রূপান্তরের গল্প ৩২৭ | Rupantorer Golpo 327

রাতেই পাড়ি দিবো পশুর নদী | রূপান্তরের গল্প ৩২৭

রাতেই পাড়ি দিবো পশুর নদী | রূপান্তরের গল্প ৩২৭ | Rupantorer Golpo 327 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ৩২৭ : ও ভাই, আমরা কি নীল কমলেই থাকবো? দুবলার চরে যাবো না? সর্দার বললেন, তেল না থাকলে ট্রলার চালাবো কী করে? তেল নিয়ে দুবলা থেকে লোকজন আসার কথা। ওরা রওনাও দিছে। কিন্তু এই নদীতে ঢোকার সময় ওই পশুর নদীতে আটকে গেছে। আধা জোয়ার হওয়ার আগে ঢুকতে পারবে না। নদীর মুখের পুরোটাই টর পড়ে গেছে। কেবল ভাটা শেষ হয়েছে। আমাদের অন্তত আরও তিন ঘন্টা এখানেই থাকতে হবে।

দুই পা ছড়িয়ে বসে পড়েছি। গত চার ঘন্টার সফরে হয়রান হয়ে গেছি। শরীরের জায়গায় জায়গায় কেটে-ছিলে গেছে। এছাড়া পায়ের তালু ভর্তি নানা জাতের কাঁটা। আমাদের ট্রলারের ডেকটি ছোটখাটো একটা অপারেশন থিয়েটারে পরিণত হয়েছে। ডাক্তার হচ্ছেন বেলায়েত সর্দার আর তার সহযোগী মামুন।

পানি গরম করা ছিলো আগে থেকে। কিন্তু কাছে কোনো অ্যান্টিসেপ্টিক নাই। কী আর করা! হাল্কা গরম পানি দিয়ে পায়ের ক্ষতগুলো পরিস্কার করা হলো। তারপর সেফটি পিন নিয়ে বসলেন সর্দার। পা দুটো কোলের মধ্যে রেখে একটা একটা করে কাঁটা তুললেন। একটানা না হলেও পনেরোটি কাঁটা বের হলো। সবগুলোই হেঁতাল কাঁটা। খেজুরের কাঁটার মতো ছোট ছোট কাঁটাগুলো শুকনা, তালুতে ঢুকে ভেঙ্গে যায়। সুন্দরবনের কাদা আর পানিতে এই কাঁটার কোনো অভাব নাই।

অপারেশন শেষ করে সর্দার গিয়ে বসলেন রান্নাঘরে। দুপুর গড়িয়েছে আগেই। সূর্য হেলে পড়েছে পশ্চিমে। নদীর পানি কমে প্রায় তলানিতে ঠেকেছিলো। তবে জোয়ার শুরু হয়েছে। বাড়ছে পানি। সাগর পাড়ের নদী-খালগুলোতে জোয়ারের পানি ঢুকতে সময় লাগে না।

সকালের নাস্তায় ছিলো মরিচ পোড়া দিয়ে পান্তা ভাত। দুপুরে খাওয়া হয়নি। ভাত রান্না করা আছে। এখন তরকারি হবে। গত কয়েক দিন মাছ খেয়েছি। তাই আজ রান্না হবে হাঁস। ট্রলারের খোলের ভিতর এখনই দুটি হাঁস আছে। সেগুলো রান্না হবে চুঁইঝাল দিয়ে। একবারে দুই বেলার জন্য রান্না হবে। কারণ রাতেই আমরা পশুর নদী পাড়ি দিবো। দুবলার চরে আর নাও ফিরতে পারি। তাই লম্বা সফরের প্রস্তুতি নিচ্ছি। পর্যাপ্ত ডিজেল আসলে এখান থেকেই লোকালয়ের পথ ধরবো।

