ক্লান্ত শরীর একটু ঘুম চায় | রূপান্তরের গল্প ৩৪৪ | Rupantorer Golpo 344 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ৩৪৪ : মুহুর্তের মধ্যে পুরো শরীর ঘেমে গেলো। কাঁধ আর ঘাড়ের মাঝামাঝি জায়গাটি দিয়ে দরদর করে ঝরছে ঘাম। কান-মাথা গরম হয়ে গেছে। এলোমেলো ভাবনা ঘুরছে মাথায়। আবারও চিৎকার করে বললাম, সর্দার কোথায়? জানি ফিরে আসবে। তারপরও ভীষণ দুশ্চিন্তা হচ্ছে!
লোকটি মাঝে মাঝেই এমন করে। অন্যরা কেমন জানি নির্বিকার। বিড়বিড় করে বলছে, আশেপাশে কোথাও আছে। চলে আসবেনে। তাহলে ডাকাডাকি করেও সাড়া পাচ্ছি না কেন? হলো কী? লোকটা গেলো কোথায়? আমার চিৎকার শুনে এক জেলে বললো, বেলায়েত ভাই জঙ্গলে গেছে। আমি আরও জোরে চিৎকার করে উঠলাম। আরেক জেলে বললো, সাথে লোক গেছে ভাই।
মিনিট দুই পর জঙ্গল ফুঁড়ে বের হলেন সর্দার। সাথে আরও দুইজন। বললাম, গেলেন কোথায়? সর্দার বললেন, দুপুরে স্যান্ডেল একটা রেখে আসছিলাম ভাই। আমি হাসবো না কী করবো বুঝতে পারছি না। দুপুরে এদিকেই বাঘ দেখা দিলো। সন্ধ্যায় ডাকাডাকি করলো। এখন গভীর রাত। ওদিকে না গেলে হতো না? সর্দার বললেন, একটা স্যান্ডেল জঙ্গলে ফেলে রেখে যাবো ভাই? বললাম, আপনারা পারেনও। আমি তো দুশ্চিন্তায় শেষ। সর্দার বললেন, চলেন ভাই। খাল ছাড়বো এখন।
নৌকাগুলো খোলা হলো। প্রথম নৌকাটি দস্যুদের। তারপর আমাদের ট্রলার। তারপর আরেকটি ট্রলার। তার পর বাকী নৌকাগুলো। সবার শেষে দস্যুদের আরেকটি নৌকা। ছোট খাল ধরে ধীরে ধীরে আমরা এগিয়ে চললাম বড় খালের দিকে। লগি দিয়ে ঠেলতে ঠেলতে গিয়ে পৌঁছালাম খালের মুখে। ওখানে পাহাড়ারত দুই দস্যু উঠলো আমাদের ট্রলারে।
চাত্রী খাল ধরে আমরা যাবো ঘসিয়াঙ্গাড়ী খালে। প্রথমে দস্যুদের বিদায় দিবো। এখান থেকে ছেড়ে দেওয়া হবে অন্য নৌকাগুলো। বিদায় নেওয়ার সময় বেন্দী জালের নৌকা থেকে একটা টুকরি তুলে দিলো জেলেরা। হয়তো আলমগীরের বাড়ির জন্য মাছ দিয়েছে। এখন এসব নিয়ে কথা কথা বলার সময় নাই। দ্রুত দস্যুদের থেকে আলাদা হতে হবে।
জামাল শরীফের নেতৃত্বে দসুদল বড় সুমন বাহিনী। বিদায় নিলো তারা। জুয়েলসহ দুজন আত্মসমর্পণে অনাগ্রহী দস্যু আমাদের সাথে যেতে চাইছে। কিন্তু তাদের নিয়ে যাওয়া আমাদের ঝুঁকি বাড়াবে। ওরা সব মোস্ট ওয়ান্টেড আসামী। ক্রসফায়ারের তালিকাতেও তাদের নাম। কোনো বিপদ হলে সামাল দিতে পারবো না।
দস্যুনেতাকে বললাম, জুয়েলরা থাকলো আপনার কাছে। এরপর আপনি যা ভালো বুঝবেন করবেন। শুধু নির্যাতন করবেন না বা ধরিয়ে দিবেন না। বাকী বিষয়ে পরে কথা হবে।
দস্যুরা বিদায় নিলো। খাল ধরে পূর্ব দিকে চলে গেলো ওরা। জেলেদের নৌকাগুলো নিয়ে আমরা সেখানেই নোঙ্গর করলাম। জেলেরা থেকে গেলো আমাদের সাথে। দস্যুরা চোখের আড়ালে যাওয়ার পর ওদের বললাম, আপনারা এখন যেতে পারেন। শুধু বেন্দী জালের জেলেরা রওনা দিলো। উজান ঠেলে যাবে তারা। কারণ বড়ফের নৌকায় না গেলে মাছগুলো নষ্ট হবে। আবার পরের ভাটায় জাল তুলতে হবে। এবার নাকী এমনিতেই মাছ কম হচ্ছে। একজন বললো, এখানে মাঝে মাঝে জালে কুমির ঢুকে পড়ে। তাই জালের খেয়াল রাখতে হয়।
