বনদস্যুদের ইশারা | রূপান্তরের গল্প ৩৩৪ | Rupantorer Golpo 334 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ৩৩৪ : চারপাশ স্তব্ধ। ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দে কান ঝালাপালি। একটানা ডেকে যাচ্ছে। ইদানিং সুন্দরবনে জোনাকী দেখি না। কী যে হলো? এক সময় অন্ধকার রাতে এমন খাল জোনাকীর আলোয় ভরে থাকতো। টিপ টিপ করে জ্বলতো নিভতো। মনে হতো শহরের কোনো বিয়ে বাড়ির আলোক সজ্জা। কিন্তু কোনো এক কারণে মনে হয় জোনাকীগুলো হারিয়ে গেছে।
ইঞ্জিন রুমে কী যেন কাজ করছিলেন সর্দার। গলা বের করে বললেন, জঙ্গলের এই দিকের খালগুলোতে মণকে মণ বিষ পড়ে। পোকা মাকড় বাঁচবে কী করে? মধ্য সুন্দরবনের জঙ্গল বেশ গভীর। খালগুলোতে ঢুকলে গা শিউড়ে উঠে। ভীষণ রকমের বন্য লাগে। সেখানে আঁধার রাতে আলো জ্বালিয়ে জোনাকীর উড়ে বেড়ানোটা অশরীরী লাগে। তার সাথে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক মিলে যায়। মনে হয় অন্য কোনো পৃথিবীতে চলে এসেছি।
এদিকে আসলে মনে হয় টাইম ট্রাভেল করে অন্য জগতে এসে পড়েছি। কিন্তু সুন্দরবনে বিষ দিয়ে মাছ শিকার দুর্দমনীয় গতিতে বেড়ে চলছে। ভাবছি একদিন ডাকাত হয়তো বিদায় নিবে, বন্ধ হবে শিকার। কিন্তু বিষ মারা বন্ধ না হলে সুন্দরবনের কী যে হবে!
ইঞ্জিন রুম থেকে বের হলেন সর্দার। বললেন, যাবেন না? বললাম, ঘসিয়াঙ্গাড়ীতে ঢুকবো একদম শেষ ভাটিতে। সেভাবেই কথা বলা। এদিকে মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক নাই। তাই সময় এদিক সেদিক করা যাবে না। চলেন বের হই। ধীরে ধীরে আগাই।
খাল থেকে বের হওয়ার সময় বড় নদীর দুই পাশটা দেখে নিতে হবে। এই সময়টা খুব ঝুঁকিপূর্ণ। অন্য কোনো দস্যুদল থাকতে পারে। বন বিভাগ থাকলে সমস্যা নাই। কিন্তু এখন কোস্টগার্ডের সামনে পড়লে সব পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে। লগি দিয়ে ঠেলে বের করলাম।
উল্টো পাশে চাইলেবগী। খালটি পশুর নদীর পশ্চিমে হলেও উল্টো পাশের জঙ্গলকে বলে চাইলেবগীর ঠোঁটা। ওদিকে একটি বয়া আছে, রাতে আলো জ্বলে। কিন্তু কুয়াশার কারণে দেখা যাচ্ছে না। আমরা যাবো দক্ষিণে। পূর্ব পাশ ধরে নামবো। পথ চিনতে সমস্যা হবে না, কারণ ঘসিয়াঙ্গাড়ি খালের মুখেই আকটি বয়া আছে।
চারপাশ ভালো করে দেখে নেন। সর্দার দেখে শুনে বললেন, ও ভাই আমি তো রাতে চোখে দেখি না!
বলেন কী? চোখে না দেখলে রাত বিরাতে চলাফেরা করেন কী করে? সর্দার বললেন, আন্দাজের উপর চলি। বলেই হা হা হা করে হাসলেন। বললাম, তাই তো বলি মাঝে মাঝেই খালের উপর ট্রলার উঠে যায় কেন? আমিও হাসলাম। মামুনও হাসতে হাসতে বললো, সামনে দাঁড়ায়ে টর্চ দিয়ে পথ দেখাতে হয় ভাই। যাই হোক, কিছুক্ষণ পর ভোর হবে। আর সমস্যা হবে না।
ট্রলার চলছে বামে জঙ্গল রেখে। সর্দারকে ডেক এ বসিয়ে আমি দাড়ালাম সুকানিতে। মামুন যথারীতি সামনে গিয়ে বসেছে। টর্চ দিয়ে আলো ফেলে আমাকে পথ দেখাচ্ছে। ঘন্টা খানেক সময় চললাম এভাবে। ততোক্ষণে ভাটার স্রোত নরম হয়ে এসেছে।
সামনে বয়া। এখানে কুয়াশা একটু কম। দূর থেকেই বয়ার বাতি দেখতে পাচ্ছি। সর্দার বললেন, ওখানে খালেন মুখে চর আছে ভাই। একটু দূর দিয়ে ঘুরে তারপর খালে ঢোকেন। ধীরে ধীরে বেশ জায়গা নিয়ে ট্রলার ঘুরালাম। তারপর বাম পাশের খালে ঢুকে পড়লাম।
