ধাক্কা দিয়ে পালালো শিকারীদের ট্রলার | রূপান্তরের গল্প ৩২২ | Rupantorer Golpo 322 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প৩২২ : বিচ্ছিন্ন এই দ্বীপে শিকার করতে আসা দুই চোরা শিকারী সামনে বসা। তাদের একজন ওই ট্রলারে। সর্দারসহ অন্যরা তাদের ধরে এনেছে। তারপর থেকে আমাদের সাথেই তারা। একসাথে নাস্তা করেছি। তখন থেকে শুনছি তাদের কাহিনী। রাসমেলার পনেরো দিন আগেই সুন্দরবনে ঢুকেছে তারা। হরিণ শিকারই উদ্দেশ্য। ওরা বলছে, শখের শিকারী। কিন্তু আমার বিশ্বাস হয় না। কারণ শখের শিকারী হলে মেলার আগে আগে নামতো। পনেরো দিন আগে না। ওরা পেশাদার শিকারী। রাসের যাত্রীদের কাছে হরিণ বিক্রিই তাদের উদ্দেশ্য। কথায় কথায় জানলাম, নামার আগেই হরিণের অর্ডার নিয়েছে ওরা। তাদের একজন মহাজনও আছে। তার কাছ থেকে দাদন নিয়ে নেমেছে শিকারীরা।
শিকারীদের ট্রলার একটু দূরে ভাসছে। সেখানে উঠো ওদের আরেকজন তন্ন তন্ন করে কী যেন খুঁজছে। ওদিকে তাকিয়ে রহস্যময় হাসি দিচ্ছেন বেলায়েত সর্দার। আমি ভাবছি এই শিকারীদের ছাড়বো কখন? ওরা থাকলে আমাদেরও ঝামেলায় থাকতে হবে। সর্দারকে বললাম, এদের নাম ঠিকানা নিয়ে ছেড়ে দিন। উনি বললেন, ছাড়তাম ভাই। কিন্তু ওরা আমাদের এতো কষ্ট দিলো কেন? সামনে বসা এক শিকারী বললো, ভয় পাইছিলাম ভাই। ভাবছি আপনারা প্রশাসনের লোক।
পুতনীর দ্বীপে জোয়ারে ভাসছে দুটি ট্রলার। চারপাশ বেশ পরিস্কার। দূর থেকে যে কেউ আমাদের দেখতে পাবে। পাশাপাশি দুটি ট্রলার ভাসতে দেখলে যে কেউ ভাববে এগুলো দস্যুদের। ভয়ে কেউ পাশে আসবে না। জেলেরা এমনিতেই ভয় পাবে। বনরক্ষীরাও আশেপাশে আসবে না। আমাদের দেখলে দস্যুদলও দূরে সরে যাবে।
থৈ থৈ করছে পানি। দেখতে দেখতে আড়পাঙ্গাসিয়া মোহনার ছোট্ট দ্বীপটি পরিণত হলো বিশাল জলরাশিতে। চরগুলো ডুবে গেলো। খাল আর চর এখন বরাবর।
পানিতে তীব্র চাপ। মনে হচ্ছে ভিতর থেকে ফুঁসে উঠছে। যদিও পানির উপরটা স্থির। বাতাসে হাল্কা ঢেউ লাগছে। তার ভিতরে দৌড়ে বেড়াচ্ছে পারশে মাছের পোণার দল। ছোট মাছগুলোর পিছনে দৌড়ে বেড়াচ্ছে বড় মাছ। এখানে তাইড়েল মাছের আনাগোণা বেশ দেখছি। জেলেরা বলে সিলেট মাছ। কেউ বলে লাক্ষা। পুরো বন জুড়ে এই মাছটির নড়াচড়া বেশি দেখি।
বন্যা জোয়ার এখন। মানে পূর্ণ জোয়ার। দেখতে দেখতে পানি উঠে পড়লো উত্তর পাশের গেওয়া বনে। ভাবছি বনের ভিতরের বন্যপ্রাণিগুলোর কী হবে এখন? একজন বললো, এই পানিতে ওদের কোনো সমস্যা হবে না ভাই। ভিতরে চাতাল আছে।
চাতাল মানে? ছেলেটি বললো, জঙ্গলের ভিতরে উঁচু জায়গা আছে। বড় জলোচ্ছাস না আসলে ওই পর্যন্ত পানি উঠে না। সাধারণ জোয়ারের পানি থাকে অল্প সময়ের জন্য। বাকী সময় শুকনা থাকে। হরিণ-শুকরসহ অন্য প্রাণিরা ওই চাতালে গিয়ে থাকে। ভাটায় পানি সরলে আবার যে যার মতো ছড়িয়ে যায়।
হরিণ শিকারীরা বের হওয়ার পথ খুঁজছে। কারণ জোয়ারে তাদের ট্রলারটিও ভেসেছে। এতোক্ষণে ছাড়তো। কিন্তু ঝামেলা করে রেখেছেন আমাদের সর্দার। ইঞ্জিন চালু করার হ্যান্ডেলটি নিয়ে রেখেছেন। ট্রলারের ইঞ্জিন চালানোর জন্য এই ধাতব হ্যান্ডেলটি চাবির কাজ করে।
