অন্ধকার নদী ধরে ছুটছে তিনটি ট্রলার | রূপান্তরের গল্প ৩৫১ | Rupantorer Golpo 351 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ৩৫১ : প্রথম গুলিটা করলাম আমি। তার সাথে সাথে গুলি করলো জাহাঙ্গীর মামা। জঙ্গলের ভিতর দিয়ে হেঁটে গেছিলাম বলে ওরা টের পায়নি। নোয়া বাহিনীর উপর হামলার বর্ণনা দিচ্ছে বাছের। ভাগ্নে বাছের নামে পরিচিত জাহাঙ্গীর বাহিনীর এই দস্যু। আমাকেও মামা বলে ডাকে সে।
তারপর কী হলো? ওরা কী করছিলো? জানতে চাইলাম। বাছের বললো, ওরা রাতের খাবার খাচ্ছিলো। খালের মুখে পাহাড়া ছিলো। কিন্তু আমরা বড় খালে ট্রলার রেখে জঙ্গলে নামছিলাম। দুই ভাগে ভাগ হয়ে আমরা দুই দিক থেকে আক্রমণ করি। গুলি করার সাথে সাথে নোয়া মিয়া লাফায়ে খালে পড়ে। তারপর দৌড় দিয়ে ঢুকে পড়ে বনে। ওই দলের অন্যরাও ঝুপঝাপ করে কাদার মধ্যে নেমে পড়ে। পাল্টা গুলি করার সুযোগ দেইনি আমরা। একটানা নয়টা বন্দুক চলে। যতোক্ষণ ওরা মেলা দূরে না গেছে ততক্ষণ গুলি বন্ধ করিনি।
জানতে চাইলাম, কেউ হতাহত হয়নি? বাছের বললো, তা কবে কিডা? ওই জায়গায় আমরা দেরি করিনি। গুলি করতে করতে বের হইছি। ওরা ট্রলার ফেলে পালাইছে। সেটা টেনে আনছি। আমাদের ট্রলার ফেরত নিছি। সাথে দুইটা বন্দুক ছিলো, গুলি ছিলো মেলাগুলো। তার মধ্যে তিনশ দশ বন্দুকের গুলি ছিলো শ’খানেক। থ্রি ওয়ান জিরো বোরের বন্দুকটা টার্গেট করছিলাম। কিন্তু সেটা নিয়ে গেছে ওরা। বললাম, ওরা গুলি করেনি? সে বললো, গুলি করার টাইম দেইনি তো মামা! ট্রলার ভর্তি বাজার সদাও ছিলো।
বাছের হাসছে। বিজয়ের হাসি। অথচ তিনদিন আগে তাদের উপর নোয়া বাহিনী আক্রমণ করেছিলো। সেদিন আক্রান্ত সিংহের মতো ছটফট করছিলো তারা। বললাম, তোমার লিডার কোথায়? পাশে আছে? বাছের বললো, মামা এখন অন্য ফোনে কথা বলে। বললাম, তাহলে থাক। ফোনন রাখলাম।
মিনিট খানেকের মধ্যে আবার ফোন দিলো বাছের। দস্যুনেতা জাহাঙ্গীর ওপাশ থেকে বললো, জাহাঙ্গীরের উপর গুলি চালায়ে কেউ বাঁচতে পারবে না। এই সুন্দরবনে আমার সাথে পাল্লা দিতে আসলে তাকে জীবন দিতে হবে। বললাম, এই গোলাগুলির জীবন আর কতোদিন? সারেন্ডার করেন। সে বললো, এই জঙ্গল থেকে আমার লাশ যাবে। কেউ আমাকে সারেন্ডার করাতে পারবে না। বললাম, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আপনাকে সারেন্ডার করতে বলেছেন। দস্যুনেতা বললো, প্রধানমন্ত্রী বললেও সারেন্ডার করবো না।
বনদস্যু জাহাঙ্গীর অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে। ভাবছি, তাকে থামাতে না পারলে সুন্দরবন অনেক বেশি সন্ত্রস্ত হয়ে উঠবে। শুধু বন না পুরো বঙ্গোপসাগরে তান্ডব চালাবে সে। একছত্র ক্ষমতার লোভে অন্ধ এই দস্যুনেতা কোটি কোটি টাকা কামানোর পরিকল্পনা করছে।
