রূপান্তরের গল্প ৩৫৩ | Rupantorer Golpo 353

লাফ দিয়ে উঠলো দস্যুনেতা “নোয়া মিয়া” | রূপান্তরের গল্প ৩৫৩

লাফ দিয়ে উঠলো দস্যুনেতা “নোয়া মিয়া” | রূপান্তরের গল্প ৩৫৩ | Rupantorer Golpo 353 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ৩৫৩ : ঘুঁটঘুটে অন্ধকার। তবে পূব আকাশে সূর্যের আলোর আভা ছড়িয়েছে। এখন সুন্দরবনটাকে জীবন্ত মনে হচ্ছে। ভরা জোয়ার। শিবসার পানি বেড়েছে অনেকটা। তাই ট্রলার নিয়ে বাকীটা পথ ভালোই চলেছি। এই নদীর জায়গায় জায়গায় চর জেগেছে। তাই ভাটায় ট্রলার ঠেকে যায়। নদী উত্তাল হলে তখন ট্রলার বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়ে। তলায় বালির চর ঠেকলে এক ধাক্কায় সব ভেঙ্গেচুড়ে যেতে পারে।

আমরা খুব সতর্ক। সাথে দুটি RAB এর ট্রলার। একটির ইঞ্জিন আবার নষ্ট। এই নৌকা বহর নিয়ে শিবসা দিয়ে চলাফেরা করা বড়ই কষ্টের। সময় ধরে চলা যায় না, সময় মতো পৌঁছানো যায় না গন্তব্যে। নোয়া বাহিনীর কাছে আমাদের আসার কথা রাত দেড়টা থেকে দুইটার মধ্যে। প্রথম জোয়ারে ওখানে পৌঁছানোর কথা। কিন্তু নানা কারণে দেরি হয়ে গেলো। সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় আসতে না পারলে বনদস্যুদের দেখা পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এতোক্ষণ সেই দুশ্চিন্তায় ছিলাম।

সূর্যের আলোয় ঘুঁটঘুঁটে অন্ধকার কাটছে। এর মধ্যে বনদস্যুদের আলোর ইশারায় গত দুই দিনের দুশ্চিন্তা উড়ে গেছে। কয়েক দফায় সুন্দরবনের দস্যুদের আত্মসমর্পণের পর একটু ভাটা লেগেছিলো। নোয়া বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে সেটি কাটবে। দস্যুমুক্ত সুন্দরবনের জন্য প্রতিটি দলকে সারেন্ডার করাতে হবে। সেই সাথে তাদের প্রতিটি অস্ত্র আর গুলিও জমা দেওয়াতে হবে। কাজের মাঝপথে এসে বেশ ধাক্কা খাচ্ছি। বনদস্যুদের পৃষ্ঠপোষকদের তৎপরতা বেড়েছে। তারা নানা ভাবে ছড়াচ্ছে, দস্যু বাহিনীগুলোর আত্মসমর্পণ কোনো কাজে আসছে না। একই সাথে আত্মসমর্পণে আগ্রহীদেরও নিরুৎসাহিত করছে তারা।

বড় নিশানখালী খালের পরেই ছোট নিশানখালী। অন্ধকারে ওই খাল নজরে আসবে না। ছোট খালটির মুখ আরও ছোট। গাছ পড়ে প্রায় বন্ধ সেই মুখ। আমাদের সম্ভবত ওই খালেই ঢুকতে হবে।

টর্চের ইশারা এসেছে বনের ভেতর থেকে। কাছাকাছি আসলাম। কিন্তু ওদের কাউকে আর দেখছি না। ভেতরে ঢুকে গেছে। কয়েক মিনিট অপেক্ষা করলাম। বার বার টর্চ জ্বাললাম। তারপর চিৎকার করে ডাকলাম। গলুইয়ে দাঁড়িয়ে ওদের পাল্টা ইশারার জন্য অপেক্ষা করছি। কিন্তু আর কোনো সাড়া আসছে না।

