শিকারিদের তান্ডব | রূপান্তরের গল্প ৩১৭ | Rupantorer Golpo 317 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ৩১৭ : ব্যা ব্যা করে ডাকছে হরিণ। সর্দার বললেন, হরিণে কলে পড়ছে ভাই। মর্দা হরিণ। বিরাট সাইজ! বললাম, কী করে বুঝলেন ছেড়ে হরিণ? সর্দার বললেন, গলাটা ফ্যাঁসফেঁসে। আবার ডাক শুনছেন? হুট করে শুনলে মনে হবে বড় কোনো প্রাণি গোঙ্গাচ্ছে। সুন্দরবনের শেষ প্রান্তের জনমানবহীন এই দ্বীপে সেই আর্তনাদ মনে হচ্ছে মাটি ফুঁড়ে বের হচ্ছে।
বুকটা ধকধক করছে এখনও। কিন্তু কেউ কোনো সাড়া শব্দ করছি না। তিনজন কাঁকড়ার জেলে আছে আমাদের সাথে। ওদের দলনেতার ইশারায় আমরা চুপ করে গেছি। শুধু ধকধক ধকধক শব্দটা বাড়ি দিচ্ছে বুকের ভিতর।
এক হাতে আমাকে ধরে দাঁড়িয়ে আছেন বেলায়েত সর্দার। কেওড়া বাগান চারপাশে। সাপের ভয়ে কোনো গাছের নিচে যেতে সাহস হচ্ছে না। ভাবছি পানিতে সাপ থাকতেই পারে। কিন্তু এই শীতের সময় কেউটে সাপ বের হলো কেন?
এখন তো তাদের শীতনিদ্রায় থাকার কথা। ফিসফিস করে সর্দারকে বিষয়টি জিজ্ঞেস করলাম। বললেন, সে তো মরা গাছে নিচে ঘুমায়ে ছিলো। মানুষ এসে বিরক্ত করলে কি আর ঘুম হয়? মনে মনে বুঝ দিলাম। কিন্তু কেউটে সাপের বাইরে থাকার বিষয়টি মাথায় আসছে না।
কয়েক সেকেন্ডের বিরতি দিয়ে বিকট শব্দটি চলছে। জেলেদের একজন এগিয়ে গেলো। আমাদের চুপচাপ দাঁড়াতে বললো সে। কয়েক মিনিট এভাবে কাটলো। তারপর কুঁই দিয়ে আমাদের ইশারা দিলো সে। সবুজ সংকেত পেয়ে হাঁটা দিলাম।
কেওড়ার শ্বাসমূলগুলো এখানে মাঝারি আকৃতির। জায়গায় জায়গায় গড়ানের ঝোপ। কয়েকটি হরগজা গাছও আছে। টর্চ ফেলে এগুচ্ছি। পায়ের তালু আর গোঁড়ালিতে ব্যাথা নিয়ে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। এর মধ্যে হরগজার কাঁটা বিঁধে যন্ত্রণা দিচ্ছে। ব্যাথায় একটু ইশ আশ করছি। দেখে সর্দার বললেন, ভাগ্যিস এখানে হেঁতাল গাছ নাই। থাকলে তো আর নেওয়া লাগতো না আপনাকে।
হাঁটছি আর ভাবছি পুতনীর দ্বীপের এই জায়গাটি সুন্দরবনের সবচেয়ে সুন্দর জায়গাগুলোর একটি। এখানে বাঘের আনাগোণার খবর পাই না। সেদিক থেকে নিরাপদ। হঠাৎ হঠাৎ বাঘ আসলেও কুমিরের দেখা পাওয়া যায় না। দক্ষিণের বিস্তীর্ণ কেওড়া বন আর বালির চর সব দিক থেকে বেশ নিরাপদ।
জেলেরাও এখানে অনিরাপদ বন বিভাগের নজরদারির কারণে। বনদস্যুরাও ঝুঁকির কারণ। তারা এদিক দিয়ে চলাফেরা করে। কিন্তু এখানে অবস্থান তাদের জন্য বিপদের। তাই সুন্দরবনের দস্যুরা এই দ্বীপে উঠে না।
