রূপান্তরের গল্প ৩২১ | Rupantorer Golpo 321

শিকারী ধরা! | রূপান্তরের গল্প ৩২১

শিকারী ধরা! | রূপান্তরের গল্প ৩২১ | Rupantorer Golpo 321 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ৩২১ : সাপের আখড়া ওই গেওয়া বন। গড়ানের ঝোপগুলোর গোঁড়ায় গোঁড়ায় কেউটে সাপের ঘর। গরম কালে ওরা বাইরে থাকে। শীতকালেও দেখা যায় মিঝে মাঝে। মাঝে মাঝে পুতনীর দ্বীপে আসি আমরা। কিন্তু আমরা ভয়ে ওই বনের ভিতর ঢুকি না।

আমরা আছি চরের উপর। ওই জঙ্গলের ভিতর থেকে উঁকি মারছে শিকারীরা। ভিতরটা একদম দেখা যায় না। পুতনীর দ্বীপের এই গেওড়া-গড়ানের বন ভীষণ গভীর, বন্য। তার ভিতরে সুন্দরবনের মানুষেরা অনায়াসে হেঁটে বেড়ায়, সাময়িক বসতি গড়ে।

ছোট একটা দ্বীপ। ওদের কাছে এখানে আসা বড় কোনো ব্যাপার না। চারপাশে জলরাসি। নদী আর সাগরের সংযোগস্থল। তাই পানি থাকে উন্মাতাল। মাঝে মাঝে বিশাল বিশাল তুফান ওঠে। অপরাধীদের জন্য সেই ঝঞ্ঝাময় সময়টা বেশ সুবিধার। কোনো রকমে এসে পড়লেই হয়। বনরক্ষীরা সে সময় আসে না। কিন্তু এই স্বাভাবিক পরিবেশে শিকারীদের এই দ্বীপে আসা সাহসের ব্যাপার।

কারা ওরা বলেন তো? এতো সাহস ওদের হলো কী করে? মামুন বললো, চোর ডাকাতের সাহস একটু বেশি হয় ভাই। ওরা সব সাইড ম্যানেজ করে চলে। সব কিছুই হিসাব করা। শুধু আমাদের এখানে আসাটা হিসাবের বাইরে হয়ে গেছে। ধরা খাইছে এজন্যই।

বেলায়েত সর্দার বললেন, শোনেন ভাই। এই বাদাবনের যেখানেই যাবেন জেলেদের দেখা পাবেন। হয় মাছ ধরার জেলে অথবা কাঁকড়া শিকারী। ওরা সবাই হরিণ শিকার করতে জানে। জঙ্গল করা মানুষ কিন্তু শিকার জানে না এমন লোক এই তল্লাটে খুব কম।

জানতে চাইলাম, ওরা কারা বলতে পারেন? সর্দির বললেন, ট্রলারের গড়ন দেখে মনে হয় সাতক্ষীরার ওদিকের। সুন্দরবনে বিভিন্ন এলাকার মানুষ আসে। ওদের নৌকা বা ট্রলারের গঠন দেখলে বুঝা যায়। কিন্তু এটা তো ভাড়া করা ট্রলার। তাই হুট করে বলা যাবে না কোথাকার। বলেই উঠে দাঁড়ালেন তিনি। বললেন, আমি যাই। ওদের ডেকে নিয়ে আসি। আপসে না আসলে ধরে নিয়ে আসবো।

দাঁড়িয়ে জঙ্গলের দিকে ঘুরলেন সর্দার। একজন মাথাটা বের করে দেখছে আমাদের। চিৎকার করে বললেন, এই তোরা আসবি? নাকি দাবড়ায়ে ধরবো? টুপ করে জঙ্গলের ভিতরে ঢুকে পড়লো লোকটি।

ঝুপ করে লাফিয়ে পড়লেন সরদার। বললেন, ও কাকু নামো, মামুন নাম। দুই সেকেন্ডের মধ্যে নামলো ওরা। কোনো কথাবার্তা ছাড়া নেমে পড়লো তিন জেলে। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই দিলো দৌড়।

মিনিট খানেক সময় লাগলো না। দৌড়ে জঙ্গলে ঢুকে পড়লো আমাদের লোকজন। হারিয়ে গেলো ওরা। কিছুক্ষণ জঙ্গলের গাছ ভাঙ্গার শব্দ পেলাম। তারপর সব চুপ। নতুন দুশ্চিন্তায় পড়লাম আমি।কতো রকমের অঘটন হতে পারে ওখানে!

