রূপান্তরের গল্প ৩৩৭ | Rupantorer Golpo 337

অস্ত্র জমা দিলো অবিশ্বাসীরা | রূপান্তরের গল্প ৩৩৭

অস্ত্র জমা দিলো অবিশ্বাসীরা | রূপান্তরের গল্প ৩৩৭ | Rupantorer Golpo 337 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ৩৩৭ : গাছের পাতাগুলো নড়ছে। ঝিরঝির বাতাসে এক রকম মাদকতা। ভালো লাগছে আবার কেমন জানি ভয় ভয়ও লাগছে। এর বাইরে পানির শব্দ ছাড়া চারপাশে আর কোনো শব্দ নাই।

পূর্ব সুন্দরবনের চাত্রী এলাকার ছোট্ট খালের এই জায়গাটিতে তিনটি মুখ। মূলত ডিঙ্গি নৌকার খাল। কিন্তু আমরা আস্ত দুটি ট্রলার নিয়ে ঢুকে পড়েছি এখানে। বড় সুমন বাহিনীর দস্যুরা আছে ১২-১৪ জন। নৌকাগুলোতে আছে ১৫-১৬ জন জেলে আর আমাদের ট্রলারে আছে ৭জন। সবাই নিচু স্বরে কথা বলছে। কারণ জোয়ার থাকা পর্যন্ত যে কেউ এপর্যন্ত চলে আসতে পারে। আমরা কোনো রকমের ঝুঁকি নিবো না।

আমি ভাবছি এখানে বাইরের আক্রমণের চেয়ে ভিতরের ঝুঁকিই বেশি। মানে যেকোনো ছুতায় দস্যুদের ভিতরে গোলাগুলি লাগার শঙ্কা করছি। দস্যুনেতা জামাল শরীফকে বললাম, ঝামেলার কেউ থাকলে তার থেকে অস্ত্র নিয়ে রাখেন। আমি কিন্তু কোনো ঝামেলা দেখতে চাই না। বিশেষ করে জুয়েলকে আমার সন্দেহ। ওর সম্পর্কে আগে থেকেই জানি। জুয়েলের সাথে শহরের বড় ভাইদের যোগাযোগ আছে। সেই বড় ভাইরা আপনাদের আত্মসমর্পণ করতে দিতে চায় না। দস্যুনেতা বললো, শুধু জুয়েল না ভাই, আরও দুইজন আছে। ওরা সারেন্ডারের কথা শোনার পর থেকে পালানোর চেষ্টা করছে। বললাম, তাহলে আজকেই দফারফা করেন। ওদের অস্ত্রগুলো কেড়ে নেন। তারপর বিদায় করে দেন।

দস্যুনেতা তার বড় ভাই রিপন শরীফকে ডাক দিলো। নিচু স্বরে কিছু নির্দেশনা দিলো। তারপর দস্যুদলের সবাইকে সামনে আসতে বললো। আমাকে সামনে রেখে বললো, তোমাদের অস্ত্র আর গুলি নিয়ে সামনে আসো। মোহসীন ভাই কথা বলবে।

সবার সাথে এবার জুয়েলও আসলো। তাকে কাছে ডেকে নিলাম। পিঠে হাত রেখে বললাম, এখন কি সারেন্ডার করবে? নাকী ডাকাতি চালিয়ে যাবে? সে বললো, আপনি যা বলবেন তাই করবো। বললাম, তাহলে সবাই যার যার অস্ত্র আমার সামনে রাখো। কথা মতো কাজ চললো। সবাই অস্ত্রগুলো নামিয়ে রাখলো। সহকর্মী বায়েজীদ ইসলাম পলিনকে বললাম, ক্যামেরা বের করেন।

দস্যুদের একটু ধোঁকা দিলাম। ক্যামেরা বের হতে হতে বললাম। বললাম, তোমাদের সাথে কথা বলবো এখন। যারা সারেন্ডার করবে না তারা একটু সরে দাঁড়াও, তোমাদের ছবি তুলবো না। সাথে সাথে দুইজন সরে গেলো। পাশের নৌকায় গিয়ে দাঁড়ালো তারা। দস্যুনেতাকে বললাম, ওদের অন্ত্রগুলো এদিকে নিয়ে আসেন। আর জুয়েলকে বললাম, তুমিও ওদিকে যাও। ছবি তুললে তুমিও সারেন্ডার করতে পারবে না। কথাটি বলে শেষ করতে পারিনি। তার আগেই অস্ত্র রেখে হাঁটা দিলো জুয়েল। আসলে এখন কোনো শ্যুটিং করার পরিকল্পনা নাই। তবুও ছবি তোলার কথা বলে সন্দেহভাজনদের নিরস্ত্র করলাম।

