ভয় পাচ্ছি, আবারও ছড়িয়ে পড়ছে ভয় | রূপান্তরের গল্প ৩৩০ | Rupantorer Golpo 330 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ৩৩০ : ডাকাতি করতে অস্ত্র লাগে না, বুদ্ধি থাকলেই হয়। সুন্দরবনে দস্যুতা করতে হলে শুরুতে একটা বড় টর্চ লাইট লাগবে। ভয় দেখিয়ে চাঁদা চাইতে হবে। দস্যুদলের একটি নাম দিতে হবে তার আগে। রাতের অন্ধকারে ভীতি ছড়াতে হবে। মাঝে মাঝে এক দুইজন জেলেকে ধরে বেদম মারপিট করতে হবে। অন্ধকারে ত্রাশ ছড়াতে পারলেই দলের নাম ছড়িয়ে যায়। দস্যুনেতা যেই হোক, দল চলে সেই নামে। যেমন বড় সুমন বাহিনীর প্রধানকে আমরা সুমন ভাই ডাকি। কিন্তু তার আসল নাম- জামাল শরীফ।
মে ২০১৬ থেকে নভেম্বর ২০১৬, সাত মাসে সাতটি দস্যুদল আত্মসমর্পণ করলো। তারপরও সুন্দরবনের দস্যুদলের সংখ্যা সেই দেড় ডজনই থেকে গেছে। সমালোচকরা বলছেন, কোনো লাভ হলো না। সুন্দরবনে ডাকাতি বন্ধ হবে না। বরং আত্মসমর্পণের সুযোগ নিচ্ছে জঙ্গলের ভয়ঙ্কর অপরাধীরা। সেই সাথে সুবিধাভোগীর তালিকায় আমার নাম জুড়ে দিচ্ছে তারা। বলছে, এক একটি দস্যুদলের আত্মসমর্পণে মোটা অংক ঢোকে মোহসীন উল হাকিমের পকেটে।
অপপ্রচারগুলো এমন এমন জায়গা থেকে আসছে যা আমি চিন্তাও করতে পারিনি। মনটা খারাপ হয়ে যায়, ভয়ও লাগে। কখন না জানি বড় করে কেউ অভিযোগ করে বসে। এদিকে মিথ্যা সাক্ষী দিয়ে অন্যকে ফাঁসানোর চল আছে। মনের মতো করে অভিযোগ লিখে ভুয়া পরিচয় ও ভুয়া সাক্ষর দিয়ে বিভিন্ন সংস্থায় অভিযোগ করা হয়। তারপর যে যার মতো তদ্বীর করে, সংবাদ করানো হয়। মোট কথা কাউকে ঠেকাতে, অসম্মান করতে এ ধরনের অপচেষ্টা চলে অহরহ। এমন কিছু করাও হয়েছে এরই মধ্যে। কিন্তু হালে পানি পায়নি।
মাঠ পর্যায়ে কিছু সোর্স বেশ তৎপর। তারা বিভিন্ন সংস্থার মাঠকর্মীদের অপতথ্য দিচ্ছে। খবর পাচ্ছি যে তারাই আবার ওই দস্যুদলগুলোর সাথে যোগাযোগ করছে। মুক্তিপণ লেনদেনও চলছে তাদের হাতে। সুন্দরবনের দস্যুদের পৃষ্ঠপোষকরা বেশ শক্তিধর। অপহৃত জেলেদের উদ্ধারের পরিবর্তে বিভ্রান্তি ছড়াতে ব্যস্ত তারা। আমাকে থামানোর চেষ্টা তারাই করছে। আমার অফিসে, ঢাকার বিভিন্ন দফতরে অভিযোগ পাঠাচ্ছে আমাকে নিয়ে। আমি ভাবছি এই অভিযোগগুলো খন্ডন করবো নাকী সামনের কাজগুলো এগিয়ে নিবো? মন বললো, এসব এখন থাক। বনদস্যুদের আত্মসমর্পণের কাজটা এগিয়ে নেই।
ডিসেম্বর মাসের শুরুটা বেশ খারাপ হলো। সুন্দরবন জুড়ে তান্ডব চালাচ্ছে দস্যুরা। নতুন করে জন্ম নিচ্ছে ছোট ছোট ডাকাত বাহিনী। দায়িত্বশীলদের কেউ কেউ বলছে আত্মসমর্পণ করা দস্যুরা আবার নামছে। আবার জিজ্ঞেস করলে বলে, দূর থেকে তারা দল পরিচালনা করছে। সব মিলিয়ে গোলমাল চলছে বন উপকূলে।
সুন্দরবনে লম্বা সফর দিয়ে ঢাকা ফিরেছি। কয়টা দিন একটু বিশ্রাম নিবো। অফিস আমাকে সেই সুযোগ দেয়। সর্দারকে বললাম, আগামী কয়েক দিন সুন্দরবনে নামবেন না। বাড়িতে থাকবেন এবং সবার সামনে থাকবেন। উনি বললেন, জঙ্গলে আর দুবলার চরে না গেলে আমার পেট চলবে কী করে? বললাম, সে দায়িত্ব আমার। আপাতত নড়বেন না। আপনাকে নিয়ে গভীড় ষড়যন্ত্র হচ্ছে। আমাকে নিয়েও চলছে। তবে আমাকে পরাস্ত করা কঠিন। আপনার ক্ষতি করা সহজ।