এই মুহুর্তে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করার নাই। জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে থেকেও কোনো লাভ নাই। বরং ট্রলারের ছাউনিতে ঢুকে একটু বিশ্রাম নেই।

কখন চোখ লেগে গেছে বুঝতে পারিনি। দুই রাত জাগা। দৌড়ঝাঁপও কম করিনি। ক্লান্তি নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি। যদিও এমন পরিস্থিতিতে একা থাকলে ঘুমানোর নিয়ম নাই। কখন কোন বিপদ আসে! কিন্তু আমার শরীর সেই নিয়ম মানলো না।

ঘুম ভাঙ্গলো। কতোক্ষণ ঘুমিয়েছি জানি না। তবে চোখ থুলতে পারছি না। কথাবার্তা শুনছি। একজন আরেক জনকে গালি দিচ্ছে। চোখ বন্ধ করেই ডাক দিলাম মামুনকে। গলায় জোর নাই। আমার ডাক ওদের কারও কানে যাচ্ছে না।

উঠে বসলাম। ছই থেকে বের হয়ে ট্রলারের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। দেখি নতুন দুইজন। সারা গায়ে কাদা। হাত দুটো দড়ি দিয়ে বাঁধা। মামুনকে বললাম, দড়ি খুলে দাও। সে বললো, খুলে দিলে আবার দৌড় দিবে ভাই। বললাম, দৌড় দিলে দিক। খুলে দাও।

গোবেচারা চেহারা। তবে শরীরের গঠন মজবুত। সুন্দরবনের মানুষদের গঠন যেমন হয়, তেমনই। নাম জানতে চাইলাম। বললাম, বাড়ী কোথায়? উত্তরে তারা বললো, কেন মামা। আপনি আমাদের চিনেন না?

মনে করতে পারছি না। তবে একটু চেনা চেনা লাগছে। ওদের বাড়ি গাবুরা। সাতক্ষীরার শ্যামনগরের দ্বীপ জনপদ গাবুরা। বললো, ওই যে মজনু ডাকাতকে যেবার সারেন্ডার করালেন, তখন আমরা নৌকা নিয়ে গেলাম। কাঁকড়ার জেলে আমরা। বললাম, বুঝছি। কিন্তু তোমরা কি এখানে কাঁকড়া ধরতে আসছো?

ওরা বললো, না মামা। সাগর মেলায় গেছিলাম। ফিরার পথে ট্রলার নষ্ট হলো। তাই এই দ্বীপে এসে উঠছি। বললাম, তোমরা কী করছো জানি আমি। মিথ্যা কথা কেন বলো? তোমাদের ট্রলারে হরিণের মাংস। এখানে কয়দিন ধরে শিকার করছো সে কথা বলো। আর সাথে আর যারা আছে তাদের জঙ্গল থেকে নিয়ে আসো। আমরা তো আর প্রশাসনের লোকজন না। ভয় পেও না।

দুইজন একসাথে হাঁটা দিলো। সর্দার বললেন, দুইজন কই যাও? একজন থাকো। একজন যাও। সাথে মামুন যাও।

ওরা রওনা দিলো। সাথে আরও চারজন আছে। ওরাও গাবুরার বাসিন্দা। এসেছিলো রাসমেলায়। তবে মূল উদ্দেশ্য শিকার। পেশাদার হরিণ শিকারীদের ভাড়া করে নিয়ে এসেছে একটি দল।

বেলায়েত সর্দারসহ বাকীরা হাঁপাচ্ছে। সর্দার বলে, বিশাল দৌড় দিলাম ভাই। ওরা এতো বড় শয়তান, চিন্তাও করতে পারবেন না। বললাম, এই জঙ্গলে শিকার করতে আসছে যারা তারা ভদ্রলোক হবে কে বললো? সর্দার বললেন, তা বলিনি। কিন্তু ওরা বেশি খারাপ। ওরা জানে যে এখান থেকে পালানোর কোনো জায়গা নাই। ছোট্ট দ্বীপ। চারপাশে নদী-সাগর। তারপরও কী দৌড়ান টা দৌড়ালো!