তিনজন ছাড়া বাকী দস্যুরা যার যার বন্দুক তুলে নিলো। কোমড়ে সবার গুলির পোসেস। এরপর যে যার দায়িত্বে চলে গেলো। তিনটি বন্দুক পড়ে রইলো আমাদের ট্রলারের পাটাতনে। কানে কানে সর্দার এসে বললেন, ও ভাই, মেশিনগুলো কি আমরা নিয়ে যাবো? বলেই হেসে দিলেন। আমিও হাসতে হাসতে দস্যুনেতাকে ডাকলাম। বললাম, বন্দুকগুলো আপনার হেফাজতে নিন। অবশ্য তার আগে সর্দার আর আমি হাতে বন্দুকগুলো নিয়ে ছবি তুললাম। পরিবেশ হাল্কা করতে এসব করছি। আসলে ভয়ও পাচ্ছি। এখানে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে সামাল দেওয়া মুশকিল হবে। ছবি তুলে অস্ত্রগুলো তুলে দিলাম দস্যুনেতার হাতে।

ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে দুইজন দস্যু যাবে ডিউটিতে। খালের মাথায় থাকবে তারা। কোস্টগার্ড বা বনরক্ষীরা এদিকে আসলে সাথে সাথে জানান দিবে তারা। দস্যুদের ডেরায় থাকা কালে এই ঝুঁকিটাই সবচেয়ে বেশি থাকে। আমরা ঝুঁকি নিবো না। সহকর্মীদের ডেকে সতর্ক করে দিলাম। বললাম, ভাটা না হওয়া পর্যন্ত সবাই চোখ কান খোলা রাখবেন।

বাজারের ব্যাগগুলো তোলা হলো একটি নৌকায়। ভাবছি ওদের তো ট্রলার আছে। সেখানে না নিয়ে নৌকায় নিলো কেন? প্রশ্নটি মনে রাখলাম। তারপর ট্রলার থেকে নেমে এগিয়ে গেলাম। তার আগে নেমেছে আলমগীর। জুয়েলের সাথে কথা বলছে সে। পেছনের একটি নৌকায় বসা নিরস্ত্র আরও দুইজন। চোখে চোখ পড়তেই এগিয়ে এলো সে। বললাম, পলিনকে ক্যামেরা রেডি করে বের হতে বলেন। শ্যুটিং শুরু করবো।

দস্যুরা নড়েচড়ে বসলো। বললাম, আপনারা বাড়তি কিছু করবেন না। যে যার কাজ করেন। আমরা ফাঁকে ফাঁকে কাজ করবো। নৌকায় উঠে বসলাম। ততোক্ষণে বাজারের ব্যাগ আর বস্তাগুলো খালি করছে তারা। বাজার দেখে বেশ খুৃশি।

দস্যুদের কাছে যাওয়ার সময় বাজারের তালিকা আগে থেকে করি না। যাওয়ার সময় বড় কোনো হাটে নামি। বেশি করে নানা রকমের শাক ও সবজি কিনি। লাউ, মিষ্টি কুমড়া, আলু জাতীয় সবজি বেশি দিন টিকে থাকে। তাই একটু বাড়িয়ে এসব কিনি। এছাড়া দেশি ফল নিয়ে নেই ব্যাগ ভরে। এছাড়া এক দুই কেস এনার্জি ড্রিঙ্ক, কয়েক প্যাকেট সিগারেট আর বেশি করে পান ও সুপারি কিনে নেই। সব মিলিয়ে তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকার বাজার করলেই হয়ে যায়। এবারও আসার সময় মংলার দিগরাজ বাজার থেকে এসব কিনেছি।

বনদস্যুরা তাদের প্রতিদিনের খাবারে মাছ বা মাংস খায়। নদী-খালে মাছের অভাব নাই। জঙ্গলে হরিণের অভাব নাই। প্রায় প্রতিদিন হরিণ শিকার করে তারা। মাঝে মাঝে বন্দুক দিয়ে গুলি করে বকের ঝাঁকের উপর। মাঝে মাঝে চর বাটাং পাখি শিকার করে। এর বাইরে আর কোনো খাবার নাই এখানে। শাক সবজি তাদের কাছে সোনার হরিণ। তাই দাম কম হলেও এই বাজারে তারা বেশ খুশি হয়। আজও খুশি তারা। কারণ যে কাঁচা বাজার এনেছি তাতে অন্তত সপ্তাহ খানেক কেটে যাবে।

