রূপান্তরের গল্প ৩১৮ | Rupantorer Golpo 318

পালাতে গিয়ে ফাঁদে আটকায় হরিণ | রূপান্তরের গল্প ৩১৮

পালাতে গিয়ে ফাঁদে আটকায় হরিণ | রূপান্তরের গল্প ৩১৮ | Rupantorer Golpo 318 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ৩১৮ : দা দিয়ে সমানে কোপ চলছে। হরিণ ধরার ফাঁদটি লম্বায় খুব বেশি বড় না। বড়জোর দুইশ মিটার হবে। ছোট্ট দ্বীপ। তার সামান্য অংশে কেওড়া বাগান। তাই বড় ফাঁদের দরকারও পড়ে না।

হরিণের হাঁটা চলার পথ এখানে সীমিত। জোয়ারের সময় সেই পথ আরও সরু হয়ে পড়ে। শিকারীরা বলে, ভাটায় দ্বীপের পূর্ব দিকের কেওড়া বাগানের ভিতর দিয়ে হাঁটে হরিণের পাল। মেই পথটুকুতে ফাঁদ পাতলেই কাজ হয়।

এতো কিছু আগে জানতাম না। এবার নেমে জানলাম, এই দ্বীপে হরদম শিকার চলে। তাই হরিণগুলো বেশ চালাক। ফাঁদ চিনে গেছে। তাই চলাফেরার পথে ওরা ফাঁদ বুঝতে পারে, এড়িয়ে যায়।

কিন্তু তাতে কি শিকারীরা দমে? হরিণের চেয়ে শিকারীর বুদ্ধি তো কম না। ফাঁদে ফেলতে তাই নিত্যনতুন বুদ্ধি বের করে তারা। এজন্য ফাঁদ পাতা থাকে জায়গা মতো। এরপর দেয় ধাওয়া।

এলোমেলো দৌড় দেয় হরিণের পাল। তখনই গিয়ে আটকা পড়ে ফাঁসে। আজ সেই ধাওয়া দেওয়ার আগেই আমরা এসে পড়েছি। ভয় পেয়ে দৌড়াতে গিয়ে হরিণ তিনটি আটকা পড়ে।

ডোয়ার ফাঁসগুলো বেশ মজবুত। মনে হয় ভালো কারিগর দিয়ে বানানো। দড়িগুলোও মজবুত। নাইলনের, বেশ মোটা। বড় হরিণ ধরার জন্য এই ফাঁদটি তৈরি করেছে শিকারীরা।

মনে হচ্ছে ওরা পেশাদার শিকারী। কিন্তু পুতনীর দ্বীপে এভাবে শিকার হয় জানা ছিলো না। সর্দার বললেন, আপনি তো ভাই ডাকাতের পিছে দৌড়াচ্ছেন। এই জঙ্গলে আরও কতো ঘটনা ঘটে। একটু খেয়াল করলেই বুঝতে পারবেন। বললাম, এতো বড় জঙ্গলে এতো কিছু খেয়াল করা যায়?

এবার মুখ খুললো জেলেরা। বললো, তারা এই দ্বীপে এসেছে গোনের শুরুতে, সপ্তাহ খানেক আগে। কাঁকড়া ধরাই উদ্দেশ্য। কলাতলার ওখান থেকে নদী পাড়ি দিয়ে এসেছে তারা। তারপর ডিঙ্গি নৌকাটি তুলে রেখেছে বনের ভিতর।

কোথায় তোমাদের নৌকা? ওরা বললো, বনের ভিতর একটা ঘন গড়ানের ঝোপ আছে। তার আড়ালে নৌকাটা তুলে রাখা। কাজ শেষে সেখানেই ফিরে তারা। থাকে নৌকার উপর, রান্নাবান্নাও হয় সেখানেই।

বললাম, চলো তোমাদের নৌকায় যাই। তবে তার আগে এই ডোয়াটা তুলে ফেলো। একজন বললো, ডোয়া নিয়ে কী করবেন ভাই? বললাম, এগুলো পোড়াবো তোমাদের আস্তানায় গিয়ে।

দড়িগুলো জড়ো করলো ওরা। বস্তায় ভরে নিয়ে হাঁটা দিলাম। মিনিট পনেরো হাঁটতে সামনে ছোট একটা খাল পড়লো। এখানে ভরা জোয়ারে পানি আসে। এখনও হাঁটু পানি। হেঁটে পার হলাম। ওই পাশটা গভীর বন।

