দস্যুরা উঠে আসলো ট্রলারে | রূপান্তরের গল্প ৩৫৬ | Rupantorer Golpo 356 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ৩৫৬ : অস্ত্রগুলো একসাথে বাঁধা হলো। গুলি গণনার সময় নাই, প্রয়োজনও নাই। বনদস্যুদের অস্ত্র-গুলিগুলো একসাথে করে একটি কাঁথার উপর রাখতে বললাম। আরেকটি কাঁধা দিয়ে সেগুলো ঢেকে দিলাম। রওনা দেওয়ার সিদ্ধান্ত দিয়ে রেখেছি। সেই অনুযায়ী আমাদের ট্রলার প্রস্তুত। কিন্তু নোয়া বাহিনীর সদস্যরা এখনও প্রস্তুত না।
বনদস্যুরা অভ্যন্তরীণ কিছু বিষয়ে আলাপ করছে। মাইজে ভাই জাহাঙ্গীর নামে তাদের যে সদস্য আছে সে ঘুরেফিরে কিছু বুঝাচ্ছে দস্যুনেতা নোয়া মিয়াকে। মনির, মুক্তো, রাঙ্গা, কিবরিয়াসহ অন্যরা বেশ অসন্তুষ্ট মনে হচ্ছে। দূরে দাঁড়িয়ে ওদের কর্মকান্ড দেখছি। নতুন করে ঝামেলা বাড়াতে চাচ্ছি না। কারণ এখনও ওদের বিশ্বাস করছি না আমি। যদিও অস্ত্র আর গুলিগুলো আমার নিয়ন্ত্রণে এখন। এই মুহুর্তে ওরা সবাই পালিয়ে গেলেও অস্ত্রগুলো আর নিতে পারবে না।
চোখের ইশারায় সর্দারকে সবকিছু বুঝিয়ে দিলাম। মামুন চলে গেলো ইঞ্জিন ঘরে। বলা মাত্র সে হ্যান্ডেল ঘুরাবে। এখান থেকে মাত্র দুইশ মিটার গেলেই বড় নদী- শিবসা। এখন জোয়ার হচ্ছে। বের হতে সমস্যা হবে না।
জোয়ার প্রায় অর্ধেক হয়ে গাছে। বাকী জোয়ার আমাদের কাজে লাগাতে হবে। মানে এখনই যদি রওনা দেই তবে আগামী তিন ঘণ্টার মধ্যে মংলা পৌঁছাতে পারবো আমরা। এখানে আসার সময় আমরা ঘুরা পথে এসেছি। তবে যাওয়ার সময় নতুন পথে যাবো। বড় নিশানখালী দিয়ে চাইলেবগী হয়ে পশুর নদীতে বের হবো। তারপর বাকী জোয়ারের সাথে সাথে মংলা। এখন যদি ওরা দেরি করে তবে সময় মতো আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠানে পৌঁছানো সম্ভব হবে না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসবেন দুপুর বেলা, অনুষ্ঠান হবে পটুয়াখালীর কুয়াকাটায়। লম্বা পথ!
