জেলেরা হত্যা করে গালকাটা রবিউলকে!!! | রূপান্তরের গল্প ৩২ | ১ম খণ্ড | Rupantorer Golpo 32 | Part -1 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ৩২ | ১ম খণ্ড : আগে সুনির্দিষ্ট ভাবে দুই দফা ব্যর্থ হয়েছি। দস্যুদের আত্মসমর্পণের এটাই শেষ চেষ্টা আমার। ২০১১ সালে রাজু বাহিনী, তারপর শহীদুল/ইলিয়াস বাহিনী। প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন সংশ্লিষ্টরা। তখনই ভেবেছিলাম কাজটি আর এগুবে না। তবুও যোগাযোগ রেখেছিলাম সুন্দরবন দাপিয়ে বেড়ানো সেই সন্ত্রাসীদের সঙ্গে। শেষ দফার সুযোগটি আসে হঠাৎ করেই। বড় দস্যুদলটির নেতৃত্বে পরিবর্তন আসায় সুযোগটি আসে। অপ্রত্যাশিত সেই সুযোগটি কাজে লাগানোর শেষ চেষ্টা ছিলো।
সড়ক পথে ঢাকা ফিরছিলাম। সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত কয়েক দফায় মাস্টার বাহিনীর সদস্য সোহাগের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের সদস্য গালকাটা রবিউল তখনও ফিরেনি। নিখোঁজ আরও ৭জন অপহৃত জেলে।
সেই রাতে সুন্দরবনের ভিতরে ঘটে যায় এক রোমহর্ষক ঘটনা। ঝাইলোর খালের সেই গোলাগুলির সময় সাতজন জেলেকে নিয়ে আলাদা হয়ে যায় দস্যু রবিউল। দস্যু জগতে তার নাম ছিলো গালকাটা রবিউল। গালে বড় একটা কাটা দাগ। রবিউলের চেহারাটা আমার স্পষ্ট মনে পড়ে। হাতের বন্দুকটি ছিলো দোনলা। বাঁট ও ট্রিগার ছিলো পিতলের।
কোস্টগার্ডের সাথে সংঘর্ষের সময় রবিউল অপহৃত সাত জেলেকে নিয়ে উল্টো দিকে চলে যায়। মাথায় তার অন্য চিন্তা। কাগা দোবেকী খাল পেরিয়ে তারা সেখানকার বন টহল ফাঁড়ীর পিছনের একটি খালে অবস্থান নেয়। জেলেদের বলে ফরেস্ট অফিসে উঠবে তারা। কিন্তু পরের দিন। ততোক্ষণে ক্ষুধায় দিশেহারা সবাই। একটা কাঁকড়ার নৌকা ধরেছে তারা। কিন্তু তাদের বাজার শেষের দিকে। ওই চাল দিয়ে সকলের দুই বেলার খাবারও হয়নি। খাবার পানিরও সংকট।
রাতের বেলা একটা কেওড়া গাছে ওঠে রবিউল। জেলেদের কাছ থেকে ফোন নাম্বার নিয়ে মুক্তিপণের টাকা দাবি করে। ওদিকে এই জেলেদের কয়েজনের মুক্তিপণ মাস্টার বাহিনীর কাছে পরিশোধ করেছে পরিবার থেকে। তাদের কাছে রবিউল আবার মুক্তিপণ চায়। জনপ্রতি তিন লাখ টাকা না দিলে জেলেদের পানি মাপতে পাঠানো হবে বলেও হুমকি দেয়। “পানি মাপা” কথাটি নিয়ে নিশ্চয়ই খটকা লাগছে? সুন্দরবনের দস্যু জগতে কাউকে মেরে ফেললে এই কথাটি বলা হতো। অর্থাৎ কাউকে মেরে পানিতে ফেলে দিয়ে হত্যাকারীরা বলতো যে পানি মাপতে পাঠালাম।
ওই সাতজন জেলে ভেবেছিলো দ্রুত মুক্তি মিলবে। কিন্তু ঘটনা সব উল্টো ঘটতে শুরু করলো! আবার কোত্থেকে মুক্তিপণ দিবে তারা? এমনিতেই গেলো এক সপ্তাহের জিম্মি দশায় বিপর্যস্ত তারা। দস্যু রবিউল তখনও গাছের মগডালে। শীতের রাত। আর শরীর চলছে না সবার। অন্ধকারের মধ্যে ফিসফিসিয়ে রবিউলকে পানি মাপতে পাঠানোর পরিকল্পনা করে ফেললো তারা।
গাছ থেকে নামতেই একজন বন্দুক ধরে টান দিলো। সবাই মিলে পিটিয়ে-কুপিয়ে যা করার করলো। রবিউলের মরদেহটি তারা কী করেছিলো তা আর জানতে পারিনি শেষ পর্যন্ত। শুনেছি সেখানেই কবর দেয়া হয়েছিলো। আর অস্ত্র-গুলি ফেলে দেয় নদীতে। তারপর কাঁকড়ার নৌকাটির সহযোগিতা নিয়ে তারা ফিরেছিলো লোকালয়ে।
প্রসঙ্গে ফিরি। সুন্দরবনে দস্যুতায় টাকা ছিলো। কিন্তু সেই অবৈধ টাকা নিজেরা উপভোগ করতে পারতো না দস্যুরা। বরং কঠিন এক জীবন কাটতো তাদের। দিনে এক ঘন্টা শান্তির ঘুমও দেয়ার উপায় ছিলো না। অন্যদিকে তাদের টাকাগুলো দিয়ে পকেট ভরতো সুশীল দর্শন শহরের মানুষেরা। তাই জঙ্গলের দুর্বিসহ জীবন থেকে দস্যুরা মুক্তি চাইছিলো। আমার কাছে মনে হয়েছিলো, দস্যুদের সাধারণ জীবনে ফেরার পথ করে দিলে হয়তো সুন্দরবন ছেড়ে চলে আসবে সবাই। সুন্দরবন হতে পারে দস্যুমুক্ত। এসব নিয়ে আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে ঢাকা ফিরলাম গভীর রাতে। বিশ্রাম নিতে হবে, লম্বা বিশ্রাম!!!
(ছবি: দস্যুদের হাতে জিম্মি ছিলো এই জেলেরা। নভেম্বর, ২০১৫)