ডুবতে ডুবতে বেঁচে গেছি! ভয়ঙ্কর আড়পাঙ্গাসিয়া | রূপান্তরের গল্প ৩২৫ | Rupantorer Golpo 325 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ৩২৫ : হঠাৎ করে দুলে উঠলো ট্রলার। কিছু বুঝে উঠার আগেই একপাশ থেকে পানি উঠে পড়লো। অন্ধকারে কিছুই বুঝতে পারছি না। হলো টা কী? পুতনীর দ্বীপ ছেড়েছি আধা ঘন্টা আগে। দ্বীপের উত্তর প্রান্ত দিয়ে পশ্চিমের পথ ধরেছি মাত্র। তখনই বড় ঢেউ-এর ধাক্কা খেলাম। এমনিতে খুব বেশি ভয় পাই না। কিন্তু ট্রলারের তলা দুর্বল বলে ভয় পেলাম।
সুকানিতে মামুন দাঁড়ানো। সর্দার গেছেন বিশ্রামে। হঠাৎ দুলুনি খেয়ে উনিও উঠে এসেছেন। আমি আছি ডেক-এর উপর। কম্বল মুড়ি দিয়ে আকাশ বাতাস ভাবছিলাম।
বকাঝকা চলছে। বেলায়েত সর্দার চিৎকার করছেন। মামুনকে সরিয়ে নিজে দাঁড়ালেন সুকানিতে। উত্তর দিক দিয়ে দ্বীপ অতিক্রম করে সোজা পশ্চিমে চালিয়েছে মামুন। এদিকে কেবল ভাটা শুরু হলো। স্রোত ঘুরে গেছে বলে নদী উত্তাল। এমনিতে স্রোত-বাতাসের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হয়। কিন্তু মামুন সেটা খেয়াল করেনি। রাতের বেলা বলে বুঝতেও পারেনি যে ভাটা হয়ে গেছে, স্রোত ঘুরে গেছে।
টর্চ ফেলে দেখি পানিতে বেশ বড় বড় ঢেউ। উঠছে। আড়পাঙ্গাসিয়া নদীর পূর্ব দিকে আমাদের সোজা কলাতলা। ওদিকে চর পড়েছে। দ্রুত বনের ভিতরের কোনো খালে ঢুকতে হবে। কিন্তু সেজন্যও প্রায় ঘন্টা খানেক সময় চলতে হবে।
ধাক্কা খেয়ে আগেই উঠে বসেছি। এবার গিয়ে দাঁড়ালাম সুকানির পাশে। মামুন চলে গেলো সামনে। শহীদুল কাকা ব্যস্ত ভিতরের জিনিষ-পত্র গোছগাছে। হঠাৎ রোলিং-এ পড়লাম। দ্রুত সব গুছিয়ে নিতে হবে। একই সাথে নদীও পার হতে হবে। সর্দারের পাশে দাঁড়িয়ে আমি।
কোন দিক দিয়ে যাবো আমরা? সর্দার জানতে চাইছেন। বললাম, বালির গাঙ দিয়ে যাবো না। উল্টোপাশে কলাতলা। ওদিকে চর পড়ে গেছে। আমরা দক্ষিণে যাবো। সেজন্য সাগরে উঠতে হবে। নীল কমলের দক্ষিণে বইন্দে খালে ঢুকবেন। ওদিকেও বিপদের শেষ নাই। অর্ধেক ভাটা হলে ওদিক দিয়ে আর যেতে পারবো না। সর্দার বললেন, ঘন্টা খানেক সময়ের মধ্যে যেতে পারলে পানি থাকবে। তাহলে একবারে পশুর নদীতে উঠা যাবে।
রোলিং চলছেই। ভাটার স্রোত বেড়েছে। কিন্তু বাতাস হচ্ছে পূর্ব উত্তর দিক থেকে। তাই নদী পাগল হয়ে গেছে। সর্দার বললেন, আড়পাঙ্গাসিয়া পাগলা হলে মুশকিল ভাই। আপনি শক্ত করে ধরে বসেন। বললাম, বসবো না। আপনি শক্ত হাতে সুকানি ধরেন।
ট্রলার চলছে আড়াআড়ি। ঝপাস ঝপাস করে ধাক্কা খাচ্ছে। বুক দিয়ে ঢেউ কাটিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের ট্রলার। সাগর বা বড় নদীতে ট্রলার চালানো সবার কাজ না। সর্দারের এবিষয়ে বিশেষ দক্ষতা আছে।