ভোর হচ্ছে। পূর্ব আকাশে আলো ফুটছে। সূর্য উঠার আগেই পুরো আকাশ একটু একটু করে পরিস্কার হচ্ছে। আমরা এগুচ্ছি সামনের দিকে। বনদস্যু সুমন বাহিনী এদিকেই কোথাও আছে। সামনে দুটি বড় বাঁক পার হতে হবে। তারপর একটি তুন খালের মুখ আছে। সোজা চলে গেছে সেলা নদীর দিকে। আর বাম পাশের খালটি গেছে চাত্রীর দিকে। আমরা চাত্রীর দিকে ঢুকবো। সেই পথ ধরে চলতে থাকবো। দস্যুনেতার সাখে সেভাবেই আমার কথা হয়েছে।
সর্দারের হাতে সুকানি ধরিয়ে বের হলাম। ডেক থেকে বের হয়ে সামনে যাবো। তার আগে হ্যাকেট, মাফলার পড়ে নিলাম। বাইরে বেশ শীত। কুয়াশা কাটছে ধীরে ধীরে। তবে রোদ উঠতে সময় লাগবে মনে হচ্ছে। আকাশে মেঘ আছে।
শেষ ভাটিকে সুন্দরবনের মানুষেরা বলে সার ভাটি। এসময় পানি চলে যায় খালের তলানিতে। স্রোত থেমে যায়। সেই সাথে পুরো সুন্দরবনকে মনে হয় প্রাণহীন। তবে জেগে উঠা চরে এসময় নেমে আসে ঝাঁক ঝাঁক হরিণ, বন্যশুকর আর বানর। এই খালের দুই পাশে তেমন কোনো চর নাই। তবে জঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে হরিণের চলাফেরা নজরে আসছে। এখানে কোনো মানুষের চিহ্ন নাই। জেলেরা থাকে। সম্ভবত ট্রলারের শব্দ পেয়ে পালিয়েছে তারা।
ট্রলারের গলুইয়ে আমি। সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছি। এসময় পিছনে এসে দাঁড়ালো আমার সোর্স আলমগীর। কানে কানে বললো, জায়গা মতো চলে এসেছি। যেকোনো সময় ওরা দেখা দিবে। আপনি ভিতরে গিয়ে বসেন।
দস্যুদের সাথে দেখা করতে গেলে আমি সর্বোচ্চ সতর্ক থাকি। অস্থির এই অপরাধীরা যেকোনো সময় ভুল বুঝতে পারে। সন্দেহ হলে গুলি করে বসতে পারে। আমি বলি, কেউ গুলিই যদি করে তবে সবার আগে আমার বুকে লাগুক। হাসতে হাসতে আলমগীর বললো, থাকেন ভাই। আমি আপনার পিছনে আছি।
সুন্দরবনে এসে দস্যুদের সাথে দেখা করা আমার জন্য নতুন কিছু না। তাদের বিশ্বাস অর্জন করার কৌশল, ওদের মনস্তত্ব মোটামুটি বুঝে গেছি। বাকী ঝুঁকিগুলো তাৎক্ষণিক ভাবে সামাল দেই। সুন্দরবনের দস্যুদের সাথে দেখা হওয়ার মুহুর্তটি সব সময় উপভোগ করি।
দুই বাঁক পেরিয়ে তিন মোহনা, তারপর বাঁক ঘুরে উত্তরের খাল ধরলাম। এই খাল চলে গেছে চাত্রী। মাইটে হয়ে ওদিক থেকে চরাপূঁটিয়া যাওয়া যায়। তবে ওই খালগুলো বেশ সরু। ভাড়ানীগুলোতে ট্রলার নিয়ে পার হওয়া মুশকিল। যাই হোক, বড় সুমন বাহিনীর সাথে দেখা করতে আমাদের অতো দূর যেতে হবে না। ধারণা করছি সামনেই ইশারা পাবো।
খালটি মাঝারি আকারের। ভাটায় পানি আছে শুধু মাঝখানে। দুই পাশে বেশ কয়েকটি ছোট ছোট খাল পার হলাম। সেগুলোতে মাছ ধরার, জাল পাতার আলামত আছে। দুটি খালে খালপাটা জালও দেখলাম। কিন্তু কোনো মানুষ নাই। আরেকটু সামনে শেষ হয়েছে এই খাল। ওখান থেকে ডানে বামে খাল চলে গেছে।
আগের সফরে এদিকে এসেছিলাম। আবহাওয়া খারাপ করায় ছিলাম কয়েক দিন। তাই চারপাশ বেশ ভালো চিনি। এছাড়া দস্যুনেতার দেওয়া নির্দেশনা অনুযায়ী এখানেই আমাদের আসার কথা। গলুইয়ে আমার দাঁড়িয়ে থাকার কথা। দেখলেই ইশারা দিবে।
ইশারায় সর্দারকে গতি কমাতে বললাম। সামনে দুই তিনটি খাল আছে। দস্যুরা থাকলে এর মধ্যেই আছে। পিছন থেকে আলমগীর বললো, এই যে ওরা। ভালো করে তাকালাম। দেখি ছোট্ট একটি খালের ভিতর ডিঙ্গি নৌকা। আমাকে দেখেই ইশারা দিলো। হাত তুলে পাল্টা ইশারা দিলাম আমি। ট্রলার থামালাম। ওরা বৈঠা বেয়ে রওনা দিলো আমাদের দিকে।
(ডিসেম্বর, ২০১৬)