দ্বীপচরের গেওয়া বনের শুরু এখান থেকে। ভিতরে যাবো কী যাবো না করছি। এমন সময় কুকু পাখি ডেকে উঠলো। তার মানে জোয়ার শেষ হলো। এখন পানি নামবে বন থেকে। জেলেরা বললো, বেশি দূর না ভাই।

সাহসে ভর করে হাঁটা দিলাম। আসলে করবোই বা কী? ঘুরতে ঘুরতে সুন্দরবনের এই দূর দ্বীপে আসা, এতো কিছুর সাক্ষী হওয়া, সব যেন কোনো বড় পরিকল্পনার অংশ। এর কোনো কিছুই আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না।

জঙ্গলে নেমে যেন এক নেশার মধ্যে পড়েছি। বিশাল গহীন এই বনের পরতে পরতে রহস্য। যতোই দিন যাচ্ছে রহস্যময় সুন্দরবনের কিছু কিছু কাহিনী ঘটছে চোখের সামনে। অবশ্য চোখের সামনে বলাটা ঠিক হবে না।

নৌকা বেয়ে সরু খাল, ট্রলারে করে বিশাল নদীর মোহনা পাড়ি দেওয়া, বনের ভিতরে হেঁটে বেড়াতে বেড়াতে চোখে পড়ছে এসব। পর্যটকদের মতো করে ঘুরলে এর কিছুই নজরে আসবে না।

অন্য কাজে যারা আসেন, দিনের পর দিন থাকেন, তাদের সামনে পড়ে না এসব। সুন্দরবন নিয়ে যারা লিখেন তাদের লিখার সাথে বাস্তবতা মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করি। বাস্তবতার সাথে সব সময় মিলে না। তখন বুঝি অন্যের কাছে শুনে লিখেন বলে মাঠের সাথে পুস্তকের মিল নাই।

তিন-চার মিনিট হাঁটতেই জেলেদের আস্তানায় পৌঁছে গেলাম। জায়গাটি বড় গেওয়া বনের ভিতর। গড়ানের ঝোপের আড়ালে নৌকা উঠানো। ডিঙ্গি নৌকাটির চারপাশে কাঁকড়া রাখার ক্রেট আর ঝুড়ি।

কাঁকড়া ভর্তি ক্রেটগুলো এক পাশে সাজিয়ে রাখা। পাশেই ছড়িয়ে ছিঁটিয়ে আছে আরও কয়েকটি খালি ঝুড়ি, কাঁকড়া বাঁধার প্লাস্টিকের সূতা, দড়ি, দা-কুড়াল আর কিছু লাকড়ি। নৌকার চারদিকে গড়ানের খুঁটি পোঁতা। তার উপর সামেয়ানার মতো করে টানানো একটি বিছানার চাদর। ছেঁড়া জাল দিয়ে তিন পাশ ঘেরাও দেওয়া।

সোজা নৌকার চুলার দিকে নজর গেলো। কী আছে ওতে? ভাবতে ভাবতে সরদার গিয়ে হাজির। চুলার ওপর হাঁড়িতে রান্না করা কাঁকড়া। আরেক পাতিলে আছে ভাত। এগুলো ওদের গত রাতের খাবার। আমাদের ট্রলারে এসে আটকা পড়ে ওরা। রাতে আর ফিরতে পারেনি।

সরদার বললেন, হাঁটতে হাঁটতে ক্ষুধা লেগে গেছে ভাই। বলেই চুলায় আগুন জ্বালিয়ে কাঁকড়ার তরকারিটা গরম করলেন। প্লেটে ঠান্ডা ভাত নিয়ে বসে পড়লেন।

নৌকা গিয়ে বসলাম। হাঁড়ি থেকে কাঁকড়া তুলে মুখে দিলাম। রান্নাটা কেমন জানি। মনে হলো কাঁচা কাঁকড়া খাচ্ছি। আমার অবস্থা দেখে সরদার বললেন, আপনারা যে বলেন জেলেদের রান্না ভালো হয়। এখন দেখছেন? সবার রান্না ভালো হয় না।

জেলেরা বেশ লজ্জা পেলো। বললো, আমাদের তো রান্নার অভ্যাস নাই ভাই। এক মুরুব্বি আমাদের রান্না করে। কিন্তু এবার সে আসেনি। তাই কোনো রকমে পেট ভরানোর রান্না করি আমরা।