আর অপেক্ষা করা যায় না। কিন্তু সে কথা বলতেও পারছি না। যতোটুকু বুঝছি লুকানো অস্ত্রগুলো নিয়ে আসায় ঝামেলা বেধেছে। ওই যে মাইজে ভাই, তাকে সব সময়ই সন্দেহ হয়। মনে পড়ে, প্রথম রাজু বাহিনীর কাছে আসার সময় সেই আমাকে নিয়ে এসেছিলো। খুলনায় ট্রলারে উঠার পর রূপসা থেকে উঠলো সে। বনের ভেতর আসার সাথে সাথে হাতে অস্ত্র তুলে নিলো। ভাবতেই পারিনি যে চিহ্নিত এক বনদস্যু শহর থেকে আমার সঙ্গী হলো। পরবর্তীতে ইলিয়াস বাহিনীতে এসেও তাকে দেখেছি। মাঝে মাঝে ফোন করে কথা বলে। বার বারই বলে যে দস্যুতা ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু বার বারই তাকে দস্যুতা করতে দেখেছি।
মাইজে ভাই জাহাঙ্গীর এখনও কথা বলছে। বাকীদের সাথে বাক বিতন্ডাও হচ্ছে। তবে কথাবার্তা চলছে নিচু স্বরে, যাতে আমি শুনতে না পাই। আমিও কিছুই বুঝতে পারছি না এমন ভান করছি। এই মাইজে ভাইকে নিয়ে দস্যু মহলে অনেক গল্প আছে। সাবেক দস্যুনেতা রাজু’র ঘনিষ্ট সে। এখনও সম্ভবত সেই কুখ্যাত দস্যুনেতার প্রতিনিধি হয়ে কাজ করছে।
এই অস্ত্র ভান্ডারের কিছু অস্ত্রে রাজু ওরফে ছোট সাহেবের মালিকানা এখনও আছে হয়তো। দস্যুদলের নেতৃত্ব বদল, অস্ত্র কেনাবেচায় তার প্রভাব আছে এখনও। তবে নোয়া মিয়ার এই দল ছাড়া আর কোনো দলে তার কোনো যোগাযোগ নাই। কিছুদিন আগে তার সাথে ফোনে কথা হলো। বলেছিলো, তার লোকজনদের যেন বিপদে না ফেলি। আমি বলি, অজ্ঞাত জায়গা থেকে আর ঝামেলা করবেন না। সুন্দরবনে আমাকে কাজ করতে বাধা দিবেন না। এরপর সে আমাকে আর ফোন দেয়নি। তবে এই দস্যুদের সাথে তার নিয়মিত যোগাযোগ আছে।
এখানে মোট পাঁচটি ডিঙ্গি নৌকা আছে। সবগুলো একটার সাথে আরেকটা বাঁধা। দস্যুরা সব নৌকায় দাঁড়ানো। আমি একটু এগিয়ে গেলাম। বললাম, আপনারা কি সারেন্ডার করবেন? নোয়া মিয়া উত্তর দিলো, না করলে কি আপনাকে আনতাম? কিন্তু ঝামেলা কমছে না। এই যে কয়জন আছে, এরা সারেন্ডার করবে না। মানে নৌকায় জেলে সেজে থাকাদের কয়েক জন বনদস্যু। তারা আত্মসমর্পণ করবে না। তাদের জন্যই অস্ত্রগুলো রাখা ছিলো।
আমি নিশ্চিত মাইজে ভাই জাহাঙ্গীর এসবের কলকাঠি নাড়ছে। তাই তাকেই এবার ধমক দিলাম। বললাম, সবাইকে আত্মসমর্পণ করালেও আপনাকে সেই সুযোগ দিবো না ভাই। আপনার মন পরিস্কার না। সারেন্ডার করে আপনি আবার দস্যুতায় ফিরবেন মনে হচ্ছে। আপনার বিষয়ে আমি রিপোর্ট করবো। কী করে আপনি ডাকাতি চালায়ে যান দেখবো সেটা।
ধমকে কাজ হলো। তড়িঘড়ি করে এগিয়ে আসলো সে। হাত ধরে বললো, ও ভাই, আমি যে কোন বিপদের মধ্যে আছি! বললাম, আপনার বিপদ দেখার আর সময় নাই আমার হাতে। পাঁচ মিনিট সময় দিলাম। সবাইকে নিয়ে ট্রলারে উঠেন। বলেই সর্দারকে ডাক দিলাম। বললাম, ট্রলারের ইঞ্জিন চালু করেন।