এখন ভোর রাত। চারটা পেরিয়ে গেছে। চাঁদ মাথার উপর। তার মানে ভরা জোয়ার। বাতাস পড়ে গেছে বলে চারপাশটা একদম থমথমে। কুয়াশার কারণে চারপাশটা ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। জেলেদের সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটার চেষ্টা করছি।
নি:শব্দে চলার কথা থাকলেও জায়গায় জায়গায় হোঁচট খাচ্ছি। ভাবছি, বনের ভিতরে হাঁটা চলার আরও প্রশিক্ষণ নিতে হবে। তা না হলে সামনের কাজগুলো এগিয়ে নেওয়া মুশকিল হবে। সামনে বেশ কয়েকটি ছোট ও মাঝারি বনদস্যু দলের সাথে দেখা করতে যাবো। তখন বনের গহীনে হাঁটতে হবে। কারণ ছোট দস্যুদের ডেরা থাকে বনের গহীনে। ছোট খাল বা জঙ্গলের আগার দিকে।
হাতের ইশারায় দাঁড়িয়ে পড়লাম। গাছের সাথে দড়ি বাঁধা। এখান থেকে ডোয়া অর্থাৎ ফাঁদের শুরু। পূর্ব পশ্চিমে টানানো সেটি। হরিণের গোঙ্গানির শব্দ আসছে কেওড়া বাগানের পশ্চিম দিক থেকে। আমরা পূ্র্ব পাড় ধরে হাঁটছি। সামনের জনের ইশারা অনুসরণ করে পশ্চিমের পথ ধরলাম। একটানা টর্চ জ্বালিয়ে পথ চলছি আমি। সাপের ভয়ে বুকের ভিতরটা এখনও ধুকপুক করছে।
থমকে গেলাম। অন্যদের সাথে দাঁড়িয়ে পড়লাম। এতোক্ষণ নজর ছিলো মাটির দিকে। থামলাম, টর্চ ধরলাম সামনে। চোখের সামনে যা দেখছি তা অবিশ্বাস্য। বিশাল এক শিংওয়ালা হরিণ গাছের সাথে পেঁচিয়ে আছে। দড়ির সাথে পেঁচিয়ে এক রকম ঝুলে আছে সে। শিং-এর সাথে আচ্ছামতো দড়ি পেঁচিয়েছে।
সুন্দরবনের শিকারীদের তৈরি ডোয়া বা ফাঁদের এই হলো কেরামতি। সামান্য একটি ফাঁসে প্রথমে আটকা পড়ে হরিণ। তারপর ছাড়া পাওয়ার জন্য যতো চেষ্টা করে, ততোই জড়িয়ে যায়।
এবার আর কথা না বলে থাকতে পারলাম না। বললাম, সবাই মিলে ওকে ধরেন। দড়িগুলো কাটেন। এক জেলে গিয়ে দা দিয়ে এক টুকরো দড়ি কাটলো। তারপর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সামনের আর পিছনের পাগুলো বেঁধে ফেললো।
চিৎকার করে বললাম, আবার বাঁধছেন কেন? ওরা বললো, না বাঁধলে তো ছাড়ানো যাবে না ভাই। এমনিতে দড়ি খুলতে গেলে দাপাদাপি করবে। শিং আর ওর ক্ষুরে যে ধার! আমাদের ছিন্নভিন্ন করে ফেলবে সে। সর্দার বললেন, হরিণের ক্ষুরগুলো দেখেন ভাই। নাপিতের কাছে যে ক্ষুর থাকে এর ধার তার চেয়ে কম না। পা গুলো ছুটোছুটি করলে তখন বুঝবেন কেমন করে কাটে!