প্রায় এক ঘন্টা চললাম। অন্ধকারে কিছু দেখি না। এদিকে কোনো বয়াও নাই। কুয়াশা বাড়ছে। আমি কিছুই দেখছি না। তবে সর্দার বলছেন, পূর্ব দিকে জঙ্গল দেখা যাচ্ছে। ভরসা করে অপেক্ষা করছি। কিন্তু রোলিং কমছে না। বিপদের কথা। দিনের বেলা হলে সমস্যা ছিলো না।
চিৎকার করে মামুনকে ডাক দিলেন ক্যাপ্টেন। কিন্তু আওয়াজ ওই পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে না। ইঞ্জিনের শব্দ, বাতাস আর রোলিং মিলিয়ে অদ্ভুত এক পরিবেশ। পরে টর্চ জ্বালিয়ে ইশারা দিলেন সর্দার। ছাউনির নিচ থেকে খালি তেলের ড্রাম বের করতে বললেন। দড়ি বেঁধে ড্রামটি এনে পাশে রাখলো মামুন। ট্রলার ডুবে গেলে ওই ড্রাম ধরে ভাসবো আমি।
শক্ত হাতে দড়ি ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম। আরও কিছুক্ষণ এগিয়ে একটা বয়া নজরে আসলো। বেশ দূরে। তবে ওই বয়ার আলো আমাদের মনে আশার আলো জাগালো। তার মানে ঠিক পথে আছি। ওই বয়ার দিকে মুখ ঘুরিয়ে এগিয়ে চললাম। আধা ঘন্টা পর বাম পাশে একটি খাল নজরে আসলো। সর্দার বললেন, ওই যে বইন্দের খাল।
মধ্য সুন্দরবনের শেষ প্রান্ত এটি। আমাদের বাম দিকে সুন্দরবনের বইন্দে, চান্দাবুনিয়া। আর ডান দিকে মানে দক্ষিণে বঙ্গবন্ধুর চর। আপাতত সাগর থেকে একটু দূরে আমরা। রোলিংও কমেছে অনেকটা।
উত্তরে ঘুরলো ট্রলার। সোজা গিয়ে ঢুকলাম একটি খালের ভিতর। বইন্দে খালটি বেশ বড়। এখানে কুমিরের চাপ আছে। জঙ্গলে বাঘের আনাগোণা থাকে সারা বছর। এদিকটাও অভয়াশ্রম। তবে অন্য এলাকার মতো এখানেও জেলেরা থাকে সারা বছর।
খালে ঢুকে একটু ভিতরের দিকে এগুলাম। এক বাঁক ঘুরতেই নজরে আসলো জেলে নৌকা। আমাদের দেখে তড়িঘড়ি করে ওরা ছোট খালে ঢুকে পড়লো। সবাই চরপাটা জালের জেলে। খালে ঢোকার সময় চর জুড়ে ওদের জাল দেখেছি।
প্রায় দুই ঘন্টা বিপদের মধ্যে ছিলাম। সাগরের মুখে ট্রলার ডুবি হলে বিপদের শেষ থাকতো না। ভেসে থাকলেও ভাটার টানে কোন সাগরে ভেসে যেতাম কে জানে? সর্দার তখনও এক মনে ট্রলার চালাচ্ছেন। বললাম, এ ভাই আর কতোদূর যাবেন? সর্দার বললেন, ডিজেল শেষের দিকে ভাই। বললাম, তা কেন? এক ড্রাম তেল ছিলো।
সর্দার বললেন, মামুন বুঝতে পারেনি ভাই। পানির ড্রাম দেখে ও ভাবছিলো ডিজেল। এখন যেটুকু তেল আছে তা দিয়ে নীল কমল ফরেস্ট অফিস পর্যন্ত যেতে পারলেই হয়। কোনো রকমে খাল ধরে নীল কমল নদী পর্যন্ত পৌঁছালেই চলবে। কিন্তু সে পর্যন্ত যেতে হলেও প্রায় ১১ কিলোমিটার পানি পথ পেরুতে হবে। সর্দার বললেন, ওই পর্যন্ত উজান ঠেলতে হবে। তারপর ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেলেও সমস্যা নাই। ভাটার টানে নীল কমল ফরেস্ট অফিস পর্যন্ত যাওয়া যাবে।
