ্চিমে বিশাল চর। তবে ওদিকটা বেশ ঘন ছনের বন। মোটকথা নিজেদের আড়াল করার জন্য বেশ সুবিধাজনক জায়গা।
চারপাশটা এখন বেশ থমথমে। কুয়াশার কারণে বেশি দূর দেখা যাচ্ছে না। পানি উঠে গেছে চরের ওপর। মরা গোন এখন। খুব বেশি উঠবে না পানি। জেলে ভাইদের বললাম, চলেন নামি।
বেলায়েত সরদারকে বিশ্রাম নিতে বললাম। কিন্তু কে শোনে কার কথা? ট্রলারে শহীদুল কাকুকে রেখে নেমে পড়লাম। হাঁটু পানি ভেঙ্গে এগুতে হবে। পায়ের নিচে বালির চর। আরাম লাগছে হাঁটতে। জেলেরা বললো, সামনে গিয়ে কেওড়ার শুলো পড়বে নিচে। সাবধানে হাটা লাগবে আপনারা। বললাম, আপনারা সামনে হাঁটেন। আমি ধীরে ধীরে আসছি।
টর্চ হাতে এগুতে গিয়ে বার বার হোঁচট খাচ্ছি। সামনে গিয়ে ছোট ছোট শিষে খাল পড়লো। সেদিক দিয়ে গেলে ভালো হয়। কিন্তু ওদিকটা পানির সাপে ভরা। টর্চ ফেললেই দেখতে পাচ্ছি ওদের। শরীরটাকে পেঁচিয়ে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে বসা। ছোট মাছগুলো ধরছে, খাচ্ছে। আমি আবার সাপ খুব ভয় পাই।
জেলেরা বললো, ওগুলো ঢোরা সাপ। বিষ নাই। বললাম, বিষ নিয়ে পরে ভাববো। আমি সাপ সহ্যই করতে পারি না। দেখলেই ভয় পাই। শুধু সাপ না, কুঁচিয়া দেখলেও ভয় পাই আমি। সাপের মতো কোনো কিছুই আমি ধরতে পারি না।
বললাম, শুধু ঢোরা সাপ থাকবে কেন? এখানে তো আরো নানা জাতের সাপ আসে। সাগরের কেরেল সাপও তো দেখেছি আমি। এছাড়া স্টিংরের লেজেও তো বিষ আছে। কাইউন মাছের পোণাও ঝুঁকির। পায়ে কাঁটা ফুটালে তো বিরাট বিপদ হবে।
আমাকে ভয় পেতে দেখে ওরা পথ বদলালো। একটু ঘুরে কেওড়া বনের ভিতর দিয়ে সেই পথে কতোক্ষণ হাঁটলাম মনে নাই। কিছু দূর যেতেই পায়ের বারোটা বাজলো। কারণ এখানে ছোট ছোট গড়ানের ঝোপ আছে। ওই গাছের গুচ্ছমূলগুলো শক্ত, পায়ের তালুতে খুব ব্যাথা লাগে।
আর হাঁটতে পারছি না। একটু দাঁড়াতে বললাম সবাইকে। সামনে একটা মরা কেওড়া গাছ পড়ে আছে। ভাবলাম সেখানে বসে একটু বিশ্রাম নিবো ভাবলাম। কিন্তু ওদিকে টর্চ মারতেই দেখি কালো রঙ এর একটা সাপ সরসর করে দৌড় দিলো। শিড়দাঁড়া দিয়ে কিছু একটা নেমে গেলো! কেউটে সাপ! আমি মনে হয় পাগল হয়ে যাবো আজ।
আমার অবস্থা দেখে সর্দার হাসতে হাসতে শেষ। বললেন, নামছেন যখন তখন তো আর ফিরবেন না আপনি। ফিরবেন? বললাম, ফিরার জন্য তো নামিনি। চলেন, আগে ওদের পাতানো ডোয়া পর্যন্ত যাই।
আরেকটু হেঁটে দ্বীপের পূর্ব কোণায় আসলাম। এখানটা বেশ উঁচু। শক্ত বালির চর। এখান থেকে দক্ষিণে পুরোটাই কেওড়া বন। ট্রলার থেকে এদিকটাতেই হরিণের ঝাঁক দেখেছিলাম।
জেলেরা আর এগুতে চাচ্ছে না। ওদের আড়ষ্ঠ হওয়া, ভয় পাওয়াটা স্বাভাবিক। ভয় না ভাঙ্গালে ওরা আমাদের জায়গা মতো নিবে না। সর্দারকে ফিসফিস করে বিষয়টা বললাম। সাথে সাথে সর্দার অ্যাকশনে নামলেন। হাঁক দিয়ে বললেন, এই তোমাদের কাছে পেঁয়াজ আছে তো! হরিণ বাঁধলে তো রান্না করা লাগবে। জেলেরা বললো, তা আছে। ওদিকে বিকাশ বাবুর ঘর আছে। সেখানে গেলেও পেঁয়াজ পাবেন।
এবার কাজ হলো। মাত্র কয়েক মিনিট হাঁটা পথ। আমরা একটু এগুতেই সামনে হরিণের ঝাঁক পড়লো। আমাদের দেখেই কেওড়া বনের ভেতর দিয়ে তারা দিলো দৌড়। হরিণের এমন দৌড় আগে ছবিতে দেখেছি। চোখের সামনে যেন ভূমিকম্প হচ্ছে। ধাপধুপ করে তারা দৌড়ালো। হারিয়ে গেলো তারা। কয়েক সেকেন্ড পর বিকট চিৎকারের শব্দ পেলাম। কী হলো এটা? কীসের শব্দ? কোনো ঝামেলা না তো? এমনিতেই সাপের দুশ্চিন্তায় আমি শেষ। আর ঝামেলা নিতে পারবো না ভাই।
সর্দার বললেন, চুপ করেন ভাই। শব্দটা কোন দিক থেকে আসছে বুঝে নেই। সাধারণত বাঘ ধরলে এমন আওয়াজ করে হরিণ। মানে কী? জেলেরা বললো, আপনারা কথা বলেন না ভাই।
চুপ করে গেলাম আমরা। কেওড়া বনের ভিতর থেকে ফ্যাঁসফেঁসে আর্তনাদ আসছে। ধক ধক করছে বুকের ভিতর। ওরা শব্দের দিক বুঝার চেষ্টা করছে। আমার শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ ছাড়া এই মুহুর্তে আর কোনো শব্দ নাই।
(সুন্দরবন, নভেম্বর ২০১৬)