হরিণের ধারালো ক্ষুরের ভয়াবহ দিকটি জানা ছিলো না। তাই তো শিকারীরা আগে পা গুলো বেঁধে ফেলে। জেলেরা সবাই মিলে হরিণটিকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। ভয়াবহ ভাবে পেঁচিয়ে গেছে।
বেলায়েত সর্দার গেছেন সামনের দিকে রেকি করতে। ফিরে এসে বললেন, কাজ তো বাড়লো ভাই। সামনে আরও দুইটা হরিণ পড়ছে ডোয়ায়। বললাম, সেগুলোও ছাড়তে হবে। বেঁচে আছে তো? সর্দার বললেন, একটা ছোট হরিণ আছে। সেটার যে কী অবস্থা বুঝতে পারছি না।
তাড়া দিলাম জেলেদের। ওরা দ্রুত হাত চালাচ্ছে। আমি টর্চ ধরে দাঁড়িয়ে ওদের সহযোগিতা করছি। এভাবে মিনিট দশ চললো। তারপর বড় হরিণটি ছাড়তে পারলাম। এরপর সামনে এগিয়ে একটি মাদী হরিণ পেলাম। সেটি ছাড়াতে সময় লাগলো না।
প্রথমে সতর্কতার সাথে বড়টাকে ছাড়া হলো। সে একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে দৌড় দিলো। মাদী হরিণটিকে ছাড়তেই দিলো বিরাট এক লাফ। ধরফড় করে গিয়ে পড়লো বালির উপর। তারপর তিড়িং বিড়িং করে মিলিয়ে গেলো অন্ধকারে।
ফাঁদে আটকা পড়া হরিণের ছোট বাচ্চাটি একটু বেকায়দায়। গলায় ফাঁস লেগেছে। তবে এ যাত্রায় মনে হয় টিকবে। সর্দার বললেন, ওরে ট্রলারে নিয়ে যাই ভাই। একটু সেবা করে ছেড়ে দিবোনে। বললাম, ওদের এতো সেবার দরকার পড়ে না। ছেড়ে দেন। দেখবেন নিজের মতো করে বেঁচে যাবে। এদের দলের অন্যরা তো এই দ্বীপেই আছে। খুঁজে নিবেনে বাচ্চাটাকে।
হরিণগুলো ছেড়ে দড়ি গোছানোর কাজ শুরু করলো সবাই। ওদের আগেই বলে দিয়েছি, শিকার বিরাট বড় অপরাধ। বন বিভাগের ধরিয়ে দিবো না। কিন্তু আমার কাছে প্রতিজ্ঞা করতে হবে। আর কখনও শিকার করবে না তোমরা। সুন্দরবনের এই মানুষদের যে হরিণ ধরতেই হবে এমন কোনো কথা নাই। বরং মাছ কাঁকড়া ধরে ঠিক দামে বেচতে পারলে সংসারটা চলে যায়। সমস্যা হলো এরা স্বভাবে শিকারী।
ছোটবেলা থেকে বন উপকূলের মানুষদের মধ্যে শিকারের প্রবণতা তৈরি হয়। পাশেই বিশাল সুন্দরবন। যুগ যুগ ধরে এলাকার প্রভাবশালীদের মধ্যে গুলি করে হরিণ শিকারের অভ্যাস ছিলো।
এক সময় শিকার ছিলো ডাল ভাত। লাইসেন্স করা বন্দুক নিয়ে তারা শিকারে যেতো। এখনও তারা শিকার করে। তবে আগের মতো ঢাকঢোল পিটিয়ে নয়। চোরের মতো শিকার করে। একই সাথে প্রান্তিক মানুষদের মধ্যে যারা পেশাদার শিকারী তারা এই দড়ির ফাঁদ দিয়ে অপকর্ম করে। এর বাইরে জেলেদের মধ্যে যারা শিকার করে তারা এটি করে পেট চালায় না। কিন্তু বনে নামলেই ভিতরের সেই শিকারী চরিত্রটি বের হয়ে আসে। শিকার এক বিরাট নেশা!
