নিষিদ্ধ দ্বীপে জেলেদের ডেরা | রূপান্তরের গল্প ৩২৪ | Rupantorer Golpo 324 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ৩২৪ : টর্চের আলো ফেলে এগুচ্ছি। পুতনীর দ্বীপের মাঝ বরাবর ট্রলার রাখা। সেখান থেকে নেমে পড়েছি হুট করে। যাচ্ছি জেলেদের ডেরায়। হাঁটু পানি ভেঙ্গে হাঁটতে খারাপ লাগছে না। পায়ের নিচে শক্ত বালি। সামনের কেওড়া বাগানে এখনও পানি উঠেনি। আমরা ওদিকেই যাচ্ছি।
সবার সামনে এই দ্বীপের একজন জেলে। তারপর মামুন। এর পর আমি, পাশে বেলায়েত সর্দার। শহীদুল কাকুসহ অন্যরা ট্রলারে। ট্রলারে কয়েকটা গড়ানের কচা রাখা। শিকারীরা হঠাৎ কোনো ঝামেলা করতে আসলে কাজে লাগবে। ওদের চোখ কান খোলা রাখতে বলেছি কারণ চোরা শিকারীরা যেকোনো সময় তাদের ট্রলারে ফিরতে পারে। ইঞ্জিন চালানোর হ্যান্ডেল না পেলে ওরা আমাদের ট্রলারে আসবে। তখন মারামারির মতো ঘটনা ঘটে যেতে পারে।
সর্দারকে বললাম, ভরা জোয়ারের আগে ফিরতে হবে আমাদের। উনি বললেন, ও নিয়ে চিন্তা করবেন না ভাই। শিকারীরা সামনের কেওড়া বনের ভিতরে আছে। আর ওদের ইঞ্জিনের চাবি আমার কাছে। এবার ঝামেলা করলে আর বাড়ি ফিরতে পারবে না।
কেওড়া বনের কাছে পানি নাই। কিন্তু কাদা আছে। এখানে ছোট একটা খাল আছে। সেখানে জোয়ারের পানি উঠছে কেবল। টর্চ ফেলে দেখি খালের পাশজুড়ে পুরোটাই ঢোরা সাপে ভরা। ওরা জোয়ারের পানিতে উঠে আসা মাছগুলো শিকার করছে। সাপ আমি ভয় পাই। ভীষণ ভয় পাই। তাই আঁৎকে উঠলাম, লাফ দিয়ে সরে গেলাম বনের ভিতর।
আমার এই অবস্থা দেখে সবাই হাসতে হাসতে শেষ। মামুন বলে, এ সাপে কোনো বিষ নাই ভাই। বললাম, সাপ দেখলেই ভয় লাগে। আমি অন্য পথে যাবো।
কেওড়া বনের ভিতর দিয়ে হাঁটা একটু কষ্টের কাজ। শ্বাসমূলগুলো পায়ের তালুতে পড়ছে। খোঁচা লাগছে। তবে তারচেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছে গড়ানের গুচ্ছমূলগুলোর কারণে। পায়ের তালুতে বেশ ব্যাথা পাচ্ছি। সর্দার বললেন, এই পথে আপনি হাঁটতে পারবেন না ভাই। সামনে গড়ানের ঝোপ আরও গভীর। তাই জঙ্গল পেরিয়ে দ্বীপের পূর্ব দিকে চলে গেলাম। সাগর তীর ধরে হেঁটে এগিয়ে গেলাম দক্ষিণে।
জেলেরা বলে এই চরে এখন বাঘ নাই। তাই বাঘের আক্রমনের দুশ্চিন্তা নাই। তবে বন্যশুকরগুলো থেকে সতর্ক থাকতে হয়। হঠাৎ হরিণের পাল সামনে পড়লেই বিপদ ঘটতে পারে। ভয় পেয়ে ওরা দৌড়ঝাঁপ শুরু করলে সমস্যা। ধারালো শিং আর ব্লেডের মতো ক্ষুরগুলো ভয়ঙ্কর।