একের পর এক বাঁক পেরিয়ে চলছি আমরা। নিরবতা ভেঙ্গে ফেলছে আমাদের ট্রলার। ইঞ্জিনের শব্দ বেশ বেখাপ্পা লাগছে। কিছু দূর পর পর এখানে জেলেদের নৌকা দেখছি। আমাদের দেখে ছুটোছুটি করছে। নৌকা বেয়ে ঢুকে পড়ছে ছোট ছোট খালে। এরা সবাই চরপাটা আর খালপাটা জাল দিয়ে মাছ ধরে। সম্ভবত কয়রা অথবা কালাবগীর জেলে।
ভাটা শেষ হতে আরও দুই ঘন্টা। তাই আমাদের স্রোতের বিপরীতে চলা শেষ হচ্ছে না। জ্বালানী তেলের দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে ছুটছি। পথে কোনো ট্রলার পেলে ভালো হতো। কিন্তু এই অঞ্চলে সেই সম্ভাবনা নাই।
ঘন্টা খানেক চলার পর গিয়ে উঠলাম নীল কমল নদীতে। এখানে স্রোত যাচ্ছে পূর্ব দিকে। এখন আমরাও যাচ্ছি সেদিকেই। এতোক্ষণ পর সর্দারের মুখে হাসি ফুটলো। কারণ এখন তেল ফুরালেও স্রোতের সাথে ভেসে এগুনো যাবে। সুকানি আমার হাতে দিয়ে সর্দার গেলেন ইঞ্জিন রুমে।
ভিতর থেকে চিৎকার করে সর্দার জানালেন, তেল শেষ ভাই। ইঞ্জিন বন্ধ করেন। বলতে বলতে বন্ধ হলো ট্রলার। আমরা ভেসে চললাম নীল কমল ধরে। এদিকে শহীদুল কাকা আর মামুন গভীর ঘুম। সর্দার এসে রান্নাঘর খুললেন। চা বসালেন।
শেষ ভাটায় স্রোত বেড়েছে। দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম নদীর মুখে। এখানে বন বিভাগের অফিস আছে। আছে বন্দর কর্তৃপক্ষের স্থাপনা, নৌ-বাহিনীর ঘাঁটি। বন বিভাগের অফিস পেরিয়ে আমরা নোঙ্গর করলাম বন্দরের জেটিতে। সামনে পশুর নদী। ওপারে দুবলার চর। সর্দার ফোন বের করলেন।
দুবলার চর থেকে ডিজেল আসবে। সেজন্য অপেক্ষা করতে হবে সামনের জোয়ার পর্যন্ত। এবার বিশ্রাম নিতেই হবে। শরীর আর চলে না। তবে তার আগে একটু খাওয়া দাওয়া সেরে নিবো। তেমন কিছু না। পান্তা ভাত আছে। লবণ আর শুকনা মরিচ পুড়িয়ে নিলেই চলবে। তারপর এক কাপ চা।
খেয়ে ডেক এর উপর উঠে বসলাম। রাত পেরিয়ে সকাল হলো। সূর্য উঠছে। অসম্ভব সুন্দর চারপাশ। হাল্কা বাতাস শরীরে কাঁপন ধরাচ্ছে। কম্বল মুড়ি দিয়ে শুলাম। সর্দার গিয়ে শুয়ে পড়লেন ছইয়ের ভিতর। এমন সময় কেউ আমাদের ডাক দিলো। ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে দুজন বনরক্ষী এসেছেন। বেশ রুক্ষ মেজাজ নিয়ে বললেন, অফিসে আসেন। ওসি সাহেব ডেকেছেন। বললাম, অনেক ক্লান্ত ভাই। একটু ঘুম দিয়ে তারপর আসবো। ওসি সাহেবকে আমার সালাম জানাবেন।
এরপর কী হলো জানি না। কম্বল মুড়ি দিয়ে চলে গেলাম ঘুমের দুনিয়ায়।
(সুন্দরবন, নভেম্বর ২০১৬)