এবারের গন্তব্য ঘসিয়াঙ্গাড়ী | রূপান্তরের গল্প ৩৩৩ | Rupantorer Golpo 333 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ৩৩৩ : সুন্দরবন তো মহা গরম! এখন ডাকাতদের কাছে যাওয়া ঠিক হবে ভাই? বলছিলেন বেলায়েত সর্দার। আমি বললাম, গরমের মধ্যেই তো ঘুরে আসতে হবে। কিন্তু একথা কেন বলছেন সর্দার? উনি যা বললেন তাতে একটু দমে গেলাম।
সাম্প্রতিক দস্যুতা নিয়ে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর গোয়েন্দারা বেশ তৎপর। এটা স্বাভাবিক। কিন্তু সর্দার বললেন যে কেউ কেউ তাকে সন্দেহ করছে, অপহৃদ জেলেদের উদ্ধারে চাপ দিচ্ছে। মাঠ পর্যায়ের কিছু লোকজন সোর্সসহ বন উপকূলের লোকালয়ে তদন্ত করছে। মুখ ফসকে তাদের একজন বলেছে, এই ডাকাতিগুলোর ঘটনায় নাকী আমারও হাত আছে। এসব নিয়ে তদন্ত করছে তারা।
কিছু সময়ের জন্য থমকে গেলাম। কাউকে কিছু বললাম না। ঠিক করলাম, এই পরিবেশের মধ্যেই যাবো আমি। বেলায়েত সর্দারকে বললাম, ট্রলার রেডি করেন। তেল-বাজার তুলে রাখেন। ২৭ ডিসেম্বর রাতে নেমে যাবো আমরা। সর্দার বললেন, খুব মজা হবে ভাই। আসেন।
অফিসে আলাপ করলাম। এবারের সফরটি করবো সর্বোচ্চ গোপনীয়তার সঙ্গে। RAB এর কারও সাথেও আলাপ করলাম না। সাধারণত বরিশাল RAB এর উপ অধিনায়ক মেজর আদনানকে সব কিছু জানাই। এবার তাঁকেও জানালাম না।
২৭ ডিসেম্বর সকালে রওনা হলাম। সাথে বায়েজিদ ইসলাম পলিনকে নিলাম। পদ্মা নদী পার হয়ে গোপালগঞ্জে গিয়ে বিরতি নিলাম। দুপুরের খাবার খেয়ে চলে গেলাম বাগেরহাটে। সেখানে থাকবো সন্ধ্যা পর্যন্ত।
বাগেরহাটের খান জাহান আলী (র) এর মাজারের সামনে সাবেক দস্যুনেতা মাস্টার ভাইয়ের গ্যারেজ। ছোট একটি দোকান নিয়ে এখানে মটরসাইকেল মেরামত করেন তিনি। ঘন্টা খানেক তার সাথে সময় কাটালাম। তারপর দশানীর একটি রেস্তোঁরায় বসে রাতের খাবার খেলাম। রাতের খাবারের পর শেষ দফা ফোন দিলাম দস্যুনেতা বড় সুমননে। কখন, কোথায় তাদের সাথে দেখা হবে তা জেনে নিলাম।
দশানী থেকে রওনা হলাম। আমার সঙ্গে যোগ দিলেন বাগেরহাট জেলার সহকর্মী ইয়ামীন আলী। পথে দিগরাজ বাজারে আরেক দফা বিরতি নিবো। সেখানে চা খাবো, বাজার-সদা করবো। একটু সময় নিচ্ছি, কারণ এখনও জোয়ার হচ্ছে। দুই ঘন্টা পর ভাটা হবে। ওই ভাটায় সুন্দরবনে নেমে যাবো আমরা। সে পর্যন্ত এদিকেই থাকবো। মংলায় গেলে জানাজানি হবে। এবার কাউকে জানতে দেওয়া যাবে না।
