লিখতে জানে না একজনও | রূপান্তরের গল্প ৩৩৯ | Rupantorer Golpo 339 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ৩৩৯ : সুমন নামে পুরনো এক বনদস্যু ছিলো। বেশি দিন দস্যুতা করতে পারেনি সে। দলের মধ্যে কোন্দলের এক পর্যায়ে দলের সদস্যরা তাকে গুলি করে। সুমনের মৃত্যুর পর কিছুদিনের জন্য দলটি নিষ্ক্রীয় থাকে। তারপর নতুন পুরাতন মিলিয়ে বাগেরাটের কয়েকজন দস্যু আবার সংগঠিত হয়। বড় সুমন বাহিনী নামে ডাকাতি শুরু করে। পুরনো নামে দস্যুবাহিনী চালানোর সুবিধা অনেক।
দস্যুনেতা জামাল শরীফকে বললাম, নিজেদের নামে দল করেননি কেন? সে বললো, এই দল তো অনেক আগের। নতুন করে নিজের নাম ছড়ানোর দরকার কী? এই যে ডাকাতি করি, প্রশাসন জানে সুমন বাহিনী। লিডার যে আমি জামাল শরীফ তা কেউ জানে না। আবার নতুন করে নাম ফুটাতে সময় লাগে। নতুন নামে বাহিনী করলেই তো হয় না। জেলেরা সুমন বাহিনীর নামে চাঁদা দেয়। জামাল বাহিনী নাম দিলে কি সহজে টাকা দিবে?
সত্যিই তো। নাম একটা বড় ব্যাপার। এর আগে শান্ত বাহিনীও এমন পুরনো নামে চলা দস্যুদল ছিলো। দস্যুনেতা যে বারেক তালুকদার তা বাইরে থেকে কেউই জানতাম না। এই দলের প্রধান জামাল শরীফ বললো, মাঝে মাঝে থানায় জিডি হয়, মামলা হয়। সেখানে কিন্তু লিডারের নাম হিসাবে আসে নেতার নাম। আমাকে সবাই সুমন নামে জানে। মামলাও হয় সেই নামে। আমি কিন্তু আসামী হই না! সত্যিই তো! জঙ্গলের এই নিষিদ্ধ জগতে এসে কতো কিছু জানছি!
সুন্দরবনের দস্যুতার ইতিহাস নিয়ে ধোঁয়াশা আছে। ঠিক কবে, কোথা থেকে এর শুরু, কী ভাবে এই অপরাধ জগৎ প্রসারিত হলো পুরো বন জুড়ে তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট ইতিহাস আমার জানা হয়নি। তবে এফ এম আব্দুল জলিলের লিখা ‘সুন্দরবনের ইতিহাস’ বইটি পড়ে জেনেছি, বাছের ঢালী নামে এক দস্যু প্রথম সুন্দরবনে সংগঠিত দস্যু দল গড়ে তোলে।
ষাটের দশকের ঘটনা। খুলনার কয়রার কপোতাক্ষ নদের তীরের গোবড়া গ্রামের বাসিন্দা ছিলো বাছের ডাকাত। অনেকটা সর্বহারাদের মতো করে এলাকার ধনীদের বাড়িতে ডাকাতি করতো সে। তারপর লুকিয়ে থাকতো সুন্দরবনের ভিতর। গোবড়া থেকে সুন্দরবন নদীর এপাশ ওপাশ দূরত্ব। সঙ্গীদের নিয়ে সে বনের ভিতরে থাকতো। মাঝে মাঝে সুযোগ বুঝে ডাকাতি করতো লোকালয়ে। পরবর্তীতে সরকার তাকে আটক করে। মামলা হয়। বিচারে জেল হয় তার। ওই মামলায় সুন্দরবন উপকূলের কিছু তরুণেরও নাম আসে। তাদেরও সাজা হয়। এরপর বিক্ষিপ্ত ভাবে দস্যুতা চলতে থাকে।
গল্প চলছে। একে একে বড় সুমন বাহিনীর দস্যুরা পাশে এসে বসেছে। কেউ একটু দূরে দাঁড়িয়ে শুনছে সে গল্প। এরা সবাই প্রান্তিক পরিবার থেকে এসেছে। জঙ্গলে মাছ কাঁকড়া ধরে চলতো। কিন্তু কেমন করে জালের বদলে হাতে বন্দুক উঠেছে তারা বলতেও পারে না। পরিবেশ পরিস্থিতি তাদের বিপথে ঠেলেছে। একজন একজন করে তারা বলছে দস্যুতায় আসার কারণ।
বড় সুমন বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে পুরনো দস্যু মাত্র তিন জন। দলনেতা জামাল, তার ভাই রিপন ও রফিকুল। বাকী সবাই দুই বছর আগেও ছিলো সুন্দরবনের জেলে। অর্থনৈতিক টানাপোড়েনে তারা দস্যুতায় নেমেছে। এরা প্রত্যেকেই ঋণগ্রস্ত। আছে একাধিক সূদের মামলা যা স্থানীয় ভাবে চেক এর মামলা নামে পরিচিত। ওয়ারেন্ট হয়ে গেলে আর বাড়ী থাকার উপায় থাকে না। পুলিশ আর সোর্সদের তাড়া খেয়ে জঙ্গলে নামে।