সন্ধ্যার আগে একটি অচেনা নাম্বার থেকে ফোন আসলো। দাকোপের ঢাংমারীর এক সোর্স। বললো, নোয়া বাহিনীর খবর পাওয়া গেছে। নিশানখালীর একটি খালে তাদের দেখা গেছে। তবে সরাসরি যোগাযোগ হয়নি। কী করি ভাবছি। এমন সময় ফোন আসলো সুন্দরবন থেকে। ওপাশে নোয়া মিয়া। বললো, আর ডাকাতি করবো না। আপনি এসে আমাদের নিয়ে যান। বললাম, যেখানে আছেন সেখানেই থাকবেন। আমি কাল সকালে রওনা দিচ্ছি।
নোয়া মিয়ার ফোন রেখে বরিশালে ফোন দিলাম। RAB এর মেজর আদনান কবীরকে জানালাম। তারপর ফোন দিলাম RAB এর গোয়েন্দা প্রধান লে কর্নেল আজাদকে। সাথে সাথে তিনি ঊর্ধতনদের সাথে কথা বললেন। আমাকে এগিয়ে যেতে বললেন।
পরদিন ৬ জানুয়ারি। সকাল সকাল রওনা হলাম। সঙ্গী হলেন সহকর্মী বায়েজীদ ইসলাম পলিন। বেলায়েত সর্দারকে ফোন দিলাম। একদিনের বাজার সদা নিয়ে তৈরি থাকতে বললাম। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানানো হলো। উনি ৭ জানুয়ারি সময় দিলেন। পটুয়াখালীর কুয়াকাটায় হবে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান।
ফেরিতে পদ্মা নদী পার হতে গিয়ে বিপত্তিতে পড়লাম। মাওয়া ঘাটে গিয়ে দেখি ফেরি বন্ধ। কুয়াশার কারণে ভোর থেকে ফেরি চলছে না। গাড়ি ঘুরিয়ে পাটুরিয়া ঘাটে গেলাম। বহু কসরৎ করে ফেরি পার হলাম। তারপর লম্বা পথ পেরিয়ে বাগেরহাট। সেখান থেকে সহকর্মী ইয়ামীন ভাই যোগ দিলেন। ওদিকে বরিশাল থেকে রওনা দিয়েছেন RAB সদস্যরা। মংলা থেকে সন্ধ্যায় রওনা দিবো সুন্দরবনের উদ্দেশ্যে।
RAB এর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ অন্যদের সাথে দেখা হলো মংলায়। সেখানে আগে থেকে বেলায়েত সর্দার তার ট্রলার নিয়ে প্রস্তুত। আরও দুটি ট্রলার আছে। RAB সদস্যরা যাবেন। হাতে সময় কম। তাই কোনো রকমে গোছগাছ করে রওনা হলাম।
কোথায় যাচ্ছি আমরা? RAB এর টিম লিডার সহকারি পুলিশ সুপার জসীম ভাই জানতে চাইলেন। বললাম, আপাতত শিবসা নদীতে যাচ্ছি। তারপর ফোনে তাদের সাথে কথা হবে। তখন জানা যাবে কোথা থেকে নিবো তাদের। আসলে কোথায় আছে দস্যুরা আমি জানি। শুধু আমিই জানি। আপাতত আর কাউকে জানাবো না। শুধু ট্রলারগুলোতে বেশি করে জ্বালানী তেল ভরে নিতে বলেছিলাম।
যাবো নিশানখালী। কিন্তু ভদ্রা দিয়ে যাবো নাকী চালনা হয়ে যাবো বুঝতে পারছি না। ভদ্রা দিয়ে গেলে আদাচাইয়ের ভাড়ানী দিয়ে ঢুকতে হবে। কিন্তু সেই ভাড়ানী দিয়ে ট্রলার ঠিকঠাক যাবে কী না জানি না। অনেক দিন ওদিকে যাইনি। রাতের বেলা পথঘাট চিনতে সমস্যা। তার উপর কুয়াশা পড়লে মহা বিপদ হবে। আজ কোনো কারণে পথ ভুল করার সুযোগ নাই।
