গেওয়া বনে মিলিয়ে গেলো শিকারীরা | রূপান্তরের গল্প ৩২৩ | Rupantorer Golpo 323 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ৩২৩ : ও ভাই, দাইতনে মাছগুলো কেমন চকচক করতিসে দেখিসেন? সর্দারের সেই চির চেনা ডাক শুনে উঠে বসলাম। মাছগুলো কেটেকুটে পরিস্কার করা ধোয়া। রোদ পড়ে রূপার মতো চকচক করছে। ডেক এর উপর বসে চোখ ডলতে ডলতে বললাম, আমি একটু ঘুমাই। শরীর আর চলছে না। রান্না শেষ হলে ডাক দিয়েন। সর্দার বললেন, আমরা এই দ্বীপে আসলাম একটু ঘুমাবো বলে। কিন্তু ওই চোরেরা ঘুমাতে দিলো না। আপনি ঘুম দেন।
সুন্দরবনে আসলে কম বেশি রাত জাগতে হয়। তবে গত রাতের জেগে থাকাটা তেমন ছিলো না। চোরা শিকারীদের নিয়ে খুব ঝামেলা গেছে।সবশেষ দুপুরে ওদের পালানোর চেষ্টা, আমাদের ট্রলারে ধাক্কা দেওয়া, সব মিলিয়ে বেশ ঝক্কি গেছে। হয়রান হয়ে গেছি।
ডেক এর উপর আমার শোয়ার জায়গাটি বেশি বড় না। চারপাশ খোলা। বাতাস যেদিক থেকেই আসুক তা গায়ে লাগে। পাতলা তোষক দেওয়া। ছোট ছোট বালিশের উপর মাথা রেখে একটু বিশ্রাম নিতে চাইলাম। কিন্তু কখন গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছি বলতে পারি না।
ঘুম ভাঙ্গলো মামুনের ডাকে। হাল্কা করে পিঠে হাত দিয়ে ডাকছে সে। বলছে, ও ভাই, উঠে একটু খেয়ে নেন। রাত থেকে তো তেমন কিছু খাননি। মনে হচ্ছে অনেক দূর থেকে কেউ ডাকছে। মামুনের হাত সুন্দরবনের আর সবার মতোই কঠিন। কিন্তু আমার পিঠে সেই হাত মনে হচ্ছে মমতায় ভরা কিছু।
ঘুম ভেঙ্গে দেখি পাশে দাঁড়ানো কৃষ্ণবরণ ছেলেটি। ট্রলারের সব কাজ তার কাঁধে। দিন নাই রাত নাই, শুধু কাজ আর কাজ। যে হাত দিয়ে আমাকে ডাকছে মামুন সেই হাতেও কাপড় দিয়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা। মনে হয় কোনো কাজ করতে গিয়ে কেটেছে।
উঠে বসলাম। মুখে পানি দিয়ে ধাতস্থ করলাম নিজেকে। এর মধ্যে প্রায় দুই ঘন্টা পেরিয়েছে। ভাটায় নেমে গেছে চরের পানি। পশ্চিম দিকে বালির উপর আটকে আছে শিকারীদের ট্রলার। আমাদের উত্তরে পুতনীর দ্বীপের একমাত্র খাল। সেখানে পানি আছে এখনও। শেষ ভাটায় শুকিয়ে যায় ওই খাল। তারপর থেকে শুরু গেওয়া বন।
হঠাৎ চিৎকার করে উঠলো সর্দার। কারা ওরা? মামুন বললো, এই চোরেরা ভাই। ভালো করে তাকালে ওদের দেখা যাচ্ছে। জঙ্গলের ভিতর থেকে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। আমাদের গতিবিধি দেখছে ওরা। শিকারীদের এই দলটির মতিগতি ভালো ঠেকছে না।
মামুনকে ওদের দিকে নজর রাখতে বললাম। উঠে হাতমুখ ধুয়ে খেদে বসলাম। সর্দারের হাত বলে কথা। দাতিনা মাছ ভেজে তার মধ্যে পেঁয়াজের বেরেস্তা আর কাঁচা মরিচ পোড়া। দারুণ স্বাদ। ক্ষুধা পেটে পুরো এক প্লেট ভাত খেয়ে নিলাম।