জানতে চাইলাম, কুমির ঢুকলে কী করেন? ওরা বললো, জাল কেটে দেই। যদি বড় হয় তাহলে জাল কাটা ছাড়া উপায় থাকে না। মাঝে মাঝে শুশুক আটকা পড়ে। তখন জাল থেকে ছাড়ায়ে দেই। কুমির যদি ছোট হয় তাইলে জাল তুলে ছাড়ায়ে দেই। এখন যে বাচ্চাগুলো উঠছে সেগুলো তো হাত দিয়েই ছাড়ানো যায়, এখনও দাঁত গজায়নি।
জেলেদের একটি নৌকা চলে গেলো। আমি অন্যদেরও চলে যেতে বললাম। কিন্তু তারা কেউই এখন আমাদের ছেড়ে যেতে চাইছে না। ওরা মনে করছে আমাদের কারণে বনদস্যুরা ওদের এতো তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিয়েছে। ওরা এখনও আশেপাশেই আছে। আমরা চলে গেলে আবার এসে ধরতে পারে। এক প্রবীন জেলে বললেন, সুন্দরবনের ডাকাতদের বিশ্বাস নাই ভাই।
বিশ্বাস অবিশ্বাস নিয়ে প্রচুর কথা হয় এদিকে। বিস্তীর্ণ বন জুড়ে যে মানুষেরা চরে বেড়ায় তাদের মধ্যে এক রকমের সংযোগ আছে। সে হতে পারে জেলে, ডাকাত কিংবা শিকারী। ওরা সবাই সবার ভাষা বুঝে। সবাই সবার মতো করে বেঁচে থাকে, টিকে থাকে। শুধু দস্যুদের নিয়ে সমস্যা। আরেকটি সমস্যা বন বিভাগ।
বনরক্ষীদের কথা উঠতেই একজন বলে উঠলো, ওরাই বড় ডাকাত। দেখবেন সুন্দরবনের ডাকাতরা চলে গেলে তারা আমাদের উপর নির্যাতন করবে। বললাম, আপনারা নিয়মের মধ্যে থাকবেন। তাহলে আর নির্যাতনের সুযোগ পাবে না। জেলেরা বললো, ও আপনি বুঝবেন না ভাই। আমি হাসলাম। মনে মনে ভাবছি, জেলেদের এই শংকা যেন সত্য না হয়।
জেলেদের নিয়ে সুন্দরবনের এই জায়গাটিতে অবস্থান করা উচিৎ হবে না। দস্যুবহুল অঞ্চল। কখন কে চলে আসে কে বলবে? অপরিচিত কোনো বাহিনী আসলে সামাল দেওয়া কঠিন হবে। সবচেয়ে বড় সমস্যা, তারা ভয় পাবে। তারপর আমাদের ভয় দেখাতে গোলাগুলি শুরু করতে পারে। রাতের অন্ধকারে কী ঘটবে তেই বলতে পারে না। সর্দার ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ডেকে বললাম, এই জায়গাটা ছাড়তে হবে ভাই। আমরা ঘসিয়াঙ্গাড়ীর মুখে গিয়ে নোঙ্গর করবো। ট্রলার ছাড়েন।
নৌকাগুলো বাঁধা হলো একটার পর একটা। মামুন গেলো ইঞ্জিন রুমে। বেশ ভারী কুয়াশা পড়েছে আজ। তবে সামনের পথটুকু চিনতে সমস্যা হবে না। ভাটা চলছে। চাত্রী থেকে ঘসিয়াঙ্গাড়ী যেতে সময় লাগবে খুব বেশি হলে এক ঘণ্টা।
কুয়াশায় কিচ্ছু দেখা যায় না। এসময় টর্চ ফেললে আরও সমস্যা হয়। তাই রাতের বেলা সুন্দরবনের নদী-খালে চলার সময় সব রকমের আলো নিভিয়ে রাখতে হয়। সুকানিতে দাঁড়িয়ে সর্দার বললেন, আপনার লোকজন সামনে মোবাইল ফোন চালাচ্ছে। আলোর কারণে দেখতে সমস্যা হচ্ছে। চিৎকার করে পলিনকে ডাক দিলাম। বললাম, সামনে কোনো আলো জ্বলবে না।