মিনিট কুড়ি হাঁটলাম। এবার আবার কেওড়া বনে ঢুকবো। চারপাশে টর্চ ফেলে দেখে নিলো ওরা। তারপর ওই জেলে ভাইয়ের দেখানো পথে হাঁটা দিলাম। কয়েক মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে। গড়ানের বেড়া দিয়ে ঘেরাও দেওয়া। দড়ি দিয়ে বাঁধা গেট। খুলে ঢুকে পড়লাম ভিতরে।
গেওয়া আর গরান গাছ দিয়ে তৈরি ঘর। ছাপড়া হলেও বেশ মজবুত। ভিতরটা বেশ বড়। মাচার উপর জালগুলো সাজানো। নিচে বরফের বাক্স। নদী-সাগর থেকে ধরা বড় মাছগুলো রাখা হয় এই বাক্সের ভিতর। নিচে বিছানা করা। সেখানে কয়েকজন জেলে বসে তাশ খেলছে। এক কোণায় রান্নাঘর।
আমাদের দেখে হুড়মুড় করে দাঁড়িয়ে পড়লো সবাই। তাশ খেলোয়াড়দের মধ্যে দেখি ওই শিকারীরাও আছে। আমাদের দেখে রীতিমতো ভড়কে গেলো ওরা। জেলে বহরের নেতা বললেন, ভয়ের কিছু নাই। মোহসীন ভাই আমাদের কাছের মানুষ। বলেই উনি বরফের বাক্সের কাছে গেলেন। বড় একটা ভেটকী মাছ বের করে দিলেন বাবুর্চির কাছে। একই সাথে চুলায় চা উঠানোর নির্দেশ দিলেন। মাছ কাটতে নিষেধ করলাম। বললাম, এক কাপ চা খেয়ে বিদায় নিবো।
জেলেদের ঘর থেকে বের হলাম। গাছ কেটে পরিস্কার করা আঙ্গিনা। মাঝখানে একটি বাতি জ্বলছে, সৌর বিদ্যুতের বাতি। চারপাশ বেশ পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। এখানে পানির ড্রাম, লাকড়ি, জাল, ছেঁড়া জালগুলো রাখা। গাছের সাথে জাল দিয়ে তৈরি হ্যামক (দোলনা) ঝুলছে। বসলাম সেখানে।
চারপাশ নিস্তব্ধ। ঝিঁঝি পোকার ডাক ছাড়া আর কোনো শব্দ নাই। জেলেরা বললো, চারপাশে হরিণের পাল আছে। বাঘ নাই। এখানে বেড়া দেওয়া হয়েছে বন্যশুকরের কারণে। বনজীবীরা এই বন্যপ্রাণিকে ভীষণ ভয় পায়। কারণ বিনা কারণে, যখন তখন ওরা আক্রমণ করে বসে।
চা আসলো। সেই গাঢ় লিকারের র’ চা। মুখে দিলেই আমার মাথা ঘুরায়। তবুও ছোট ছোট চুমুক দিচ্ছি। এসময় জেলে বহরের নেতা এসে পাশে বসলেন। একথা সেকথা বলতে বলতে মূল কথায় আসলেন তিনি। বললেন, এবার যা হওয়ার হয়েছে ভাই। ওরা ভুল করেছে, এবারের মতো মাফ করে দেন। আমি বললাম, ওই শিকারীরা আপনার এখানে কবে থেকে? বললেন, রাসমেলার পর এসেছে। কিন্তু আমাদের সাথে ওদের কোনো সম্পর্ক নাই। আমরা মাছ ধরি। আর কোনো অকাজে নাই।
সম্পর্ক না থাকলে ওদের হয়ে ওকালতি করছেন কেন? এমনিতেই আপনারা এই অভয়াশ্রম দখল করে রেখেছেন। আর কোনো জেলেরা এখানে মাছ ধরতে পারে না। সারা বছর এখান থেকে অনেক টাকার মাছ ধরেন আপনারা। বর্ষায় ইলিশও ধরেন। ভালোই আছেন আপনারা। নিজেরাও এখানে হরিণ শিকার করেন, পাখি মেরে খান। সব খবরই জানি।
জানতে চাইলাম ডাকাত দলের সাথে তাদের সম্পর্কের কথা। ওরা বললো, কোনো সম্পর্ক নাই। বললাম, সম্পর্ক না থাকলে এখানে আছেন কী করে?