দুপুর গড়িয়ে বিকাল হলো। শেষ ভাটায় নামলাম। বড়শি আর আধার নিয়ে হাঁটা দিবো। পথে শিকারীদের ট্রলারে একটু উঠবো। সেখানে আর কিছু আছে কী না দেখতে হবে। সর্দারের সাথে মামুন আর শহীদুল কাকাও হাঁটা দিলেন।
ট্রলারটি এবার ভালো করে দেখলাম। সুন্দরবনের সাধারণ ট্রলার না। এগুলো চলে লোকালয়ে। সাময়িক ছাউনি দেওয়া। একটি লাকড়ির চুলা আছে। কয়েকটি হাঁড়ি পাতিল ফেলানো এখানে সেখানে। সর্দারকে বললাম, পাটাতনটা তুলে দেখেন।
পাটাতনের তক্তাগুলো ভাঙ্গা। খোল ভর্তি পানি। ইঞ্জিনের একটা অংশ ডুবে আছে। ওদিকে এক পাশ থেকে পাটাতনের তক্তা তুলছে মামুন। ভিতরে চারটি ককসিটের বাক্স। সবগুলো বরফ ভরা। তার মানে পুতনীর দ্বীপে শিকার করে ওগুলো ভর্তি করার পরিকল্পনা ছিলো শিকারীদের। সর্দারকে বললাম, আমাদের বেশি কিছু করার নাই। বরফগুলো ফেলে দেন। আর কিছু হোক না হোক, ওদের আর শিকার করা হরিণের মাংস নিয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকবে না। শুধু সমস্যা একটাই, এই ঘটনার কারণে দস্যুনেতা নাটা জাহাঙ্গীরের সাথে আমার সম্পর্ক আরও খারাপ হবে।
ট্রলার থেকে নামার সময় আবার ইঞ্জিন চালানোর হ্যান্ডেলটি তুলে নিলাম। তারপর হাঁটা দিলাম নদীর দিকে। পশ্চিমে যেখানে দ্বীপটি শেষ হয়েছে সেখানটা বেশ গভীর। স্থানীয় ভাষায় খাঁড়ি বলে। এখানে বড়শি ফেললে বেশ মাছ পাওয়া যায়। অন্তত খাওয়ার মাছ নিয়ে চিন্তা করতে হয় না।
মাছ ধরতে ধরতে গল্প করছি। সর্দারের কাছে মনে হয় গল্পের ঝুরি আছে। নতুন নতুন গল্প শুনি। শুধু তাই না। ছন্দে ছন্দে চলে গল্পগুলো। এর মধ্যে চায়ের মগ নিয়ে দাঁড়ালেন শহীদুল কাকু।
বড় মগে কেবল চুমুক দিয়েছি। এসময় জঙ্গল থেকে দৌড়ে বের হলো তিন শিকারী। খাল পাড়ি দিয়ে ওরা চলে গেলো পূর্ব দিকের কেওড়া বনের ভিতর। শহীদুল কাকু বললেন, এই চরে ওদের আরও লোকজন আছে। মনে হয় কেওড়া বনের ভিতরে তারা। বললাম, ওরা যা করে করুক। শুধু নজর রাখবেন আবার যেন এখানে এসে ঝামেলা না করে। ওদের যা অবস্থা তাতে সন্দেহ হচ্ছে। ফোন করে জাহাঙ্গীর ডাকাতকে নিয়ে আসতে পারে। তখন পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে বলা মুশকিল।
প্রায় এক বালতি মাছ ধরলাম। দাতিনা, ঘাগড়া টেংড়া, পাঙ্গাস আর ভোলা মাছ। উঠবো উঠবো করছি। এসময় বনের ভিতর থেকে কুকু পাখি ডেকে উঠলো। তার মানে ভাটা শেষে জোয়ার লেগেছে।
সন্ধ্যা নামার আগে ট্রলারে ফিরলাম। এই রাতে পুতনীর দ্বীপ ছাড়বো। সেজন্য শেষ জোয়ার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। ট্রলার পুরোপুরি ভাসবে। তারপর সামনের খাল পর্যন্ত গিয়ে সেই পথ ধরে আড়পাঙ্গাসিয়া নদীতে নামতে হবে। একই সময়ে ভাসবে শিকারীদের ট্রলারটি। মনে হচ্ছে একই সময়ে তারাও দ্বীপ ছাড়ার চেষ্টা করবে। এবার আমাদের সামনে পড়তে চাইবে না তারা। তবে হ্যান্ডেলটি আমাদের কাছে আছে বলে দেখা না করে যেতেও পারবে না।
