রূপান্তরের গল্প ৩৪৩ | Rupantorer Golpo 343

গডফাদাররা কলকাঠি নাড়ে, হত্যা করায়! | রূপান্তরের গল্প ৩৪৩

গডফাদাররা কলকাঠি নাড়ে, হত্যা করায়! | রূপান্তরের গল্প ৩৪৩ | Rupantorer Golpo 343 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ৩৪৩ :  জঙ্গলের ডাকাত দলগুলোর সদস্যরা ঘুমায় কখন? আমি তো দেখি, এই বৈরী পরিবেশে নির্ঘুম দিন-রাত কাটায় তারা। ওদের চোখগুলো সব সময়ই লাল থাকে। ক্লান্তিতে ভেঙ্গে পড়া শরীরগুলো বিশ্রাম চায়। কিন্তু একটানা ঘুম তাদের জঙ্গল জীবনে নাই। অস্ত্র হাতে যখন একজন ঘুমায় তখন তার বিশ্বস্ত আরেকজন জেগে থাকে। শত্রু শুধু আইন শৃঙ্খলা বাহিনী বা অন্য দস্যুদল না। দলের মধ্যেই যে কেউ গুলি করে বসতে পারে। জেলেরাও সুযোগ পেলে ছাড়বে না। বনদস্যুরা বলে, এতো অবিশ্বাসের মধ্যে ঘুমানো যায়? বেঁচে থাকা যায়?

দায়িত্বে অবহেলার দায়ে দুই বনদস্যুর বিচার চলছে। এদিকে আমার শরীর ভরা ক্লান্তি, চোখ ভরা ঘুম। তারপরও উঠে দাঁড়ালাম। ক্লান্তিকে পাত্তা দেওয়া যাবে না।

ট্রলারের ছাদে ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুয়ে আছে অন্যরা। সর্দার চলে গেছেন গভীর ঘুমে। অন্যরাও যে যার মতো ঘুমাচ্ছে। ভাবছি এখন একটা ঝামেলা হলে কী হবে? যদি কোনো আক্রমণ হয়, অভ্যন্তরীণ গোলাগুলি লাগে তখন কী হবে? যদি বাঘ এসে হানা দেয় তখনও তো নিজেদের বাঁচাতে হবে। এক কথায় কোনো ঝামেলা হলে দৌড়ে পালানোরও প্রস্তুতি লাগবে।

আপন মনে বললাম, এখন বাঘ আসলে তো এরা সবাই মারা পড়বে! সাথে সাথে উত্তর দিলেন সর্দার। বললেন, ঘুমাইছে তো আমার চোখ। জঙ্গলে আসলে কান তো ঘুমায় না! আমি অবাক। গভীর ঘুমে থাকা একজন কী ভাবে কান খাড়া রাখে? সম্ভবত সুন্দরবনের মানুষেরা এভাবে কান সজাগ রেখেই ঘুমায়। বললাম, রাতের বেলা বিপদ বাড়ে। ট্রলারের সবাইকে নজরে রাখবেন। আমি একটু বিচার দেখে আসি।

পাশের ট্রলারে বসা বনদস্যুরা। দস্যুনেতা জামাল শরীফ বেশ ক্ষিপ্ত। বকাঝকা করছেন অভিযুক্ত দুই দস্যুকে। ওরা মাথা নিচু করে বসা। আমি গিয়ে ওদের পাশে বসলাম। চোখে-মুখে তাদের ভয়, লজ্জা। অস্ত্রগুলোর মালিক দস্যুনেতা। আর বনে ডাকাতি করতে এটাই তাদের প্রধান শক্তি। এক একটা বন্দুক জোগাড় করতে ওদের বেগ পেতে হয়। শুধু টাকা থাকলেই হয় না। অবৈধ অস্ত্রের বাজারে তাদের ঘনিষ্ঠতাও লাগে। সেই সাথে লোকালয় থেকে বন্দুকগুলো কিনে হাতে আনা পর্যন্ত প্রক্রিয়াটি বেশ লম্বা-চওড়া।

