রূপান্তরের গল্প ৩৬০ | Rupantorer Golpo 360

দুই টাকার সাংবাদিক গণে না জাহাঙ্গীর! | রূপান্তরের গল্প ৩৬০

দুই টাকার সাংবাদিক গণে না জাহাঙ্গীর! | রূপান্তরের গল্প ৩৬০ | Rupantorer Golpo 360 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ৩৬০ : আপনার বোন আমার কথা শুনতেছে না ভাই! সে বেঈমানী করার চেষ্টা করছে। ২০১৩ সালের এক দুপুরে বনদস্যু জাহাঙ্গীর এই কথাগুলো বলছিলো। সে তখন ইলিয়াস বাহিনীর সদস্য। সেবার সুন্দরবনে তাদের সাথে দেখা করতে গেলাম। আত্মসমর্পণ নিয়ে আলোচনা করছিলাম। এমন সময় নাটা জাহাঙ্গীর বলছিলো কথাগুলো।

বনদস্যু হিসাবে জাহাঙ্গীরের তখনও নাম ডাক হয়নি। জেলের মুখে অত্যাচারী ডাকাত হিসাবে তার নাম শুনতাম। জাহাঙ্গীর এমনিতে ছোট খাটো, তার উপর কথাবার্তাও একটু অপরিপক্ক। তিনদিন ছিলাম সেখানে। জাহাঙ্গীর ঘুরেফিরে শুধু বলছিলো, একটা মেয়ের সাথে তার প্রেম চলছে। কিন্তু সে বিয়ে করতে চাইছে না। বলেছিলাম, আপনার যে জীবন! কখন মরবেন তার নাই ঠিক। একজন জেনেশুনে বিয়ে করবে কেন? জাহাঙ্গীর বলে, বিয়ে না করলে আমি শেষ হয়ে যাবো ভাই। ওর কাছে আমার টাকা-পয়সা সব রাখা। সে দফায় আমি কথা বাড়াইনি।

ফিরে আসার পর ফোনে যোগাযোগ ছিলো। একদিন আমাকে ফোন করে টেলিকনফারেন্সে তার প্রেমিকার সাথে কথা বলিয়ে দিলো। তার নাম ময়না। কোথায় থাকে জানি না। ফোনে সে বললো, জাহাঙ্গীরকে বললাম, নিজে একটা দল করতে। আরেক জনের দলে মজুরি খেটে লাভ আছে? কিন্তু সে কথা শুনে না। আমি আকাশ থেকে পড়লাম! বুঝলাম, টাকার নেশায় ধরেছে ময়নাকে। তখন বড় ভাই সুলভ কথাবার্তা বলে কোনো রকমে কথা শেষ করলাম।

এরপর অনেক সময় পেরিয়েছে। অনেক ঘটনা ঘটেছে। সুন্দরবনের দস্যু জগৎ উল্টে পাল্টে গেছে। ইলিয়াস বাহিনী ভেঙ্গে যাওয়ার পর জাহাঙ্গীর নিজের নামে দস্যুদল করলো। তারপর বিয়ে করলো ময়নাকে। বিয়ের খবর পেয়েছিলাম। সেই খবর দিলো জাহাঙ্গীরের মেয়ের জামাই হান্নান। আমি পুরো বোকা হয়ে গেছিলাম। জাহাঙ্গীর বিবাহিত, তার মেয়েরও বিয়ে হয়েছে, সেই খবর জানলাম সেদিন। মেয়ের জামাই হান্নান বলে, সে তার শ্বশুরের দলের সদস্য। মানে সেও বনদস্যু!

ছোট স্ত্রীর চাপে জাহাঙ্গীর নিজেই দস্যুনেতা হলো। কাছের কিছু লোকজন নিয়ে গড়ে তুললো ছোট একটি বাহিনী। তবে বড় বড় দস্যুদলের চাপে তখন তার কাহিল অবস্থা! মাথা মোটা হিসাবে পরিচিত এই দস্যুনেতা নানা ভাবে বেকায়দায় পড়ে। বার বার তারা আক্রান্ত হয়।

এরপর আত্মসমর্পণ শুরু হলো। একটার পর একটা বড় দস্যুদল উঠে আসলো। মাঠ ফাঁকা হলো। এরপর শক্তিশালী দস্যুদল হিসাবে তার আবির্ভাব। সুন্দরবনে আতঙ্ক ছড়ালো। চাঁদা বাড়তে শুরু করলো। সেই সাথে বাড়লো অস্ত্র আর জনবল। শুনেছি ছোট স্ত্রী ময়নার সাথে আন্ডারগ্রাউন্ডের লোকজনদের খাতির ছিলো। সেই সূত্রে অবৈধ অস্ত্রের বাজার চলে আসে হাতের মুঠোয়। মাত্র কয়েক মাসে জাহাঙ্গীর হয়ে উঠে মুর্তিমান আতঙ্ক!