চারদিন হয়ে গেলো। অপহৃত জেলেদের কোনো খোঁজ খবর পাওয়া যাচ্ছে না। জেলেদের পরিবার বিরাট দুশ্চিন্তায়। তারা টাকা জোগাড় করার চেষ্টা করছে। মুক্তিপণ তো দিতেই হবে। অন্যদিকে দস্যুদের হাত থেকে জেলেদের উদ্ধারে কাজ করছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীগুলো। কোস্টগার্ড ও RAB ব্যাপক তৎপর। কিন্তু আমি বুঝি, এই চেষ্টায় জেলেদের উদ্ধার করা বেশ কঠিন, অনিশ্চিত। সুন্দরবনে লুকিয়ে থাকা দস্যুদের খুঁজে বের করা প্রায় অসম্ভব। কেউ খুঁজে গেলেও তারা আগে থেকে টের পেয়ে যায়, জায়গা বদল করে ফেলে।
অদ্ভুত একটা ব্যাপার ঘটে সুন্দরবন উপকূলে। এই যে অর্ধশত জেলে কয়দিন ধরে নিখোঁজ, অথচ এনিয়ে স্থানীয় থানায় কোনো মামলা হয়নি। একটি সাধারণ ডায়রিও হয়নি। বড় মহাজনদের যারা দস্যুতা হলেই মায়াকান্না করেন, তাদের দিক থেকেও জেলেদের উদ্ধারে কোনো উদ্যোগ দেখি না। মুক্তিপণের টাকা জোগাড় করতে সূদে টাকা ধার নেয় পরিবার। ওই সাহেবরা তখন নিশ্চুপ। পরিবার থেকে সহযোগিতা চাইতে গেলে উনারা দেখাও দেন না।
অভিযান চলছে বলে দস্যুরা তাদের ফোন বন্ধ রেখেছে। জঙ্গলের ভিতরের গহীন কোনো খালে গিয়ে বসে আছে। এসময় ফোন ট্র্যাক করে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। এজন্য কোনো ঝুঁকি নেয় না তারা। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন বলে অপহৃত জেলেদের পরিবারের সদস্যরা উৎকণ্ঠায়। মনে মনে তারা বলে, উদ্ধার করতে পারেন না যখন তখন বিদায় নেন আপনারা। আমরা টাকা দিয়ে আমাদের লোক ছাড়ায়ে আনবো।
ঢাকায় বসে আমি সুন্দরবনের প্রতিটি দস্যুদলের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করছে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীগুলো উঠে আসার পর তারা ফোন খুলেছে। বড় সুমন আর নোয়া বাহিনীর সাথে কথা বলছি। নোয়া বাহিনীর প্রধান বাকী বিল্লাহ। পুরনো পরিচয়। পুরনো দস্যু রাজু’র আত্মীয়। তাকে বার বার আত্মসমর্পণের জন্য চাপ দিচ্ছি। আসবো আসবো করে সে এড়িয়ে যাচ্ছে। বলছে, অস্ত্রসস্ত্র গুছিয়ে চলে আসবো ভাই। আমাদের কয়েক মাস সময় দেন। বললাম, সময় দিতে পারবো না। দ্রুত না আসলে আমি কোনো দায়িত্ব নিতে পারবো না।
নোয়া বাহিনীর ভিতরে আমার কয়েকজন সোর্স আছে। মংলার কিবরিয়া, রামপালের মারুফসহ কয়েক জনের সাথে যোগাযোগ আছে। তাদের মাধ্যমে, সোর্সদের মাধ্যমে জানতে পারছি, ১০টি অস্ত্র আর দুই হাজার গুলির অর্ডার করেছে তারা। থ্রি নট থ্রি বন্দুক খুঁজছে নোয়া মিয়া। তার মানে অন্য দলের সাথে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা।
পরবর্তী দস্যুদল আত্মসমর্পণ করতে সময় লাগবে। বুঝতে পারছি যে বড় দলগুলো আপাতত সারেন্ডারের চিন্তা করছে না। মুখে মুখে বলছে তারা। কিন্তু পরিকল্পনা ভিন্ন। শুনছি, নোয়া মিয়া আগামী ইলিশ মৌসুম পর্যন্ত সুন্দরবনে থাকবে। কয়েক কোটি টাকা কামিয়ে আত্মগোপনে যাবে। দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার সব প্রস্তুতি তার নেওয়া। একই পরিকল্পনা নাটা জাহাঙ্গীরের। তার দলের সদস্যরা আত্মসমর্পণে আগ্রহী। কিন্তু জাহাঙ্গীর বলে, কোনো রকম সারেন্ডার হবে না। অবিশ্বস্তদের দল থেকে বের করে দিচ্ছে। দল বড় করার চেষ্টা করছো। সাগরে বড় ধরণের ডাকাতি করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