ডাক দিয়ে আবার হারিয়ে গেলো কেন ওরা? সর্দার বললেন, মনে হয় ভেতরে ঢুকে অন্যদের খবর দিয়ে ফিরবে আবার। কিন্তু মিনিট দশ অপেক্ষা করেও কোনো ফলাফল পাচ্ছি না। কতো রকম চিন্তা মাথায় ঘুরছে! হঠাৎ করে মনে পড়লো আমাদের সাথে আরও দুইটি ট্রলার আছে। সেগুলো RAB এর। তাদের দেখে ওরা ভয় পেতে পারে। সাথে সাথে ওদের ইশারা করলাম। কিন্তু ওরা আমাদের কাছে আসবে কী করে? ট্রলার নিয়ে কাছাকাছি গেলাম। টিম লিডার এএসপি জসীম ভাইকে বললাম, আপনারা ট্রলার নিয়ে নদীর মাঝামাঝি জায়গায় চলে যান। আপনাদের দেখে ভয়ে পেয়েছে ওরা। বললাম, কতোক্ষণ সময় লাগবে জানি না। আপনারা দূরে যাবেন। কিন্তু নজরের মধ্যে থাকবেন। বের হয়ে আপনাদের খুঁজে নিবো।

ট্রলার ঘুরিয়ে তারা চলে গেলো নদীর উল্টো পাশে। এদিকে দ্রুত সকাল হচ্ছে। আলো বাড়ছে পূর্ব আকাশে। দ্রুত এই বড় নদী ছাড়তে হবে। টেনশন বাড়ছে। কিন্তু বনদস্যুদের আর কোনো খোঁজ পাচ্ছি না। অবশ্য অস্থির এই সময়ে স্থির থাকাটাই আমার প্রধান কাজ। ভেতরে তোলপাড় চলছে কিন্তু কাউকে তা বুঝতে দিচ্ছি না। বার বার মনে হচ্ছে শেষ মুহুর্তে নোয়া মিয়া কি সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেললো? সত্যি বলতে এই দস্যুনেতাকে কখনও পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারিনি।

সর্দারবে বললাম, ইঞ্জিন নিউট্রালে রাখেন। আপাতত নোঙ্গর করবেন না। সর্দার বললেন, ও মামুন, জঙ্গলের দিকে আরেকটু আগায়ে টবারে দাও। তারপর রান্নাঘরে গিয়ে চা বানাতে বসলেন। বিস্কিটের প্যাকেট বের করতে ছইয়ের ভেতর গেছি। দেখি সহযাত্রীরা সব বেঘোরে ঘুমাচ্ছে।

চা নিয়ে গলুইয়ে আসলেন সর্দার। দুই কাপ চা। আমারটা কড়া লিকারের দুধ চা। আর নিজের জন্য বানিয়েছেন কড়া র’ চা। টোস্ট বিস্কিটের সাথে গরম চা! শীতের এই ভোর বেলায় এতো সুন্দর নাস্তা হয় না! কয়েকটা বিস্কিট খেয়ে ফেললাম। আজ সকালের নাস্তা কখন হবে জানি না।

সূর্য উঁকি দিচ্ছে। ভাটার স্রোত বইছে। পানি নামছে উত্তর থেকে দক্ষিণে। খালগুলোর পানিও নামতে শুরু করেছে। জঙ্গলে উঠে পড়া পানিও নামছে সমান তালে। আগামী কয়েক ঘন্টা পানি নামতেই থাকবে। আমি ভাবছি ছোট খালটির মুখে গিয়ে দাঁড়াবো। কিন্তু ওদিকে পানি কতোটুকু বুঝতে পারছি না। ভাটার সময় ট্রলার নিয়ে কোনো চরে আটকানো যাবে না।

নিরাশ হয়ে যাচ্ছি। প্রায় চল্লিশ মিনিট হলো! সর্দার বললেন, একটু পিঠ লাগান তো ভাই। ওরা আসবেনে। মনে হয় ভয় পাইছে। RAB এর ট্রলার তো ওই পাড়ে চলে গেছে। দেখবেন এখন সাহস করে আসবেনে। বলতে বলতে দেখি একজন উঁকি দিচ্ছে। ওদিকটায় ঘন সুন্দরীর বন। গাছের আড়াল থেকে একজন এগিয়ে আসলো।