সর্দার এখন বেশ ব্যস্ত। মাথাও গরম। বলছেন, সেই কখন ফোন দিছি। তেল নিয়ে আরেকটা ট্রলার মাঝ নদীতে আটকে আছে। ওদিকে দুবলার চরে জেলেদের কী একটা সমস্যা হয়েছে। কোনো এক সাহেব এক জেলেকে পিটিয়েছেন। আমার জানা ছিলো না এই মারপিটের কাহিনী। যখন জানলাম তখন দেরি হয়ে গেছে। এসময় আমাদের চরে যাওয়া দরকার।

রান্না হতে হতে রাত হলো। জোয়ার হচ্ছে তীব্র গতিতে। পানি ফুলে ফেঁপে উঠছে। জোয়ারের তোড়ে স্রোত বেড়েছে। পশুর থেকে পানি ঢুকছে নীল কমল নদীতে। এই নদীটি বেশ লম্বা। পশ্চিমে গিয়ে হয়েছে বালির গাঙ। তারপর মিশেছে আড়পাঙ্গাসিয়ায়। এই নদী ধরে যাওয়া যায় চান্দাবুনিয়া, বইন্দে, কেওড়াশুঁটি কিংবা কাগা খালে। আরও উত্তরে হংসরাজ নদী ধরে আবার যাওয়া যাবে শিবসা বা পশুর নদীতে। পশ্চিমে আছো বাটলো নদী, কালির চর, কাগা দোবেঁকী। খুলনা বা সাতক্ষীরার জেলেরা এই পথ দিয়ে আসা যাওয়া করে।

রাত ৮টার দিকে ট্রলার আসলো। ডিজেল ভরা হলো ট্রলারে। তারপর একসাথে রাতের খাবার খেলাম। এখানে আর দেরি করবো না। সোজা যাবো দুবলার চরে। শুনলাম ওদিকের জেলেরা বেশ ক্ষুব্ধ। সাহেবদের অত্যাচার নিয়ে তারা সোচ্চার হচ্ছে। সর্দারকে নিয়ে একটু বেকায়দায় আছি। জেলেরা তাকে পছন্দ করে। তাই কোনো ঘটনা ঘটলেই তার কাছে বলে। এদিকে বেলায়েত সর্দার নিজেই একজন প্রান্তিক মানুষ। জেলেরা পছন্দ করে বলে সাহেবরা তাকে ভীষণ অপছন্দ করে। সুযোগ মতো পেলে তাকে ফাঁসিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনাও চলছে ভিতরে ভিতরে।

খবর শুনে বেলায়েত সর্দার বেশ উত্তেজিত। ভাত খেতে খেতে তাঁকে বললাম, এ সময় আপনার মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। কোনো একটা ভুল করলে আর টিকতে পারবেন না। জেলেদের হয়ে আমরা কাজ করবো। কিন্তু এখানে কাজ করতে হবে কৌশলে। মাথা গরম করা যাবে না কিছুতেই।

ঠিক হলো আমরা দুবলার চরে যাবো। তবে সেখানে বেশিক্ষণ থাকবো না। সামনের ভাটা পর্যন্ত চরে থাকবো। সকালের প্রথম জোয়ারে রওনা দিবো ওখান থেকে।

ইঞ্জিন চালু হলো। একসাথে দুই ট্রলার যাবে। সাগর কিংবা বড় নদীর মোহনা এখন একটু উন্মাতাল। গত রাতে আড়পাঙ্গাসিয়া নদী পাড়ি দেওয়ার সময় তা টের পেয়েছি। এখন পার হবো পশুর নদীর মোহনা। পানি টগবগ করছে। বুঝতে পারছি কঠিন হবে এ পথ।

সর্দার বললেন, টেনশন করেন কেন ভাই? দেখবেন ঠিক পার হয়ে যাবো। বললাম, আমি টেনশন করি না। আবার না বুঝে ঝুঁকি নিতেও চাই না। যে কাজে নেমেছি সেখানে এমনিতেই ঝুঁকির শেষ নাই। অবশ্য দুটি ট্রলার একসাথে গেলে ঝুঁকি কমবে।