এদিকে পূর্ব সুন্দরবনের বড় সুমন বাহিনীর সাথে যোগাযোগ হলো। কথাবার্তা চলছে। তারা বেশ আগ্রহী। বলছে, যতো দ্রুত সম্ভব আত্মসমর্পণ করবে। শিগগিরি দেখা করার কথাও বলছে তারা। ওদের বললাম, তাহলে চলে আসবো? ওরা বললো, কয়টা ধরা জেলে আছে ভাই। ওদের বেচা-বিক্রি শেষ করে খবর দিবোনে।
বেচা বিক্রি কথা শুনতে কেমন জানি লাগে। আগে কথাটি শুনে ভাবতাম, মানুষ বেচা-কেনা হয় নাকী? দস্যুদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে জানলাম, সুন্দরবনের দস্যুরা মানুষ বিক্রি করে। কুড়ি হাজার থেকে কখনও কখনও পাঁচ লাখেও বিক্রি হয় মানুষ। মানে অপহরণ করা জেলেদের জন্য মুক্তিপণ নেয় তারা। জেলেদের পরিবার টাকা জোগাড় করে। বিকাশ সহ নানা মাধ্যমে টাকা হস্তান্তর হয়। ইদানিং সোর্স এর মাধ্যমে নগদ লেনদেন কম হয়। মোবাইল ব্যাংকিং আসার পর কাজটি বেশ সহজ হয়েছে। পরের দুই-তিন দিনের মধ্যে অপহৃত জেলেরা মুক্তি পেলো।
টাকা বুঝে পেয়েছে দস্যুরা। তারপর সুযোগ বুঝে ধরা জেলেদের পাঠিয়েছে। রাতে রাতে তারা ফিরেছে লোকালয়ে। বনদস্যুরা তাদের বিশ্বস্ত জেলেদের নৌকা করে জেলেদের পাঠায়। শুনলাম জেলেরা ডাঙ্গায় এসে যে যার মতো করে বাড়ি ফিরেছে। তারা সকলেই ক্লান্ত, অবসাদে ভরা শরীর মন। কিন্তু বাড়ি ফিরে বিশ্রাম নেওয়ার সময় নাই। চড়া সূদে নেওয়া ধারের সূদ শুরু হয়ে গেছে। সেই টাকা রোজগার করতে হবে। এদিকে আবার সূদের হার কখনও হাজারে চারশ টাকাও উঠে।
বিশ্রামও নেওয়া হয় না। কাজেও নামতে পারে না ওই জেলেরা। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের ডেকে পাঠায়। সব কাজ ফেলে তারা যায় শহরে, বাহিনীগুলোর দফতরে। স্যারেরা তাদের বসিয়ে রাখেন ঘন্টার পর ঘন্টা। তারপর জিজ্ঞাসাবাদ করেন। ডাকাত ধরলো কোথা থেকে? কোথায় নিয়ে গেলো? ওই দলে কারা আছে? তাদের নাম-পরিচয় দাও। সুন্দরবনের কোথায় তাদের আস্তানা আছে? এরকম হাজারও প্রশ্নে জর্জরিত হয় তারা।
মন খারাপের উপলক্ষের কোনো শেষ থাকে না তারপরও। বাড়ি থেকে এতোদূর আসা যাওয়া করে কোনো ফলাফল তো আসে না। আজকে এই ডাকাত ধরছে। কালকে নামলে আরেক ডাকাত ধরবে। এভাবেই তো চলছে সব। অন্যদিকে তাদের আসা যাওয়ার খরচ দেন স্যারেরা। তবে সেই টাকাও খেয়ে ফেলে সোর্সরা। শূণ্য পকেটে বাড়ি ফিরে ক্লান্ত জেলে। সন্তানদের জন্য একটু ফল বা মিষ্টি কিনতে পারে না। খালি হাতে বাড়ি ফেরা যে কতো যন্ত্রণার, কতো লজ্জার! কী কষ্টের জীবন ওদের!
ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে ফোন আসলো RAB সদর দফতর থেকে। চায়ের নিমন্ত্রণ। বললাম, আমি ভাই ক্লান্ত। কয়েকদিন বিশ্রাম নিতে চাই। নানা কারণে ইদানিং ভালো লাগছে না। কেমন জানি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে সবকিছু। মাঝে মাঝে মনে হয় কাজ বন্ধ করে দেই। ভয় লাগছে আমার। বিনা কারণে সম্মান হারানোর ভয়।
(ডিসেম্বর ২০১৬)