চাবি না পেয়ে দিশেহারা শিকারীরা। জাহাঙ্গীর ডাকাতের শ্বশুর পক্ষের আত্মীয় বলে এই বাদা-বনে তারা যা ইচ্ছা তাই করে। বনরক্ষীরাও নাকী তাদের গায়ে হাত দেওয়ার সাহস পায় না। জেলেরাও ভীষণ ভয় পায়। কিন্তু আমার সামনে পড়ে অসম্ভব বেকায়দায় ওরা। বার বার অনুরোধ করছে যাতে ছেড়ে দেই। বললাম, চলে যাও তোমরা।
সর্দার বললেন, ওরা যাবে কী করে ভাই? চাবি তো আমার হাতে। এটা না নিলে ওদের এতোক্ষণ রাখতে পারতেন? তিন সিলিন্ডারের ইঞ্জিন। আমাদেে ট্রলার ধ্বসায়ে দিয়ে বের হতো। চিনেন এদের? বললাম, ওরাও আমাদের চিনে না। বলতেই হেসে উঠলো সবাই। নাম-ঠিকানা আর ফোন নাম্বার লিখে রাখলাম। বললাম, আবার যদি শুনি তোমরা শিকারে আসছো তাহলে তোমাদের নামগুলো প্রশাসনের কাছে দিবো। সর্দারকে ইশারা করলাম। ট্র্রলারের ইঞ্জিন চালানোর হ্যান্ডেলটি দিয়ে দিলেন।
চরের উপর পানি এখন বুক সমান। ভাটা শুরু হয়েছে। দ্রুত নেমে যাচ্ছে পানি। শিকারী যুবকরা ঝুপ করে পানিতে নামলো। আধা সাঁতারে, আধা হেঁটে গিয়ে উঠলো তাদের ট্রলারে। আমাদের থেকে ওদের দূরত্ব আনুমানিক ৫০ ফুট।
হ্যান্ডেলটি নিয়ে ইঞ্জিন চালু করলো ওরা। আমি ওই পশ্চিমে বেহালা খালের মুখে একটি ফিসিং ট্রলারের দিকে তাকিয়ে। এমন সময় চিৎকার করে উঠলো মামুন আর শহীদুল কাকু। তাকিয়ে দেখি আমাদের বরাবর এগিয়ে আসছে শিকারীদের ট্রলার। আমি শক্ত করে ধরে বসলাম। মুহুর্তের মধ্যে আমাদের ট্র্ররারের গলুইয়ের দিকে ধাক্কা দিলো। ভাসমান থাকায় বড় ক্ষতি হয়নি। ওরা সাথে সাথে ব্যাক গিয়ার দিয়ে পিছিয়ে যায়। মুখ ঘুরিয়ে তীব্র বেগে ছুট দিলো ওরা।
কী হলো বুঝতে পারলাম না। ওরা এতো হিংশ্র? চিৎকার করতে করতে ট্রলারের গলুইয়ে চলে গেলেন সর্দার। পিছনে পিছনে আমিও গেলাম। লাফ দিতে যাবে, এমন সময় পিছন থেকে ধরে ফেললাম। বললাম, পানিতে নামলে আপনার উপর দিয়ে ট্রলার চালাবে ওরা। পিছনে ফিরে মামুনকে বললাম, নোঙ্গর তোলো। শহীদুল কাকুকে বললাম, স্টার্ট দেন।
শিকারীদের ট্রলারটি তুমুল বেগে ছুটছে বড় নদীর দিকে। আমরা তাকিয়ে আছি। সর্দার বললেন, এবার মজা দেখেন ভাই। সাথে সাথে মাথায় আসলো, ওরা ভুল পথে ট্রলার চালাচ্ছে। ওদিকে পানির নিচে চর বেশ উঁচু। বালির ঢিবি পুরোটা জুড়ে। তার মধ্যে ভাটা শুরু হয়েছে। ওরা মনে হয় আটকা পড়বে।
ভাবতে ভাবতে ঘটনা ঘটে গেলো। তীব্র বেগে ট্রলার ধাক্কা খেলো। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা যুবকটি পড়ে গেলো পানিতে। বাকীরাও হুমড়ি খেয়ে পড়লো। আমাদের ট্রলারে দাঁড়িয়ে কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি ওদের কান্ড।
সুকিনাতে দাঁড়ানো ছেলেটি ইঞ্জিনের শক্তি বাড়িয়ে দিলো। কালো ধোঁয়া বেরুচ্ছে। ট্রলার ছাড়ানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না। সর্দার এবার চিৎকার করে গালি দিলেন ওদের। বললেন তোরা থাকিস ওখানে, আমি আসতিসি!