তোমাদের ডোয়াটা কই? বলতেই একজন বনের ভিতর হাঁটা দিলো। এর মধ্যে খাওয়া শেষ করে চা চড়ালেন সর্দার। লাল চায়ে চুমুক দিলাম। সারা রাতের ক্লান্তি ভর করেছে শরীরে। এক কাপ গরম চা সেই ক্লান্তি কিছুটা দীর করলো।

মিনিট পাঁচের মধ্যে ফিরে এলো ছেলেটি। কাঁধের বস্তাটি নামালো। মুখ খুলে বের করলো দড়ির তৈরি হরিণ ধরার ফাঁদ যাকে স্থানীয় ভাষায় বলে- ডোয়া।

এই ডোয়াটি বেশ বড়। তবে দড়িগুলো পাতলা, পুরনো। জেলেরা বললো, এই ডোয়ায় বড় হরিণ আটকায় না ভাই। বললাম, ছোটগুলো আটকায়? সবশেষ কবে শিকার করছো? ওরা উত্তর দিলো না। বললাম, এটাই শেষ। আর যেন না শুনি!

দড়িগুলোতে আগুন দিতে চাইলেন সর্দার। বললাম, এখানে না ভাই। আগুন ছড়িয়ে যেতে পারে। সুন্দরবনের ভিতর কখনও আগুন লাগাবেন না। তাহলে কী এই দড়ির বস্তা বয়ে নিতে হবে? বললাম, একটু তো কষ্ট করাই লাগবে ভাই।

বের হলাম সবাই। যাবো ট্রলার যেখানে রাখা ওদিকে। জেলেদের বললাম, আমাদের এগিয়ে দাও তোমরা। তারপর কাজ গুছিয়ে বাড়ির পথ ধরো। ওরা বললো, এই মরা গোনটা না থাকলে ভাই চালান টিকবে না। এতোগুলো টাকা খরচ করে আসছি।

জেলে বহরের প্রধান বললো, ডাকাতের চাঁদা দিছি ত্রিশ হাজার। যাওয়ার সময় ফরেস্টারদেরও দিতে হবে প্রায় ত্রিশ হাজার টাকা। কাঁকড়া নিয়ে ফিরার পথে টহল ফাঁড়িগুলোতে দিতে দিতে যেতে হয়। তা না হলে আম ছালা সব যাবে।

কী বলবো আমি? বুঝতে পারছি না। বললাম, যা পারো করো। তোমাদের সুন্দরবন তোমরাই ধ্বংস করো। আসলে এদিকের বাস্তবতা অন্য রকম। আইন-নিয়ম মানতে গেলে ওদের পেট চলে না। পেট চালাতে গেলে আইন থাকে না।

ফিরতি পথ ধরলাম। যাবো চরের দিকে। ভাটায় পানি কিছুটা কমেছে। পুরো ভাটা হতে হতে সকাল দশটার মতো বাজবে। তখন ঝাঁকি জাল নিয়ে মাছ ধরতে নামবো চরের খালে খালে। এই দ্বীপের ভিতর কয়েকটি ছোট ছোট খাল আছে। মাছ ভালোই পাওয়া যায়।

সর্দারকে বললাম, মাছ ধরবো। কিন্তু কিন্তু ট্রলারে তো পেঁয়াজ নাই। মনের ভিতরটা কিন্তু খচখচ করছে। বলতে বলতে সর্দার তাঁর হাতের গামছাটা দেখালেন। এক পাশে পোঁটলা করে বাঁধা কী যেন!

ওর মধ্যে কী ভাই? জানতে চাইলাম সর্দারের কাছে। বললেন, এই ভুল আমি করি ভাই? এর ভিতরে পেঁয়াজ। আসার সময় জেলেদের নৌকা থেকে কয়টা পেঁয়াজ নিয়ে আসছি। আর কোনো টেনশন নাই।

আরেক হাতে কী? সর্দার বললেন, চুঁইঝাল। এরা তো ভাই হরিণ ধরে আর খায়। রান্না জানে না। কিন্তু চুঁইঝাল ঠিকই নিয়ে আসছে। স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে বললেন, আর কোনো চিন্তা নাই ভাই, এবার রান্না জমবেনে!

বললাম, রান্না জমবে ঠিক আছে। কিন্তু এই দ্বীপটাও তো দেখি জমে আছে। কী সব চলে এখানে? সর্দার বললেন, কেবল তো আসলাম ভাই। এই দ্বীপে আরও লোকজন আছে। যে ডোয়া তুললাম আমরা ওর মালিকেরাও আছে। ওদের খুঁজে বের করতে হবে না?

(সুন্দরবন | নভেম্বর ২০১৬)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top