অভিযুক্ত দুজনই তরুণ। দস্যুতার বয়স বছর পার হয়নি। তাই সুন্দরবনের এই অপরাধ জগতে নির্ঘুম থাকার সক্ষমতা আসেনি। জানতে চাইলাম, ওরা দুজন যে অপরাধ করেছে তার শাস্তি কী? দস্যুনেতা বললো, আগামী সাতদিন ওরা ডাবল ডিউটি করবে। বাকী সময় রান্নায় সাহায্য করবে। তারপর হাতে মেশিন দিবো। বললাম, খালি হাতে ডিউটি করবে কী করে? বললো, সাথে সশস্ত্র একজন থাকবে। অন্য কোনো লিডার হলে তো ওদের বেঁধে রাখতো, দল থেকে বের করে দিতো। আমি অতো বড় শাস্তি দিবো না।

বিচার শেষ। এবার চা আসবে। সবাই ফিরবে যার যার কাজে। আমি বললাম, এবারের মতো দুইজনকে ছাড় দেওয়া যায় না? অনুরোধে কাজ হলো। এবারের মতো তাদের ছাড় দিলো দস্যুনেতা। হাতের অস্ত্র ফিরে পেয়ে বেজায় খুশি তারা।

চা খেতে খেতে অনেক গল্প হলো। দস্যুনেতাসহ অন্যরা তাদের দূরবস্থার কথা জানালো। ঘরে ফিরে যাওয়ার আকুতি ছিলো সবার কথায়। সন্দেহভাজন দস্যু জুয়েলও এবার বেশ নরম। বললাম, শান্ত বাহিনীর সাথে সারেন্ডার করলে না কেন তুমি? সে বললো, দেনা পাওয়ার সমস্যা ছিলো। বললাম, তাহলে ওদের অস্ত্র নিয়ে পালালে কেন? সেই অস্ত্রটা কোথায়? চুপ হয়ে গেলো সে।

জুয়েলকে বললাম, মন পরিস্কার করো। তারপর কথা বলো। বড় সুমন বাহিনীতে থাকতে হলে, আত্মসমর্পণ করতে হলে তোমাকে ওই অস্ত্রের হিসাব দিতে হবে। জুয়েল বললো, শান্ত বাহিনীর একটা বন্দুক আর কয়েকটা গুলি ছিলো তার কাছে। সেগুলো বিক্রি করেছে সে। বললাম, তোমার কথা বিশ্বাস করি না এখনও। তবে যদি বিক্রি না করে থাকো তবে সারেন্ডারের সময় সেটি জমা দিবে। জুয়েল নিশ্চুপ।

দস্যুনেতা জামাল শরীফ বললো, শহরের গডফাদাররা আমাদের চুষে খাচ্ছে। এই যে জেলেদের উপর অত্যাচার করি, তাদের মারপিট করি, টাকা নেই। এসব করতে ভালো লাগে না। কিন্তু ডাকাতি করতে এসে ভদ্রলোকের মতো বসেও থাকতে পারি না। অস্ত্র-গুলির দাম দিতে হয়। আমাদের রোজগারের টাকা থাকে শহরের লোকদের হাতে। বারো ভুতে খায় এই টাকা। আমরা হয় জঙ্গলেই মারা পড়ি, অথবা জেলখানায় পচে মরি।

আরেক দস্যু রফিকুল বললো, কখনও কখনও গডফাদাররাই আমাদের হত্যা করায়, দলের মধ্যে ঝামেলা লাগায়। বললাম, আপনারা তো ঘুমাতেও পারেন না। আপনাদের কারণে জেলেরা ঘুমাতে পারে না। আবার টাকা পয়সাও বারো ভুতে খায়। তার চেয়ে সারেন্ডার করেন। দস্যুনেতা বললো, একটু সময় দেন, আমরা সারেন্ডার করবো।

আপনারা সহজে সারেন্ডার করবেন বলে মনে হচ্ছে না। তবে যেহেতু আলোচনা শুরু হলো। বেঁচে থাকলে একদিন সারেন্ডার করবেন হয়তো। আমার কথা শুনে চোখ বড় বড় করে দস্যুনেতা বললো, সময় নিবো না ভাই। বললাম, সারেন্ডার যে করবে সে সময় নেয় না। কিন্তু আপনারা মনে হয় সময় নিবেন। আপনার দলের মধ্যে সমস্যা আছে। এগুলো ঠিক করেন। আমি রাতেই চলে যাবো। সময় হলে ডাক দিবেন।

দস্যুনেতার পাশাপাশি অন্যরাও বললো, আর দুই দিন থাকেন ভাই। এখনই যাবেন কেন? ভালো মন্দ খাওয়াতে পারলাম না এখনও। কাল ফাঁস জাল থেকে বড় মাছ আনবো। এদিকে বড় বড় পাঙ্গাস মাছ পাওয়া যায়। মাঝে মাঝে মেধ মাছও পড়ে। বললাম, আপাতত আপনাদের সাথে আর কাজ নাই। ঢাকা ফিরতে হবে।