ট্রলার চললো। প্রথমে আমাদেরটি। পিছনে অন্য দুটি অনুসরণ করবে আমাদের। মংলা থেকে পশুর নদী ধরে উজানে যাবো। উত্তরে ঘন্টা খানেক চললাম। তারপর চালনা থেকে ঢুকে পড়লাম ঢাকী নদীতে। ঢাকী গিয়ে পড়েছে শিবসায়। সেখানে সুতারখালী নদীও মিশেছে শিবসার সাথে।
উল্টো স্রোত ঠেলে এগুচ্ছি। তার মধ্যে পিছনের একটি ট্রলারের ইঞ্জিন দুর্বল। কী যে একটা অবস্থা! কুয়াশা বাড়ছে। অমাবশ্যার গোন চলে। তীব্র স্রোত নদীতে। টর্চের আলোর ইশারা দিয়ে একে অন্যকে অনুসরণ করছি। ভাটার স্রোতে দিক ঠিক রাখা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
শিবসা দিয়ে সুন্দরবন খুব একটা ভালো চিনি না। এদিকের নদী পথগুলো বেলায়েত সর্দারও খুব ভালো চিনেন না। তাই ভরসা নিজের উপরই করতে হলো। গলুইয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম। টর্চ হাতে পথ দেখালাম। তবে ঝামেলা বাধলো ঢাকি নদীর শেষ মাথায় গিয়ে।
ঢাকী থেকে শিবসায় উঠতেই চরের সাথে ধাক্কা খেলো ট্রলার। এখানে যে চর আছে তা জানি না। কোনো রকমে ধাক্কা সামলে নিলাম। তারপর দেখি ট্রলারের সামনের দিকটা চরে উঠে গেছে। কোনো ভাবে নামানো যাচ্ছে না। টর্চ এর ইশারা করে অন্য ট্রলারগুলোকে দূরে থাকতে বললাম।
এখন ভাটা হচ্ছে। পানি নামছে। আরও ঘন্টা খানেক ভাটা হবে। তারপর জোয়ার আসবে। তারও অন্তত এক ঘন্টা পর ট্রলার ভাসবে। এখানে দুই ঘন্টা আটকা থাকলে সবকিছু ভেস্তে যাবে। কী করা যায়? বলতে বলতে মামুন নেমে পড়লো চরে। সর্দারকে সুকানিতে রেখে আমিও লাফ দিলাম। আমাকে নামতে দেখে ট্রলারের অন্যরাও নেমে পড়লো নদীতে। তীব্র শীতের কথা ভুলেই গেছিলাম। সবাই মিলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ট্রলার নামালাম। চর থেকে ছুটে ব্যাক গিয়ার দিয়ে টান দিলেন সর্দার। শিবসার মাঝখানে গিয়ে দক্ষিণে ঘুরলো ট্রলার। ছুটলাম সুন্দরবনের উদ্দেশ্যে।
আমাদের বাম পাশে অর্থাৎ পূর্ব দিকে নলিয়ান। এখানে বন বিভাগের খুলনা রেঞ্জ অফিস। পশ্চিমে গড়ুইখালী, শান্তা। আমরা সোজা নেমে যাচ্ছি। এখনও কিছুটা ভাটা আছে। সেই স্রোতের সাথে যতোটুকু আগানো যায় সেই চেষ্টা করছি। জোয়ার শুরু হলে আবার আমাদের উল্টো স্রোত ঠেলতে হবে।
বাম পাশে আরেকটি ফরেস্ট স্টেশন- কালাবগী। আমাদের সিগন্যাল দিলো ওদিক থেকে। কিন্তু এখন আর দাঁড়ানোর সময় নাই। রাত বাজে পআড়াইটা। ভারী কুয়াশা ঠেলে ছুটছি আমরা। অমাবশ্যার অন্ধকার, সাথে ঘন কুয়াশা! জটিল করে ফেললো আমাদের চলার পথ। আলো ফোটার আগে আমাদের পৌঁছাতে হবে বনদস্যু নোয়া বাহিনীর কাছে। এ এক বিরাট চ্যালেঞ্জ!
(৬ জানুয়ারি ২০১৭, সুন্দরবন)