সুন্দরবনে সবকিছুই চলে বনদস্যুদের কথায়। তাদের ইশারা ছাড়া এদিকে কেউ আসতে পারে না। ঘাঁটি গেঁড়ে বসা দূরের কথা। পুতনীর দ্বীপের এই জেলেদের সাখে সব সময় দস্যুদলগুলোর দারুণ সম্পর্ক। সেই রাজু বাহিনী থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত বড় দস্যুদলের আস্থায় তারা। নিজেদের টাকা পয়সা লেনদেনের পাশাপাশি এরা অন্য জেলেদের চাঁদাও তুলে দেয়। শুনেছি সময় সময় দস্যুদের অস্ত্র-গুলি এনে দেয় তারা। খুলনার নলিয়ান, কালাবগী আর সান্তা এলাকার কিছু মানুষ পুরো চক্রটি নিয়ন্ত্রণ করে।
আমার মুখে এসব শুনে রীতিমতো থমকে গেলো ওই জেলেরা। ওদের ধারণাও ছিলো না যে এতো কিছু আমি জানি। সর্দার হাসি দিয়ে বললেন, ও ভাই, এত্র গবেষণা করেন কখন? এতো কাহিনী তো আমরাও জানি না। বললাম, চোর ডাকাতদের নিয়ে সব খবরই রাখি।
জেলে ভাই এবার মুখ খুললেন। বললেন, তাদের সাথে ভালো সম্পর্ক নোয়া বাহিনীর। তবে জাহাঙ্গীর বাহিনীর সাথেও তাল মিলিয়ে চলতে হয়। আজ জাহাঙ্গীর তাকে ফোন দিয়েছিলো। এখানে শিকারের আসা তার আত্মীয়কে সহযোগিতা করতে বলেছে। সে আপনাকে ফোনে পায়নি। তাই আমাকে বলেছে।
মনে মনে ভাবছি, জাহাঙ্গীরের সাথে ঝামেলা বাড়াবো না। এমনিতেই তার সাথে সম্পর্ক ভালো না। শিকারীদের ডাক দিলাম। ওরা কাচুমাচু হয়ে দাঁড়ালো। বললাম, তোমরা আমাদের ট্রলারের ধাক্কা দিলে কেন? বললো, ভুল করে ধাক্কা লেগে গেছে। সুকানিতে যে ছিলো সে নতুন। ওদের বিশ্বাস করি না। তবুও মাথা ঠান্ডা করলাম। বললাম, তোমরা এই জোয়ারে বের হয়ে যাবে। সোজা বাড়ি ফিরবে।
জেলেদের ডেরাটি অবৈধ। এদিকে মাছ ধরার নিয়ম নাই। বনের ভিতরে পা রাখারও নিয়ম নাই। তবে ওরা ডাকাত দলের পৃষ্ঠপোষকতায় এখানে সবকিছু করে। গাছ কেটে ঘরবাড়ি বানিয়ে তারা বসবাস করছে। এনিয়ে বনরক্ষীরা কিছু বলার সাহস পায় না।
জেলেরা বললো, ফরেস্টের লোকদেরও ম্যানেজ করতে হয়। তবে দস্যুদলের সাপোর্ট থাকলে বন বিভাগের কিছু করার নাই। বনরক্ষীরা এমনিতেই বেকায়দায় থাকে। পশ্চিম সুন্দরবনের হলদেবুনিয়া ক্যাম্পের অস্ত্র লুটের পর থেকে তাদের ভয় আরও বেড়ে গেছে।
বের হবো আমরা। সর্দার কোথায়? রান্নাঘর থেকে জবাব এলো। গিয়ে দেখি চুলার উপর রাখা হাঁড়ি থেকে মাছ নিয়ে টেস্ট করছেন উনি। বললেন, ও ভাই, রান্না এরা ভালোই করে। তবে মসলা বেশি দেয়। আপনি খেয়ে মজা পাবেন না। বললাম, আমি আপনার রান্না খাবো। চলেন এখন।
সবাই মিলে বের হলাম। কেওড়া বন পেরিয়ে গিয়ে উঠলাম সোজা উত্তরে। দ্বীপের সীমানা এখানে শেষ। আমরা সৈকত ধরে পশ্চিমে যাবো। সৈক ধরেই ফিরবো ট্রলারে।