তিন পোয়া জোয়ার হলো। কুকু পাখির ডাক শুনে বুঝলাম সেটা। টর্চ ফেলে দেখি খাল প্রায় ভরে গেছে পানিতে। আমরা চাইলে এই জোয়ারে বের হতে পারি। চিপা খালে আর ভালোও লাগছে না। বাতাস নাই। দস্যুদের ভিতরের অবস্থাও গুমোট। মন শুধু বলছে, এই জায়গা ছাড়তে হবে।

নৌকাগুলোর চুলায় চুলায় আগুন জ্বলছে। রান্না হচ্ছে রাতের খাবার। গলদা চিংড়ির ভুনা হবে আজ। সাথে থাকবে সবজি। আরেক চুলায় মরিচ ভাজছে জুয়েল। পেঁয়াজ আর ভাজা শুকনা মরিচ দিয়ে ভর্তা হবে। ঠিক হলো, রাতের খাবার খেয়ে আমরা এই জায়গা ছাড়বো।

ভরা জোয়ারের সময় আকাশে মেঘ জমলো। হাল্কা বৃষ্টিও পড়ছে। সুন্দরবনে এমর হয়। আকাশ বাতাস চলে তার খেয়াল খুশি মতো। বৃষ্টি গায়ে লাগতেই সহযাত্রীরা উঠে বসলো। শুধু পলিনের ঘুম ভাঙ্গলো না। বৃষ্টির কারণে একটু নড়েচড়ে আবাব ঘুমিয়ে পড়লো। আমার এই সহকর্মী ভীষণ ঘুমকাতুরে।

সবাইকে ডাক দিলাম। বললাম, তৈরি হন সবাই। গোছগাছ করে নেন। আমরা বের হবো। আমার কথা শুনে জেলেরাও নড়াচড়া শুরু করলো। বুঝতে পারছি ওরা উতলা হয়ে আছে। অর্ডার পেলেই ছুট দিবে। কিন্তু দস্যুদের সাথে দেখা হয়ে গেলে সহসা ছাড়া পায় না। আজ আমরা বের হলে তারাও ছাড়া পাবে। শুধু অপহৃতরা ছাড়া অন্যরা চলে যাবে যে যার কাজে।

রাতের খাবারটা তেমন ভালো লাগলো না। রান্না করেছে দস্যুদলের বাবুর্চি। ঝাল-লবণ কম। বললো, অন্ধকারের রান্না করছি। তাই লবণ-মসলা ঠিকঠাক পড়েনি। বললাম, অসুবিধা নাই। মরিচ ভর্তা মিশিয়ে নিলেই চলবে। ইচ্ছা করেই বললাম, রান্না খারাপ হয়নি। সত্যি বলতে রাধুনীর পরিশ্রমকে সম্মান জানাতে হয়। মন খারাপ করানোর দরকার কী?

খাওয়া শেষ হলো। জোয়ার শেষ। ভাটা শুরু হলো। এখন থেকে আগামী ছয় ঘন্টা পানি কমবে। এই খাল থেকে বের হতে হলে আমাদের ঘন্টা খানেকের মধ্যে রওনা দিতে হবে।

মামুন আর শহীদুল কাকু গোছগাছে নামলো। ট্রলারের ইঞ্জিন চেক করলো। নতুন করে ডিজেল ভরলো। মামুন নেমে পড়লো খালে। প্রোপেলার চেক করে আবার উঠে পড়লো। সামনে লম্বা সফর। তাই রওনা দেওয়ার আগে সবকিছু দেখে নেওয়া নিয়ম। সেটা হতে পারে দিনের যেকোনো সময়, যেকোনো পরিবেশে। সমুদ্রের মাঝেও প্রোপেলার চেক করতে পানিতে নামে তারা। যাই হোক, সব দেখেশুনে মামুন জানালো, ট্রলার ওকে। কিন্তু বেলায়েত ভাইকে খুঁজে পাচ্ছি না! ট্রলারে নাই, কোনো নৌকাতেও নাই।

সর্দার কই? কোথায় গেলো? আবার হারিয়ে গেছে লোকটি!(

ডিসেম্বর ২০১৬, সুন্দরবন)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top