ট্রলারের সবগুলো আলো জ্বালানো হলো। গলুইয়ে মামুন বসা টর্চ হাতে। আগামী ছয় ঘন্টা বাড়তি সতর্ক থাকতে হবে। শহীদুল কাকুও পিছনে বসে চারপাশে চোখ রাখবেন। সর্দারকে বিশ্রামে পাঠালাম। আমি বসলাম মামুনের পাশে।
হরিণের ডাক শুনছি। খুব কাছে তারা। টর্চ ফেলতে দেখি দল বেঁধে চরে নেমেছে হরিণের পাল। ছোট বড় মিলিয়ে শতাধিক হরিণ হেঁটে বেড়াচ্ছে চোখের সামনে। কাছাকাছি কয়েকটি বন্যশুকর হাঁটছে। ট্রলার থেকে ফেলা খাবারের উচ্ছিষ্ট খেয়ে বিদায় নিলো তারা। তারপর কোত্থেকে কী হলো, দৌড়ে পালালো হরিণের ঝাঁক।
চাঁদের জন্য অপেক্ষা করছি। চারপাশের অন্ধকার না কাটা পর্যন্ত স্বস্তি পাচ্ছি না। আবার চা তুললেন শহীদুল কাকু। সাথে ঝাল-মুড়ি। সন্ধ্যার নাস্তা হিসাবে বেশ মজার। চায়ে চুমুক দিতে দিতে শরীরটা এলিয়ে দিলাম। আবার রাজ্যের ঘুম নামলো চোখে।
মামুনের ডাকে আবার ঘুম ভাঙ্গলো। উঠে দেখি ট্রলারের পাশে হাঁটু পানি। সেই পানিতে দাঁড়ানো একজন নতুন মানুষ। চিনি চিনি মনে হচ্ছে। কিন্তু মনে পড়ছে না। আমাকে দেখেই সালাম দিলো সে। বললাম, উপরে আসেন। পাশ থেকে কানে কানে মামুন বললো, সে এখানকার পার্মানেন্ট জেলে বিকাশ বাবুর ভাই। দ্বীপের চারপাশে তার ফাঁস জাল খাটানো। মানে বড় মাছ ধরে তারা। এই অভয়াশ্রমে জেলেদের এই বহর প্রায় সারা বছর স্থায়ী থাকে। যখন যে বড় দস্যুদল থাকে তাদের মাধ্যমে এই অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করে তারা।
অর্ধেক জোয়ার পেরিয়ে গেছে। লোকটির সাথে কুশল বিনিময় করলাম। পায়ের কাদা ধুয়ে সে সামনে এসে দাঁড়ালো। এবার চিনলাম। এই চরে আগেও তার সাথে দেখা হয়েছে।
কাকুকে আবার চা চড়াতে বললাম। ওরা কড়া লিকারের র চা খায়। সাথে বিস্কিট বের করে দিলো মামুন। আমাদের ট্রলারে কেউ আসলে এভাবেই আপ্যায়ন করি। পরিচয় পর্ব সেরে লোকটি আমার ভালো মন্দ জানলেন। বললেন, এবার মাছ নাকী ভালোই হচ্ছে। মাঝে মাঝে মোচন মাছের ঝাঁক পড়ছে জালে। এক জালেই এবার তারা চল্লিশ লাখ টাকার মাছ পেয়েছে। বাটলো নদীর মুখে পাতা ফাঁসজালে পর পর দুই বার বড় মাছের ঝাঁক পড়েছে।
জেলে ভাই আমাকে তাদের ঘরে যাওয়ার দাওয়াত দিলেন। বললাম, এই চরে ঘর আছে? এটা তো অভয়াশ্রম। লোকটি বললো, সবাইকে ম্যানেজ করে চলি। বললাম, দিনের পর দিন ডাকাত বাহিনী ম্যানেজ করেন কী করে? হাসি দিয়ে সে বললো, টাকা দিলে সব হয় ভাই। বললাম, আপনারা তো শুধু চাঁদা দেন না। অন্যদের থেকে টাকা তুলেও দেন। এই দ্বীপকে ঘিরে আপনাদের নিয়ে দস্যুদের অনেক গল্প আছে।
চা আসলো। সাথে বিস্কিট। লোকটি চায়ে চুমুক দিতে দিছে। বুঝতে পারছি বেশ অস্বস্তিতে আছে সে। শুধু বললো, আমাদের ঘরে চলেন ভাই। রাতের খাবার খাবো একসাথে। ভাবছি যাবো। ওরা কিছু বলতে চায়। আবার অভয়াশ্রমের এই দ্বীপে জেলেদের একটি ডেরা আছে। সেটি দেখতে হবে না?
ছবি: পুতনীর দ্বীপ, নভেম্বর ২০১৬