পুতনীর দ্বীপে হরিণের অভাব নাই। ভাটার সময় দক্ষিণের চর এলাকায় নামে ওরা। বালির চর আর কেওড়া বনের আশেপাশে ওদের আনাগোণা থাকে। বাঘ থাকে নাই বলে ওদের বিচরণ বেশ নিরাপদ মনে করা হয়। কিন্তু মানুষের চাপে ওরা থাকে দৌড়ের ওপর।
কাঁকড়ার জেলেরা মুখ ফুটে সব বলছে না। তবে অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে পুতনীর দ্বীপে সারা বছরই মানুষ থাকে। মাছ শিকার, কাঁকড়া আহরণ চলে অবৈধ ভাবে। একই সাথে চলে হরিণ শিকার।
পুতনীর দ্বীপ নিয়ে শুরু থেকেই অনেক আগ্রহ ছিলো। বনের ভিতরের বিচ্ছিন্ন একটি দ্বীপ। জেলেরা বলে দ্বীপচর বা বিবির মাইধে। আড়পাঙ্গাসিয়া নদীর মোহনার এই দ্বীপটি আয়তনে বেশ ছোট। গাছের মধ্যে আছে গড়ান, গেওয়া, কেওড়া, ধুন্দল, হরগজা, কেয়া, ছনের ঝোপ। সুন্দরী গাছের কোনো চিহ্ন দেখি না এখানে।
দ্বীপের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। এখান থেকে পূর্ব দিকে নীল কমলের নিচে আরেকটি বড় চর আছে যার নাম বঙ্গবন্ধুর চর। পশ্চিম দক্ষিণে মান্দারবাড়িয়া। আশেপাশের বনের সবগুলো অংশে বেঙ্গল টাইগারের চলাফেরা আছে। পুতনীর দ্বীপে বাঘ আসে না বলেই জানি। তবে কেউ কেউ বলে, নীল কমলের বালির গাঙ অথবা কলাতলার ওদিক থেকে নাকী এক জোড়া বাঘ আসে মাঝে মধ্যে।
এই মুহুর্তে বাঘ নিয়ে কোনো ঘটনা ঘটেনি। তবে গত ঘন্টা খানেক ধরে যে যজ্ঞ চলছে তার মধ্যে অনেকগুলো বিষয় আছে। কিন্তু একটি বিষয় খটকা লাগছে। সাথের কাঁকড়ার জেলেদের সাথে এসেছিলাম তাদের ফেলা ফাঁদ দেখতে। কিন্তু এদের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে এই ফাঁদ তাদের না। নিজেদের ফেলা ডোয়া খুঁজতে ওদের এতো সময় লাগার কথা না।
সরাসরি ওদের জিজ্ঞেস করলাম। জানতে চাইলাম, তোমাদের ডোয়া কোথায়? ওরা বললো, আমাদেরটা তো এখনও পাতিনি ভাই। উত্তর দিকের বনের ভিতর একটা গেওয়া গাছের গোঁড়ায় পুঁতে রাখা আমাদের ডোয়ার বস্তা।
কথাটি ট্রলারে বসেই বলেছিলো তারা। বিশ্বাস করিনি। তবে এখন মনে হচ্ছে তারা সত্যি বলছে। সর্দারকে বললাম, তাহলে এই ফাঁদ কে পাতলো? সর্দার বললেন, সেটাই তো ভাবছি ভাই। এখানে তাহলে অন্য পার্টি আছে। বললাম, তাহলে কি এখানকার ফাঁস জালের জেলেরা এই কাজ করেছে?
কাঁকড়ার জেলেরা বললো, না ভাই। অন্য পার্টি আছে চরে। গত রাতে আরেকটা ট্রলার উঠেছে এই দ্বীপে। কথাটি শুনে বুকের ভিতরটা নড়েচড়ে উঠলো। বনদস্যুদের ট্রলার না তো?
(সুন্দরবন, নভেম্বর ২০১৬)