উঠে দাঁড়ালাম। হাত তুলে পাল্টা ইশারা করলাম। ওরা আমাকে দেখলো। আমিও পরিস্কার দেখলাম। সামনের বনদস্যুর নাম কিবরিয়া। মংলার এই দস্যুর সাথে প্রথম দেখা রাজু বাহিনীতে। ঝকঝকে ফর্সা, শক্তপোক্ত শরীর! হাতের ইশারায় আমাদের এগিয়ে যেতে বললো! ট্রলারের ইঞ্জিন চালু করা ছিলো। সর্দারকে বললাম, আপনি সুকানিতে যান।

ছোট নিশানখালী খালের মুখ পর্যন্ত গেলাম। এর পর আর রাস্তা নাই। গাছ পড়ে মুখটা বন্ধ। বনদস্যুরা পানিতে নামলো। সাথে কয়েকজন জেলেও তাদের সহযোগিতা করছে। দুই মিনিটের মধ্যে গাছগুলো সরিয়ে ফেললো। গলুইয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি আমি। একবার খালের ভেতরে ঢুকতে পারলেই টেনশন মুক্ত হই।

দস্যুরা সব কোমড় পানিতে দাঁড়ানো। অস্ত্রগুলো উঁচু করে ধরা যাতে পানি না লাগে। ট্রলার ঢুকছে খালের ভেতর। গলুই থেকে হাত মিলালাম। বনদস্যুরা সবাই আমার পরিচিত। বললাম, এতো দেরি করলেন কেন? কিবরিয়া বললো, সাথে প্রশাসন ছিলো, তাই আগাইনি। বললাম, একটু পর তো ওদের কাছেই যাবেন! বললো, লিডার ভয় পাইছে ভাই। বললাম, খালের মুখে গাছগুলো কি আপনারাই ফেলছেন? হাসি দিয়ে সে বললো, যদি আপনি না হয়ে শুধু প্রশাসন আসতো? বা অন্য কোনো বাহিনী আসতো তাহলে আমাদের পালানোর রাস্তা থাকতো? বললাম, এতো ভয় নিয়ে ডাকাতি করতে আসছেন?

হাত ধরে দস্যুদের টেনে তুললাম। ট্রলারে মংলা থেকে আসা দুইজন লোক আছে। তারা বেরিয়ে আসলো ছইয়ের ভেতর থেকে। দস্যুনেতার আত্মীয় ওরা। একজন দাউদ মামা, আরেকজনের নাম মনির। দুজনের বয়স চল্লিশের কোঠায়।

ওরা হাত মিলালো, বুক মিলালো। কিন্তু মনে হলো না যে অনেক দিন পর দেখা! বরং মনে হচ্ছে নিয়মিত তারা জঙ্গলে আসে। এখন এসব নিয়ে ভাববার সময় নাই। বললাম, নোয়া ভাইরা কোথায়? কিবরিয়া বললো, আরেকটু ভেতরে আছে সবাই।

সরু খাল ধরে এগিয়ে যাচ্ছি। দুই বাঁক ঘুরতেই কয়েকটি নৌকা দেখলাম। একসাথে বাঁধা। বাকী দস্যুরা সব ওখানে দাঁড়ানো।

ট্রলার থামলো নৌকাগুলোর পাশে। দেখি কাদা-মাটি মাখানো শরীর সবার। দুই দিন আগের তাড়ার আতঙ্ক সবার চোখে মুখে। ট্রলার থেকে নেমে পড়লাম। নৌকায় নেমেই নোয়া মিয়ার সাথে হাত-বুক মিলালাম। বললাম, বেঁচে আছেন এখনও? দস্যুনেতা বললো, আল্লাহ বাঁচাইছে ভাই। ডাকাতি করার শখ আমাদের মিটে গেছে!

ট্রলারের সবাইকে ডেকে তুললাম। ভিডিওগ্রাফার বায়েজিদ ইসলাম পলিনকে বললাম, ক্যামেরা বের করেন। কাজ শুরু করতে হবে। মামুনকে বললাম, ভাত রান্না করো। সর্দার বললেন, কতোজনের রান্না করবো ভাই? বলতে বলতে এগিয়ে আসলেন। বললাম, আমাদের লোকজন আর সাথে তাদের এই কয়জন। যোগ করে রান্না করে ফেলেন। সর্দার বললেন, লোকজন তো আরও আছে। আঙ্গুল তুলে দেখালেন। তাকিয়ে দেখি জঙ্গলের ভেতর আরও কিছু মানুষ! না হলেও ১২-১৪ জন।