ইয়ামীন ভাই বললেন, এতো লুকোচুরি কেন করছি ভাই? আমরা তো চোর না। বললাম, আপনি টের পাচ্ছেন না ভাই। একটি পক্ষ আমাকে চোর বানাতে চাচ্ছে। ঠিক চোর না, তার চেয়েও খারাপ কিছু বানানোর চেষ্টা করছে। আমাদের আশেপাশের ভাইয়েরাই সে অপচেষ্টা করছে। গত একমাসে অনেকগুলো ডাকাতি হয়েছে। এগুলো নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। আমাকে জড়িয়ে নতুন করে অপপ্রচার শুরু হয়েছে। আর সেটা করছে এদিকের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু মানুষ, কিছু সাংবাদিক আর কয়েকজন মাছ ব্যবসায়ী। এক অবৈধ অস্ত্রের ব্যবসায়ী কলকাঠি নাড়ছে।
ইয়ামিন ভাই বিশ্বাস করছেন না। বললাম, তথ্য প্রমাণ আছে। সে নিয়ে পরে কথা হবে।
বাজার করতে নামলাম। দিগরাজ বাজারটি বেশ বড়। সবকিছু পাওয়া যায়। আমি বেশি করে শাক সবজি কিনলাম। বনদস্যুদের ডেরায় যাওয়ার সময় সবজি নেই। কারণ জঙ্গলে এসব পাওয়া যায় না।
ওদিকে শেষ জোয়ারে ট্রলার ভাসিয়েছেন সর্দার। জোয়ারে ভেসে এগিয়ে আসছে তারা। মংলার উজানে পশুর নদীতে আমাদের দেখা হবে। এর মধ্যে মংলা থেকে আমার সোর্স আলমগীর পৌঁছে গেছে। জানালো, আমাদের সফর নিয়ে কেউ কিছু জানতে পারেনি এখনও।
রাত ১২টার দিকে জোয়ার শেষ হলো। আমরা গাড়ি ছেড়ে একটি ভ্যান নিলাম। গাড়ি চলে গেলো বাগেরহাট। গোপনে ট্রলারে উঠে বসলাম। সর্দার বললেন, এখন কী করবো ভাই? যুদ্ধ শুরু করবো? বললাম, নদীতে কুয়াশা কেমন? সর্দার বললেন, এখনও পরিস্কার আছে ভাই। কুয়াশা পড়বে ভোরের দিকে। বললাম, তাহলে ট্রলার ছাড়েন।
ইঞ্জিন চালু ছিলো। গিয়ার ফেলে ছুটলাম আমরা। সর্দারের হাতে সুকানি। পাশে দাঁড়ালাম আমি। সামনে গিয়ে বসলো মামুন। বাকীদের ঢুকালাম কেবিনের ভিতর। বললাম, ট্রলারের ভিতর কেউ আলো জ্বালবে না। সিগন্যাল বাতিগুলো নিভিয়ে রওনা হলাম আমরা।
সর্দার বললেন, কোন দিকে যাবো ভাই? বললাম, আপাতত ঘসিয়াঙ্গাড়ী। সেখান থেকে ওদের লোকজন আমাদের রিসিভ করবে। ওরাই নিয়ে যাবে দস্যুদের ডেরায়। আমরা কোথায় যাচ্ছি সে কথা আমি আর সর্দার ছাড়া কেউ জানে না।
পশুর নদী ধরে এই যাত্রাটা বেশ ঘটনাবহুল হয়। বন বিভাগ, কোস্টগার্ডের নজর এড়িয়ে ঢুকি আমরা। ফরেস্টারদের নজরে পড়লে বিপদ বাড়ে। আজ এই ঝামেলা ঘাড়ে নিতে চাই না। সর্দারকে বললাম, চোরের মতো করে যেতে পারবেন আজ? সর্দার বেশ মজা পেয়েছেন। বললেন, সে কথা বলবেন তো! দেখেন কী করি!