হাত-পা ধুয়ে ট্রলারে উঠলো সবাই। চা তুললেন শহীদুল কাকা। আধা ঘন্টার মধ্যে সঙ্গী সাথীদের সাথে ফিরলো মামুন। সবাই তরুণ। পরিচয় জানতে চাইলাম না। শুধু বললাম, তোমরা খুব খারাপ কাজ করছো। ট্রলারে যাও। হরিণের মাংসগুলো গর্ত করে পুঁতে ফেলো। ওরা হাঁটা দিলো।

মামুন ট্রলারে উঠলো। পাশে এসে দাঁড়ালো। বললো, এদের সাথে জাহাঙ্গীর বাহিনীর সম্পর্ক আছে। দস্যুনেতা নাটা জাহাঙ্গীরের শশুরবাড়ি সাতক্ষীরার ওদিকে। এই লোকগুলোর মধ্যে দস্যুনেতার ছোট স্ত্রী ময়নার আত্মীয়।
ট্রলার থেকে নেমে ওই ট্রলারে গেলাম। ওরা বেশ বিরক্ত। রাগে গজগজ করছে একটা ছেলে। কথার উত্তর দিচ্ছে না। বললাম, তুমি ময়নার কে হও? আমার মুখে দস্যুপত্নীর নাম শুনে চমকে উঠলো। বললাম, কালিঞ্চির ওদিকে বাড়ি? এবার মুখ খুললো সে। বললাম, তোমরা নিজেদের এতো বুদ্ধিমান মনে করলে হবে?

ছেলেটি বললো, আমরা তো মাঝে মাঝেই আসি। কেউ কিছু বলার সাহস পায় না। আজকে আপনারা এসে ভয় ধরায়ে দিছেন। আমি ডাকাত সরদারের আত্মীয়। জাহাঙ্গীর এখন সবচেয়ে বড় দস্যুনেতা।

একটু রাগ হলো। মামুনকে ডেকে বললাম, ওই ছেলেটাকে দড়ি দিয়ে বাঁধো। বেঁধে ট্রলারে তোলো। হরিণের মাংসগুলো নিয়ে আসো। এদের ফরেস্টের হাতে তুলে দিবো। মামুন তাকিয়ে আছে। বললাম, দেরি করো না। যা বলছি শোনো। এরা কখনও ভালো হবে না। বলতেই ছেলেটি এসে হাত ধরে বসলো। বললো, আর আসবো না।

গল্পে বসলাম। শুনলাম, জাহাঙ্গীর ওই আইড়ো শিবসা আর শিবসা নদীর কোথাও আছে। ফিরে যাওয়ার সময় এদের ওই দস্যুদের সাথে দেখা করার কথা। কিন্তু নোয়া বাহিনী এদিকে থাকায় জাহাঙ্গীর আসেনি। ছেলেটি বললো, আর কারও সাথে দেখা করার দরকার নাই। আমাদের ছেড়ে দেন ভাই। বললাম, পুরো জোয়ার না আসলে তো ট্রলার ভাসবে না। অপেক্ষা করো।

দস্যুকবলিত সুন্দরবনে নানা রকম অপকর্ম চলে। সেই অপরাধগুলোর পৃষ্ঠপোষকতা করে দস্যুরা। বন বিভাগের কর্মীরা তাদের ধরতে গেলে দস্যুরা এসে চড়াও হয়। কখনও ফরেস্ট অফিসে এসে মারধোর করে, অসম্মান করে।

মাস্টার বাহিনীর আত্মসমর্পণের সময় দেখেছি, বনদস্যুদের দাপটে বনরক্ষীরা নিতান্ত অসহায়। এভাবে চললে বন সুরক্ষিত থাকবে কী করে? শুধু বাঘের সংখ্যার হিসাব যদি সুন্দরবনের ভালো থাকা বা মন্দ থাকার মাপকাঠি হয় তবে শেষ পর্যন্ত কি সুন্দরবনের ভালো থাকা হবে? হয়তো বাঘের সংখ্যা বাড়বে। কিন্তু বনের বাকী প্রাণবৈচিত্রগুলো যদি সুরক্ষিত না থাকে তাহলে শেষ পর্যন্ত সুন্দরবনকে বাঁচানো যাবে?

বাঘের জীবন চক্রের সব উপাদান যদি সুন্দরবনে না থাকে তাহলে বাঘ টিকবে কী? হাজারও চিন্তা আসে মাথায়। আমি এতো কিছু পরিস্কার বুঝি না। এসব নিয়ে বিজ্ঞানীদের গবেষণা না থাকলে আমার কথায় কিছু আসবে যাবে?

(সুন্দরবন, নভেম্বর ২০১৬)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top