ওরা কারা? নোয়া মিয়া বললেন, ওরা সব জেলে। সবাই ধরা জেলে। ধরা জেলে মানে অপহরণ করা জেলে? ডাকাত সর্দার বললো, জ্বি ভাই। তবে এদের কারও কাছ থেকে টাকা নেইনি। বললাম, টাকা না নিয়েই ছেড়ে দিলেন? দস্যুনেতা বললো, আর মুক্তিপণ নেওয়া লাগবে না ভাই। আমাদের নিয়ে চলেন।

আমাদের সাথে আসা দুইজন ট্রলার থেকে নেমে দস্যুদের সাথে গল্পে বসেছে। দেখি মনিরের হাতে বন্দুক, কোমড়ে গুলির পোসেস। অবাক আমি! কী বিষয়? মনির বললো, আমি এই দলের সদস্য। মাঝে পেটে একটা অপারেশন ছিলো। তাই উঠে গেছিলাম।

অপারেশন হইছে? মনির বললো, এক মাস হয়ে গেছে। ডাক্তার বলছে আরও এক মাস রেস্ট নিতে। আমি ঢাকায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে ছিলাম। কিন্তু যখন শুনলাম দল আত্মসমর্পণ করবে তখন আর বসে থাকতে পারিনি। চলে আসলাম। বললাম, আপনি যে ডাকাত সেকথা বলবেন না? পথে কোনো বিপদ হলে কী হতো? কোনো বাহিনী আপনার পিছু নিলে তখন বাঁচাতাম কী করে? বললো, আপনি আছেন না ভাই?

রীতিমতো বোকা হয়ে গেলাম। একজন চিহ্নিত মোস্ট ওয়ান্টেড বনদস্যুকে নিয়ে ঘুরছি আমি? যদি RAB এর অন্য কোনো দল তাকে অনুসরণ করতো বা ধরতো তাহলে কী হতো? পুরো কাজটাই ভেস্তে যেতো না? মনির হাসে। বললো, যে কয়দিন বেঁচে থাকি জানি না। কিন্তু পালায়ে থাকা জীবন আর বইতে পারি না। বলতে বলতে বনদস্যু দলের সাথে মিশে গেলো সে।

বনদস্যু, আমরা আর জেলেরা মিলিয়ে মানুষ ত্রিশ জনের কম না। মানুষ বেশি। তাতে কী? রান্নায় নেমে পড়লেন সর্দার। সেই সমবায় পদ্ধতিতে হবে রান্না। মানে আরও দুই নৌকায় চুলা জ্বালানো হলো। ভাত উঠলো সেখানে। আর ডাল রান্না হবে ট্রলারের রান্নাঘরে। সাথে থাকবে আলু ভর্তা আর ডিম ভাজা। নোয়া মিয়া বললো, আমার কাছে এসে আপনারা রান্না করবেন ভাই? বললাম, আপনাদের সবকিছু তো জাহাঙ্গীরে নিয়ে গেছে! নোয়া মিয়া বললো, ট্রলার নিছে দুঃখ নাই। কিন্তু ওখানে আমার এই থ্রি ওয়ান জিরো বন্দুকের গুলিগুলো ছিলো। এখন গুলি না থাকলে খালি বন্দুক দিয়ে কী করবো? গত দিন কিছু খাওয়া হয়নি। রাতে এই জেলেদের সাথে দেখা হলো। ওদের সাথে দুইটা ভাত খেলাম। বললাম, আজকে আমাদের সাথে খান। তারপর রওনা দিবো। পরের খাবার একবারে জেলখানায় গিয়ে খাবেন। দস্যুনেতা বললো, সারেন্ডার কি আজকেই হবে? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসবে? বললাম, সবকিছু ঠিকঠাক। এখন শুধু আমাদের উঠতে হবে। দ্রুত সব গুছিয়ে নেন!

লাফ দিয়ে ট্রলারে উঠলো দস্যুনেতা। বললাম, এতো তাড়াহুড়ার দরকার নাই। যখন সারেন্ডার করতে বলছিলাম তখন কথা শুনলে এই বিপদে পড়তেন না!

(ছবিতে নোয়া মিয়া, ছোট নিশানখালী)
(জানুয়ারি ৭, ২০১৭)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top