কিছুদূর হাঁটতেই সামনে দেখি বেশ বড়সড় হরিণের পাল। চরের উপর দাঁড়ানো সবাই। আমাদের দেখে ভয় পেলো তারা। কওয়া নাই বলা নাই হুট করে দিলো দৌড়। ভেবেছিলাম উল্টো দিকে দৌড়াবে ওরা। কিন্তু সেটি না করে আমাদের দিকে দৌড় দিলো হরিণগুলো। আমরা দাঁড়িয়ে থাকলাম। কয়েক সেকেন্ড ভূমিকম্প হয়ে গেলো। আমাদের পাশ দিয়ে আর মাথার উপর দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে চলে যাচ্ছে হরিণগুলো।
কী হলো এটা? ওরা ভয় পেলে উল্টোদিকে দৌড়ানোর কথা। আমাদের দিকে আসলো কেন? একটু এগুতেই তার উত্তর পেলাম। ওদিকে জোয়ারের পানি উঠে গেছে।
সর্দার এসে টর্চ জ্বালিয়ে আমাকে দেখলেন। বললেন, আহত হননি তো? বললাম, না। তবে কয়েকটা ধাক্কা খেয়েছি। বাকীরাও ঠিকঠাক। বললাম, এখন ট্রলার পর্যন্ত যাবো কী করে? জোয়ারের পানি অনেক বেড়েছে। আশেপাশে নৌকা নাই? জেলেরা বললো, কাঁকড়ার জেলেদের নৌকা ছিলো ভাই। আপনাদের দেখে সরে গেছে। এখন হেঁটে যাওয়া ছাড়া কোনো রাস্তা নাই।
কী আর করা? পানিতে নেমে পড়লাম। আসার সময় সাপ দেখেছি। তাই চর ধরে এগুতে চাচ্ছি। কিন্তু সৈকতের সাথেই বড় নদী। সেখানেই বেশ গভীর খাঁড়ি। স্রোতও বেড়েছে। তাই দ্বীপের মাঝ বরাবর যেতে হবে। একজন বললো, আপনাকে ঘাড়ে করে নিবো ভাই? বললাম, আরে না। আমি পারবো।
বুক পানি ঠেলে হাঁটলাম প্রায় আধা ঘন্টা। সে এক কঠিন অভিজ্ঞতা। ট্রলারে পৌঁছে দেখি শহীদুল কাকু গভীর ঘুমে। অন্যদেরও সাড়া শব্দ নাই। পানিতে দাঁড়িয়ে হাঁক দিলাম। কাকু উঠে বসলেন। বললেন, রাতটা ওদিকে থেকে আসলেই পারতেন! কাকুর কথা শুনে সবাই হেসে উঠলো।
সর্দারকে ইশারা করলাম। উনি ট্রলারে উঠে আমাকে তুলে নিলেন। তারপর মামুন উঠলো। গামছা দিয়ে গা মুছতে মুছতে বললাম, শিকারী ভাইদের ইঞ্জিনের হ্যান্ডেলটা দিয়ে দেন ভাই। ওদের বললাম, তোমাদের যেন আর জঙ্গলে না দেখি।
হ্যান্ডেল নিয়ে ফিরলো ওরা। সর্দার বললেন, এতো কিছুর পরও ওদের মাফ করে দিলেন ভাই? বললাম, আমি মাফ করার কেউ না। তবে ওরা অন্যায় করেছে। ওদের বিষয়ে বনকর্তাদের সাথে কথা বলবো।
চাঁদ মধ্য আকাশে। ভরা জোয়ারে টগবগ করছে চার আড়পাঙ্গাসিয়ার পানি। ট্রলার ভেসেছে। মামুনকে বললাম, এই দ্বীপ ছাড়বো আমরা, তৈরি হও। সর্দার বললেন, এবার কোথায় যাবেন ভাই? তেল কিন্তু বেশি নাই। বললাম, আপাতত পশুর নদীতে ফিরবো। তারপর দু্বলার চরেও যেতে পারি। আবার ফিরতি পথও ধরতে পারি।
দূরে ভাসছে শিকারীদের ট্রলার। একজন ইঞ্জিন চালানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। সর্দার ডাক দিলেন। বললেন, তোরা ট্রলার ঠেলে এদিকে আয়। ইঞ্জিনের তেলের লাইনে বাতাস ঢুকছে। ওরা আসলো। সর্দার গিয়ে পাইপ থেকে বাতাস বের করে ইঞ্জিন চালু করে দিলেন। ওরা রওনা দিলো। আমরাও রওনা হলাম। কয়েক মিনিটের মধ্যে শিকারীদের ট্রলার চোখের আড়াল হলো। আমরা ছুটলাম পূর্ব দিকে, গন্তব্য পশুর নদী।
(ছবি: পুতনীর দ্বীপে জেলেদের ডেরা, নভেম্বর ২০১৬)