ট্রলারের পাশ দিয়ে পিছনে আসলেন ভিডিওগ্রাফার পলিন। সর্দারকে বললেন, আপনি কি রাতে চোখে দেখেন ভাই? সর্দার রেগে বললেন, রাতো অতোটা দেখি না। চলি আন্দাজের উপর। এই পথঘাট আমার চেনা তো! পাশ থেকে মামুন বললো, রাতের বেলা পাশে না থাকলে আমাদের ক্যাপ্টেন কিছুই দেখে না ভাই। সবাই মিলে হেসে উঠলাম। বললাম, চুলা জ্বালাও মামুন। চা খাবো।
আমাদের ট্রলারের পিছনে বেশ কয়েকটি নৌকা ছিলো। কিন্তু থামার পর যখন নোঙ্গর করলাম, তখন দেখি মাত্র দুইটি নৌকা আছে। বাকীগুলো চলতি পথে বিদায় নিয়েছে। আমরা নোঙ্গর করলাম ঘসিয়াঙ্গাড়ীর মুখ থেকে একটু ভিতরে। এখান থেকে পশুর নদী দশ মিনিটের পথ।
চুলা জ্বললো রান্নাঘরে। চায়ের পানি উঠলো। আমরা ডেক এ গল্পে বসলাম। কিছুক্ষণ পর যোগ দিলো নৌকার জেলেরা। ডাকাতের গল্প থেকে বাঘের গল্প, সুন্দরবনে ভুত দেখার গল্প, ফরেস্টারদের সাথে লুকোচুরির গল্প এমন কী শিকারের গল্পও শুনছি ওদের মুখে।
রাত তিনটা পেরিয়েছে। আমরা এখানে থাকবো শেষ ভাটা পর্যন্ত। তারপর জোয়ার লাগলেই ছুটবো। ততোক্ষণে অবশ্য সকাল হয়ে যাবে। সর্দার বললেন, আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে ক্ষুধা লাগছে ভাই! বললাম, তা তো লাগছেই। কিন্তু আমার ক্ষুধা লাগছে সেটা আপনি পের পেলেন কী করে? আমি তো কাউকে বলিনি যে ক্ষুধা লাগছে! সর্দার বললেন, ওদের রান্না আপনি খেতে পারেননি।
তাহলে কি এখন রান্না করবেন? এতো সময় আছে? সর্দার বললেন, ভাত রাঁধবো কে বললো ভাই? এখন হবে চাল ভাজা! সথে সাথে ডেক থেকে নামলেন সর্দার। চাল ভাজার প্রস্তুতি শুরু হলো। মামুন বসে পড়লো রসুন আদা কাটতে। ট্রলারে কাঁচা মরিচও আছে। ঝাল লবণ বেশি দিয়ে সর্দারের এই চাল ভাজার স্বাদ আমি বর্ণনা করতে পারবো না। কারণ প্রতিবারই এটি খেয়েছি ক্ষুধা পেটে, মধ্য রাতে, সুন্দরবনের কোনো গহীন খালে।
চাল ভাজা খেতে খেতে আসলো দুধ চা। তারপর বিশ্রাম নিবো। জেলেরা চলে গেলো নৌকায় নৌকায়। সর্দার আমি আর পলিন শুয়ে পড়লাম ডেক এর উপর। বাতি নিভিয়ে দিয়ে ইঞ্জিন রুমে ঘুমাতে গেলো মামুন। সহযাত্রী আলমগীর আর শহীদুল কাকু আগে থেকেই ঘুম।
বড় নদীর পাশে আমরা। বাতাস অনেক বেশি। উত্তরা বাতাস, তীব্র শীত। কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম আমরা। অন্যরা দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়লো। কিন্তু আমার চোখে ঘুম নাই। শরীর ভীষণ ক্লান্ত। কিন্তু সবাই ঘুমিয়ে পড়লে হয় না। দলনেতা হিসাবে নিরাপদে মংলা পর্যন্ত পৌঁছানো পর্যন্ত আমার ঘুমালে চলবে না। অন্যরা ঘুমাক।
সুন্দরবনের একদম গভীরে এই সময়টা দারুণ লাগে। একটু পর পূর্ব আকাশে আলো ফুটবে। ধীরে ধীরে সকাল হবে। এসব দেখতে এলোমেলো ভাবনায় হারিয়ে গেলাম। হঠাৎ করে গুলির শব্দ! পর পর কয়েকটি গুলি হলো। কিছুক্ষণ পর আবারও চললো গুলি। অনেক দূর থেকে আসছে সে শব্দ। সম্ভবত দস্যুদের দুটি গ্রুপ মুখোমুখি হয়েছে কোথাও। ভাবছি, ওরা যা পারে করুক। আমি বরং একটু বিশ্রাম নেই। ক্লান্ত শরীরটা একটু থুম চায়।
(ডিসেম্বর ২০১৬, সুন্দরবন)