কয়রার তরুণ এক দস্যু আকরাম। বললো, দুই সূদের মহাজনের কাছে তার ঋণ ছিলো মোট ত্রিশ হাজার টাকা। তারপর সূদ দিয়ে গেছে দুই বছর। কিন্তু আসল আর শোধ হয়নি। টাকা দেওয়ার সময় তিনটি করে ফাঁকা চেক সই করে নিয়েছে মহাজন। তারপর এক লাখ টাকার মামলা দিয়েছে। সব তথ্য প্রমাণ মহাজনের হাতে। সূদ লেনদেনের কোনো কাগজ-পত্র নাই। তাই মামলা হওয়ার পর তথ্য প্রমাণ দিয়ে তা চলে যায় সূদের কারবারীর পক্ষে। তরুণ দস্যু আকরাম বললো, জুয়েল তাকে নিয়ে এসেছে। কথা ছিলো মাসে ২০ হাজার টাকা বেতন পাবো। তিন মাস ডাকাতি করে টাকা নিয়ে উঠে যাবো। কেউ জানতে পারবে না। বাড়ীতে বলে আসছি, ঢাকায় কাজ করতে যাচ্ছি, তিন মাস পর ফিরবো। কিন্তু এর মধ্যে সব জানাজানি হয়ে গেছে।
লোভের ফাঁদে পড়ে অনেক তরুণই সুন্দরবনের দস্যু হয়েছে। তাদের গল্পগুলো একই রকম। ভাবে কয়েক মাস ডাকাতি করে টাকা নিয়ে চলে আসবো। কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী টাকা দেয় না দস্যুনেতা, ঝুলিয়ে রাখে, ফিরতেও দেয় না। এর মধ্যে জঙ্গলে তার ডাকাতি করার তথ্য ছড়িয়ে যায়। দেখতে দেখতে সাধারণ এক তরুণ আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর মোস্ট ওয়ান্টেডে পরিণত হয়। আর ফিরে যাওয়ার উপায় থাকে না।
একটু দূরে দাঁড়িয়ে গল্প শুনছে জুয়েল। খালি হাতে বেশ অসহায় লাগছে। কাছে ডাকলাম। জানতে চাইলাম, কিছু বলবে? কানের কাছে এসে নিচু স্বরে বললো, আপনি যাবেন কখন? বললাম, রাতে বা কাল দিনে। তুমি যাবে আমার সাথে? জুয়েল বললো, নিয়ে যাবেন। এখানে থাকলে ওরা মেরে ফেলবে।
জামাল শরীফকে বললাম, এই দলে কিন্তু কোনো রকমের অঘটন দেখতে চাই না। সারেন্ডার যদি করতেই চান তবে দস্যুতা বন্ধ করেন। সবকিছু গোটায়ে ফেলেন। আমার সাথে চলেন। আত্মসমর্পণ করে জেলখানায় যাবেন। তারপর জামিন নিয়ে বাড়ি ফিরবেন। দেখবেন এবার আর কেউ কিছু বলবেন না। দস্যুনেতা বললো, আমরা কি সাধারণ ক্ষমা পাবো না? বললাম, কে বললো সাধারণ ক্ষমা পাবেন? আপনারা আত্মসমর্পণ করবেন কোনো শর্ত ছাড়া। অন্যরাও তাই করেছে। বেশ হতাশ হলো সবাই। বললাম, আপাতত সাধারণ ক্ষমা নাই। মামলা চলবে। তারপর সরকার যদি মনে করে তো মামলাগুলো প্রত্যাহার করবে। সেটা লম্বা সময়ের ব্যাপার। আপনাদের অযথা কোনো আশ্বাস দিবো না আমি।
আলোচনায় গতি আসলো না। বেশ হতাশ সবাই। মুখে কিছু বলছে না তারা। তবে চোখগুলো বলছে, এই আত্মসমর্পণ তাদের পোষাবে না। আমিও কিছু বললাম না। শুধু পর্যবেক্ষণ করছি। ওদের বললাম, একটা দরখাস্ত লিখেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে লিখেন, আপনারা সাধারণ ক্ষমা চান। আমি সেই দরখাস্ত মন্ত্রীর হাতে পৌঁছে দিবো।
হিসাবের খাতা থেকে এক পৃষ্ঠা কাগজ আনা হলো। মলিণ কাগজটি আমার সামনে রাখলো একজন। পকেট থেকে কলম বের করলাম। বললাম, আমি বলছি আপনারা কেউ লিখেন। কিন্তু কলম আর কেউ নেয় না। লিখাও শুরু হয় না। সবাই তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
কী হলো? কে লিখবেন? দস্যুনেতাকে বললাম, আপনি লিখবেন? হেসে দিলো সে। বললো, আমরা লিখতে পারলে তো আর জঙ্গলে ডাকাতি করতে আসতাম না। বললাম, কেউ একজন লিখতে পারেন না? জামাল শরীফ বললো, লেখাপড়া জানা থাকলে কি আর সূদের চক্রে পড়ি ভাই? অশিক্ষত বলেই তো সবাই আমাদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে খায়।
আমার এক সহকর্মীকে বললাম, আপনি লিখে দেন। দরখাস্তে সাক্ষর করলো দস্যুনেতা জামাল শরীফ। আবার একটু শ্যুটিং করলাম। এর মধ্যে দুপুর গড়িয়ে গেছে। থালায় চামচের বাড়ি দিয়ে ঘণ্টা বাজাচ্ছেন বেলায়েত সর্দার। মনে পড়লো, সকাল থেকে চা-বিস্কিট ছাড়া কিছু খাইনি।
(ডিসেম্বর ২০১৬, সুন্দরবন)