ভাটা শুরু হতেই মংলা বন্দর থেকে জাহাজ ছাড়ছে। লাইটারেজ আর বাল্কহেডগুলোও রওনা দিয়েছে। সেই সাথে নামছে বন্দরের দুইটি পাইলট জাহাজ। ট্রলার নিয়ে আমরা মাঝ নদীতে গেলাম।
এবার ধীরে ধীরে একটি লাইটারেজ জাহাজের পাশ ঘেঁষে চললো ট্রলার। এক পাশে জাহাজ রেখে নিজেদের আড়াল করছি আমরা। সর্দার বললেন, সুন্দরবন গরম তো ভাই। ফরেস্টাররা এখন খুব একটা ডিউটি করছে না। এছাড়া মরা গোন পড়ে গেছে। জেলেরা সব নদী থেকে উঠে পড়েছে। আজ মনে হয় ঝামেলা হবে না। বললাম, তারপরও সতর্ক থাকতে হবে।
ঢাংমারী, করমজল পার হলাম কোনো ঝামেলা ছাড়া। এরপর পড়লো জোংড়া ক্যাম্প। একটি বাতি জ্বলছে অফিসে। ট্রলার বাঁধা ঘাটে। এর পরের অফিস মরা পশুরেরও একই অবস্থা। ফরেস্টাররা একটু ঢিলেঢালা ডিউটি করছে। হাড়বাড়িয়ায় থামলো সাথে সাথে চলা লাইটারেজ। আমরা এবার আরেকটি জাহাজের আড়াল নিলাম। এখানে অনেকগুলো জাহাজ-কার্গো নোঙ্গর করা। কোস্টগার্ডের একটি কেবিন ক্রুজ আছে। অবশ্য আমাদের খেয়াল করেনি। এই আঞ্চলে বন্দরের জাহাজের নিরাপত্তা দিচ্ছেন উনারা।
ভদ্রা পার হলাম। নদীর মুখে ফরেস্ট অফিস। জেটিতে পাহাড়া আছে। আমাদের দেখে টর্চ জ্বালিয়ে সিগন্যাল দিলেন উনারা। এই দেখে সর্দার বললেন, সাইড থেকে সরে আসেন ভাই। গিয়ারটা নড়াচড়া করে দিলেন লিভার ধরে টান। গতি বাড়িয়ে ট্রলারের মুখ ঘুরিয়ে আমরা ছুটলাম পূর্ব দিকে। সর্দার বললেন, ধাওয়া করে ধরতে পারবে না। ওরা ট্রলার ছাড়তে ছাড়তে আমরা মেলা দূর চলে যাবো।
এদিকে পশুর নদীর পূর্ব দিকে কোনো ফরেস্ট অফিস নাই। সামনে চরাপূঁটিয়া পড়বে, তারপর আমাদের গন্তব্য- ঘসিয়াঙ্গাড়ি। ওদিকে বড় নদীর পাশে সচরাচর কোনো পাহাড়া থাকে না। সর্দার বললেন, আর কোনো টেনশন নাই। আপনি এবার ঘুম দেন। বললাম, আপনি পথ চিনবেন না। কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে হবে তা শুধু আমি জানি। কোন সিগন্যালে ওরা আমাদের কাছে আসবে তা আমি ছাড়া কেউ জানে না। ইশারা ভুল হলে ওরা পালিয়ে যাবে।
তাহলে আর কী করবেন? বসেন এখানে। বলেই চিৎকার করে মামুনকে ডাক দিলেন সর্দার। বললেন, ও মামুন, বা খাবো না আমরা? গলুই থেকে এসে রান্নাঘর খুললো মামুন।
চুলা জ্বালানো যাচ্ছে না। প্রচুর বাতাস। পাশের ছোট একটা খালে গিয়ে ট্রলার থামালাম। চায়ের সাথে হাল্কা খাবার খেলাম। সহযাত্রীরা সব গভীর ঘুমে। আমরা এখানে আরও ঘন্টা খানেক সময় থাকবো। তারপর আবার উঠবো পশুর নদীতে। এখান থেকে আরও ঘন্টা খানেক সময়ের মধ্যে পৌঁছে যাবো ঘসিয়াঙ্গাড়ী খালে। তখন ভাটা শেষ হবে। দস্যুনেতার সাথে শেষ কথা অনুযায়ী ভর রাতে শেষ ভাটায় আমাদের ওই খালে থাকার কথা।
(ডিসেম্বর ২০১৬)