নীল কমল নদী ধরে রওনা হলাম। সামনে পশুর নদী। তুফান হচ্ছে। বড় বড় ঢেউয়ের শব্দ পাচ্ছি। একটু একটু করে আগাচ্ছি। নদীর মুখে চর। তাই নির্দিষ্ট পথ ধরে ট্রলার চলছে। সামনে লগি হাতে পানি মাপছে মামুন। তার দেখিয়ে দেওয়া পথ ধরে চলছি আমরা। আমাকে দুশ্চিন্তা করতে দেখে সর্দার হেসে দিলেন। বললেন, আপনি ওই খালি ড্রাম নিয়ে বসেন। ট্রলার ডুবলে ধরে ভেসে থাকবেন। বাকী দায়িত্ব আমার।

সর্দার আমাকে ভরসা দিচ্ছেন। বললাম, জীবনের ভয় আমি পাই। তাই বলে ঘরে বসে থাকার মানুষ আমি না। এদিকে যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে তাহলে মারাও যেতে পারি। মরতে মরতে বাঁচলাম কতোবার। আমি একজন মারা গেলে পৃথিবীর কিছুই হবে না। কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়। ধরেন ট্রলার ডুবি হলো। কোনো ভাবে আমরা বেঁচেও গেলাম। কিন্তু তারপর কি আমাকে আমার স্বজনরা আসতে দিবে? যদি আসতে না পারি তাহলে দস্যুমুক্ত সুন্দরবনের বাকী কাজগুলোর কী হবে? কে করবে?

সর্দার বললেন, বুঝছি ভাই। আপনি শক্ত হয়ে দাঁড়ান। ওই দেখেন তুফান উঠছে পশুরে। অন্ধকারে নদীর অবস্থাআমি কিছুই দেখছি না। তবে বুঝতে পারছি। ট্রলার দুলছে এপাশ ওপাশ।

এই নদীতে একটা সুবিধা আছে। জায়গায় জায়গায় বয়া আছে, তাতে বাতিও জ্বলে। এক বয়া থেকে আরেক বয়া টার্গেট করে নদী পাড়ি দিচ্ছি আমরা। পানি বেশ উত্তাল। তবে গত রাতের মতো না। সর্দার বললেন, কালকে শুরুতে মামুন ছিলো সুকানিতে। ও বুঝতে পারেনি। আজকে দেখবেন ঠিক পার হয়ে যাবো।

গল্পে গল্পে পৌঁছে গেলাম দুবলার চর। পশ্চিম প্রান্তের খাল- আলোর কোলে ঢুকে পড়লাম। নোঙ্গর না করে সোজা ট্রলার নিয়ে ঢুকে পড়লাম চরের ছোট্ট এক খাল ধরে। জেলেরা এই খালের নাম দিয়েছে বোয়ালিয়া। এদিকে পাইকগাছার বোয়ালিয়া থেকে আসা জেলেরা বসবাস করে।

ট্রলার ভিড়িয়ে নেমে পড়লাম চরে। জেলেদের সাথে দেখা করবো, নিউমার্কেট যাবো। আবার জোয়ারের পানি থাকতে থাকতে বেরিয়ে পড়বো। রাতে বড় খালে নোঙ্গর করবো। তার আগে কিছু যোগাযোগের ব্যাপার আছে। দস্যুদল নোয়া বাহিনীর এক সোর্স আছে চরে। তার সাথে কথা বলবো। সময় মিললে ফিরতি পথে দেখা করবো তাদের সাথে। এছাড়া আজ এক জেলে ভাই সাহেবের হাতে মার খেয়েছেন। তার খোঁজটাও নিতে হবে।

(সুন্দরবন, নভেম্বর ২০১৬)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top