ইয়ামীন ভাই, পলিনসহ অন্যরা ট্রলারের মাঝখানে বসা। রাঙ্গা ডাকাত এসে দাঁড়ালো আমার পাশে। গুলি খাওয়া হাতটা দেখিয়ে বললো, আমি তো এখন বন্দুকও চালাতে পারি না। ডাকাতি করতে গিয়ে হাত হারালাম। বাড়ি ফিরলেও কী করে খাবো জানি না। তারপরও সারেন্ডার করবো। আমাকে নিয়ে যান ভাই।
এই রাঙ্গার বিষয়ে অদ্ভুত কিছু গল্প শুনেছি। তার স্ত্রী বেশ স্মার্ট। থাকে খুলনায়। ওঠাবসা করে ডাকসাইটে লোকজনদের সাথে। শুনেছি খুলনা মাছ আড়তের পাশে একটি ঘরে বসে জুয়ার আসর, যেখানে লাখ টাকার জুয়া খেলা হয়। প্রতি রাতে সেই জুয়ার আড্ডায় বসে সেই নারী। সুন্দরবনের দস্যু জগতের গডফাদারদের সাথে তার নিয়মিত যোগাযোগ। সম্ভবত বেশ টাকা পয়সাও আছে।
রাঙ্গাকে বললাম, আপনি ছেঁড়া কাপড় পড়ে জঙ্গল দাপায়ে বেড়াচ্ছেন। হাতটাও নষ্ট হলো। ওদিকে দস্যুতার লাখ লাখ টাকা উড়াচ্ছে আপনাদের কাছের লোকজন। কথাটি শুনে মাথা নিচু করে ফেললো সে। বললো, ওই টাকার আর দরকার নাই ভাই। দরকার হলে ভিক্ষা করে খাবো, আমাদের নিয়ে যান। বললাম, প্রধানমন্ত্রী আপনাদের এক লাখ টাকা দিবেন। RAB আপনাদের সব ধরনের সহযোগিতা করবে।
এবার উঠে একটা হাঁক দিলো রাঙ্গা। সাথে সাথে দস্যুনেতা নোয়া মিয়াসহ বাকী দস্যুরা উঠে আসলো ট্রলারে। এদের মধ্যে ১২ জনই আত্মসমর্পণ করবে। বাকীদের এখানেই রেখে যাবো। ওদের মধ্যে কয়েকজন দস্যু আছে, বাকীরা সাধারণ জেলে। রওনা দেওয়ার আগে কৌশলে সবার ছবি তুললে নিলাম। কারণ রেখে যাওয়া এই বনদস্যুরা আবারও দস্যুতায় নামবে। যাওয়ার পথে তাদের নাম ঠিকানা নিবো। ছবির সাথে মিলিয়ে রাখবো।
ইঞ্জিন চালানো ছিলো আগে থেকে। সর্দারকে বললাম, আর এক মিনিটও দাঁড়াবো না। সুকানিতে দাঁড়ানো আমাদের ক্যাপ্টেন। বলা মাত্র গিয়ার ফেললেন। তারপর এক টান। ছোট নিশানখালী খাল থেকে বের হলাম। শিবসায় উঠে দেখি নদী বেশ উত্তাল। ডানে-বামে কোনো ট্রলার নাই। RAB এর ট্রলার দুটি গেলো কোথায়? সর্দার বললেন, ওদের খুঁজবো কখন, ডাঙ্গায় ফিরবেন কখন? বললাম, সোজা চালান। শিবসার মাঝখানে যান। এখন জোয়ার হচ্ছে। তারা উত্তরের দিকে থাকবে। তবে নদীর পূর্ব না পশ্চিমে থাকবে নিশ্চিত না।
ট্রলার চলছে উত্তরে। নদীর মাঝখান দিয়ে যাচ্ছি যেন ওরা আমাদের দেখতে পায়। সাথে সুন্দরবনের দুর্ধর্ষ বনদস্যু দল- নোয়া বাহিনী। অস্ত্রসহ বিলুপ্ত হতে যাচ্ছে আরেকটি দস্যুদল। সবকিছু ঠিকঠাক করা। দুপুরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসবেন। তার আগেই আমাদের পৌঁছাতে হবে সেই কুয়াকাটায়। এই মুহুর্তে RAB এর প্রতিনিধিদের সাথে দেখা হওয়াটা সবচেয়ে বেশি জরুরি। অন্য কোনো দস্যুদলের মুখোমুখি হলে বিপদের শেষ থাকবে না। বন বিভাগ বা কোস্টগার্ডের সামনে পড়লেও বিপদ। কারণ অবৈধ অস্ত্র-গুলি আর দস্যুদলের সদস্যদের আমার কাছে রাখার কোনো আইনগত অধিকার নাই। শিবসার মাঝখান দিয়ে শুরু হলো অনিশ্চিত আরেক যাত্রা।
(৭ জানুয়ারি ২০১৭, সুন্দরবন)