আমরা কেউ যাবো না ওখানে। আক্রমণ করে বসতে পারে। এমনিতেই ট্রলারে ধাক্কা দিয়ে বিরাট ক্ষতি করতে চেয়েছে। খুব সাবধান থাকতে হবে। বনের ভিতরে সাগর পাড়ের এই দ্বীপে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে বিপদ বাড়বে। শহীদুল কাকু আর মামুনকে উদ্দেশ্য করে সর্দার বললেন, এই তোরা নামিস না কেন? আবারও থামালাম ওদের। বললাম, মাথা গরম করে কিছু করা যাবে না। এমনিতেই বড় বিপদ গেছে।
কয়েক মিনিট চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো ওরা। ট্রলার ছাড়াতে পারলো না। এখানকার চরের যে অবস্থা তাতে আবার ভরা জোয়ারের আগে ওরা ছুটতে পারবে না।
শিকারীরা এবার আরেক আজব কাজ করে বসলো। দ্রুত কিছু জিনিষপত্র নিয়ে নেমে পড়লো পানিতে। কোনো রকমে সাঁতড়ে চলে গেলো গেও বনের দিকে। হাঁচড়ে পাঁচড়ে গিয়ে ঢুকে পড়লো বনের ভিতর।
এখন কী করবো আমরা? সর্দার বললেন, এর শেষ না দেখে কী যাওয়া যায় ভাই? বললাম, আমিও তাই ভাবছি। শেষে কী হবে জানি না। তবে এর শেষ না দেখে এই দ্বীপ ছাড়ছি না।
উত্তেজনায় ঘেমে গেছি। উত্তরা বাতাসেও যেন আমাদের শীতল করতে পারছে না। সর্দার বললেন, চলেন ভাই গোসল করে নেই। বলেই গামছা পড়ে পানিতে ঝাঁপ দিলেন সর্দার। আমিও গামছা পড়ে নিলাম। সাথে মামুনও লাফিয়ে পড়লো পানিতে। লবণ পানিতে কিছুক্ষণ সাঁতড়ে নিলাম। মামুনের হাত ধরে ফিরে এলাম ট্রলারে।
গরম চা হাতে দাঁড়িয়ে আমাদের শহীদুল কাকু। উঠে গা মুছে কাপড় পাল্টে নিলাম। চায়ে চুমুক দিতেই শরীরটা চাঙ্গা হলো। রাত জেগে থাকা শরীর-মন এখন বেশ উৎফুল্ল। সর্দারকে বললাম, আপনি এবার ফিরে আসেন। এখানে পানিতে সাপের অভাব নাই। সামুদ্রিক সপগুলো কিন্তু বেশ বিষধর হয়। সর্দার বললেন, সাপ কিছৃ বলবে না ভাই। ওরা মানুষের মতো বেঈমান না। শুধু শুধু আক্রমণ করে না।
সত্যিই তো। শিকারীদের এই দলটিকে আমরা কিছুই বলিনি। চাইলে আটকে রেখে বনরক্ষীদের দিয়ে ধরিয়ে দিতে পারতাম। ওরা আর কখনও এই অপকর্ম করবে না বললো। তাই ছেড়ে দিলাম। আবার ভাবছি, আমরা ওদের ধরার কে? ছাড়ারই বা কে? সর্দার বললেন, এরা মানুষ না ভাই! সুন্দরবনের শিকারীরা মানুষের পর্যায়ে পড়ে না।
শহীদুল কাকা সরিষার তেল এগিয়ে দিলেন। লবণ পানিতে গোসলের পর একটু তেল মাখানো লাগে। এমনিতেই রোদে পোড়া ত্বক। তাতে সরিষার তেল ওণুধের কাজ করে। এ কাজে মামুন একটু সহযোগিতা করলো। তারপর উঠে গেলো রান্নাঘরের দিকে। যা কিছু হোক, দুপুরের খাবার তো খেতে হবে।
সর্দার পানিতে ডুব দিয়ে দিয়ে ট্রলারের তলা পরখ করে নিচ্ছেন। ওই ট্রলারের ধাক্কায় কয়েকটি তক্তায় ফাটল ধরেছে। তবে তলার মেরামত করা তক্তাগুলো ঠিক আছে। পিছনে প্রোপেলার চেক করে উঠে পড়লেন সর্দার। বললেন, ভাটা হোক। তারপর ওই শিকারীদের ট্রলারে অভিযানে যাবো।
চর থেকে পানি নামতে আরও ঘন্টা দুই সময় লাগবে। এর মধ্যে রান্না হবে। দুপুরের খাবারে থাকবে ভাত, মরিচ ভর্তা আর দাতিনা মাছ ভাজা। এর মধ্যে ভাত উঠেছে চুলায়। গলুইয়ে সর্দার বসেছেন মাছ কুটতে।
সুন্দরবন, নভেম্বর ২০১৬