পিঠে বন্দুক ঝুলিয়ে একজন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নির্দেশনা দিচ্ছে। নাম তার রফিকুল। মধ্যবয়সী এই দস্যুর বাড়ি ঢাংমারীর রেখামারী। পুরনো দস্যু। এই দলে সে নানা রকমের দায়িত্বে আছে। বলা যায় দলের দ্বিতীয় ব্যক্তি। জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে জেলেদের অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়, হিসাব, রান্নাঘর সবকিছুই তার ঘাড়ে। তার নির্দেশে কাজ করছে জেলেরা।

বাজারগুলো গুছিয়ে ফেললো ওরা। বড়ফের বাক্স খোলা হলো। বাক্স ভর্তি চিংড়ি মাছ। নৌকার খোলের ভেতর অনেকগুলো কাউইন মাছ। নৌকার পাটাতনের উপর কয়টা মেদ মাছ রাখা। দুপুরে কী খাবো জানতে চাইলো রফিকুল। বললাম, ভাত আর কাউইন মাছ করলেই হবে। আপনারা খাওয়ার জন্য শাক সবজি দিয়ে কিছু একটা করেন। তাহলেই হবে। বড়ফের বাক্স থেকে চাকা চিংড়ি বের করা হলো। এক ঝুরি চিংড়ি। জেলেরা পাশের নৌকায় নিয়ে কাটা বাছা শুরু করলো। চারটি কাউইন মাগুর বের করা হলো। সেগুলো নেওয়া হলো আরেক নৌকায়। দা-বটি নিয়ে কাটতে বসলেন বেলায়েত সর্দার।

রফিকুলের সাথে গল্পে বসলাম। চুলার পাড়ে বেশি জায়গা নাই। তাই দুজন বসলাম দুই নৌকায়। পাশে এসে বসলো জুয়েল। চা উঠলো চুলায়। ট্রলার থেকে গুঁড়া দুধ আনলো মামুন। রান্না হতে সময় লাগবে। তাই পেঁয়াজ মরিচ দিয়ে মুড়ি মাখানো হলো। গরম গরম দুধ চায়ের সাথে সাত সকালে মুড়ি খেতে ভালোই লাগছে।

গল্পে গল্পে জানলাম এই দস্যুদলের আদ্যোপান্ত। যে ট্রলারটি দেখছি সেটি অপহরণ করা। চারটি ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে দস্যুদের বহর। সুন্দরী কাঠ দিয়ে গড়া নৌকাগুলো বেশ মজবুত। এগুলোও জেলেদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া। এখানে ৭জন অপহৃত জেলে আছে। তাদের কারও বাড়ি কয়রা, কারও জয়মনি। এরা মোড়েলগঞ্জের জেলেদের কিছু বলে না। কারণ দস্যুনেতার বাড়ি সেখানে। দলের বেশির ভাগ সদস্যের বাড়ি বাগেরহাটের মোড়েলঞ্জ।

কথায় কথায় রফিকুল অনেক কিছু জানালো। খুলনার দাকোপ উপজেলার ঢাংমারী থেকে সুতারখালী এলাকার কারা সুন্দরবনে মাছের ব্যবসা করে, কারা দস্যুদের সহযোগিতা করে, কারা অবৈধ অস্ত্রের ব্যবসা করে, সবকিছু পরিস্কার হলো। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েক জন সোর্স এর বিষয়ে জানতে চাইলাম। রফিকুল বললো, ওরা সব দিকেই খেলে। আমাদের অস্ত্র-গুলি কিনে দেয় আবার আমাদেরকেই ধরিয়ে দেয়। এদের জ্বালায় আমরা ভালো হতে পারি না। নিয়মিত টাকা না দিলে সোর্সরা আমাদের বিরাট ক্ষতি করে ফেলে।

চা খেয়ে আমাদের ট্রলারে ফিরলাম। নৌকায় নৌকায় রান্না চড়লো। দস্যুনেতার সাথে এবার গল্পে বসলাম। বনদস্যুদের আত্মসমর্পণের প্রক্রিয়া নিয়ে নানা প্রশ্ন তার। বললাম, এতোগুলো দস্যুদল সারেন্ডার করলো। তারপরও আপনাদের এতো প্রশ্ন কেন? বিশ্বাস করতে না পারলে বলেন, আমরা ফিরে যাই। দস্যুনেতা জামাল শরীফের বড় ভাই রিপন শরীফ এসে হাত ধরে বসলো। বললো, ওসব কথা বলবেন না ভাই। আমরা ডাকাতি ছেড়ে দিবো, বাড়ি ফিরবো। বললাম, সেজন্য আমার কথা মতো চলতে হবে। সে বললো, আপনার কথার বাইরে কেউ যাবে না ভাই। আমি বললাম, তাহলে তৈরি হন।

(সুন্দরবন, ডিসেম্বর ২০১৬)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top