সবশেষ নোয়া বাহিনী আত্মসমর্পণ করলো। তার পর পর বাড়তে থাকলো জাহাঙ্গীর বাহিনীর হাঁক-ডাক। আমার সাথে পুরনো পরিচয়। কিন্তু কিছু ইস্যুতে তার সাথে আমার সম্পর্কে ভাটা পড়েছে। মংলার এক সোর্স এই দূরত্বের কারণ। আমার নাম ভাঙ্গিয়ে সে জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে টাকা নিতো। আমার ঘনিষ্ঠ মংলার এক সাংবাদিকও টাকা নিতো তার কাছ থেকে।

ওরা আমার নামে টাকা তুলতো বলে জাহাঙ্গীর আমাকে সম্মান করতো না। এটা খুব স্বাভাবিক। বিষয়টি আমি জানতে জানতে দেরি হয়ে যায়। এরপর খোলাসা করতে গেলে বিষয়টি আরও জটিল হয়ে পড়ে। মাঝখানে ঢুকে পড়ে অন্য পক্ষ। বিশেষ করে গত কয়েক মাসে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর একটি পক্ষের সাথে তার যোগাযোগ নিবিড় হয়। সে এই সম্পর্ককে ব্যবহার করে সুন্দরবনে অপ্রতিরোধ্য দস্যুনেতায় পরিণত হতে চায়। উচ্চাভিলাস আর লোভে অন্ধ হয়ে একের পর এক ভুল করতে থাকে সে।

এখন চারপাশ থেকে টাকা আসছে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় নামে বেনামে জমি কিনছে। দস্যুতার অথ-সম্পদ জমা হচ্ছে তার ছোট স্ত্রী ময়নার কাছে। এই পক্ষের শ্বশুর বাড়ির আত্মীয় স্বজনদের আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়েছে সবাই। এদিকে দলের মধ্যেও বিরোধ লেগেছে। মনে হচ্ছে শিগগিরই বড় ধরনের পতন হবে জাহাঙ্গীরের।

পনেরোটা বন্দুক আর হাজার খানেক গুলি নিয়ে সদস্যরা পালিয়ে গেছে। এক দিনে তিন দফায় দল ছেড়ে পালিয়েছে জাহাঙ্গীর বাহিনীর দস্যুরা। ফারুক, সাত্তার আর ছোট রাজুর নেতৃত্বে ঘটনাগুলো ঘটেছে। সারেন্ডার করা না করা নিয়ে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ বেড়েছে। এখন যারা আছে তাদের মধ্যেও তৈরি হয়েছে অবিশ্বাস।

বনদস্যুদের এতো খবর রাখতে চাচ্ছি না। কিন্তু খবর আমার পিছু ছাড়ছে না। এর মধ্যে ছোট রাজুর ফোন করলো। বললো, ছয়জন মিলে তারা পূর্ব সুন্দরবনে চলে গেছে। দুটি ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে তারা অবস্থান করছে পশুর আর সেলা নদীর মাঝখানের জঙ্গলে। জানতে চাইলাম, দল ছাড়লেন কেন? ছোট রাজু বললো, জাহাঙ্গীরের মতলব খারাপ। সে ডাকাতির টাকা গুছিয়ে ইন্ডিয়ায় পালাবে। কিছুতেই সারেন্ডার করবে না, আমাদেরকেও করতে দিবে না। তার কাছে শুনলাম, ফারুক কিছু লোকজন নিয়ে আগের রাতে পালিয়েছে। সেও আলাদা বাহিনী করবে। সাত্তার নামে পালিয়ে যাওয়া আরেক বনদস্যুর কোনো খোঁজ পাইনি এখনও।

ওদিকে জাহাঙ্গীর নাকী পুরাই পাগল হয়ে গেছে। বাছের ছাড়া দলের সবার অস্ত্র কেড়ে নিয়েছে। এখন তার দলের সদস্যদের কারও হাতে অস্ত্র নাই, ফোনও নাই। অস্থির এক পরিস্থিতি। বিকালে ফোন দিলো বাছের। তরুণ এই বনদস্যু জাহাঙ্গীরের ভাগ্নে। সে নিজেও আত্মসমর্পণ করতে চায়। কিন্তু পরিস্থিতি বৈরী।

বিকালে ফোন দিলো বাছের। বললো, জাহাঙ্গীর মামাকে একটু বুঝান ভাই। সবার অস্ত্র কেড়ে নিছে। এই খবর যদি ফারুক বা ছোট রাজু পায় তাহলে অ্যাটাক করে বসবে। আর মনে হয় বাঁচতে পারলাম না মামা। বললাম, তোমার মামা মনে হয় বাঁচতে পারবে না। বিপদ একটা হবেই হবে।

বরিশাল থেকে মেজর আদনান ফোন দিচ্ছেন মাঝে মাঝে। বনদস্যুদের খোঁজ খবর নিচ্ছেন-দিচ্ছেন। রাতে বরিশাল RAB এর অধিনায়ক লে. কর্নেল আনোয়ার ফোন দিলেন। বললেন, সুন্দরবন নিয়ে আরও কাজ করতে চায় তারা। তাকেও বললাম, আর কাজ করবো না। ক্যাডেট কলেজের বন্ধু হিসাবে খোলামেলা কথা হলো। আনোয়ার বললো, মাঝ পর্যায়ে কাজ বন্ধ করলে সুন্দরবনের পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে যাবে। পুরো কষ্ট মাঠে মারা যাবে।

নানা দিক থেকে আমাকে কাজে নামতে বলা হচ্ছে। অথচ আমি জানি খুলনা থেকে জাহাঙ্গীরকে বলা হয়েছে, আমার সাথে যোগাযোগ না রাখতে। সেও বলেছে, সরাসরি আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করবে। কিন্তু কবে করবে সেই কথা বলছে না। ওদিকে পশ্চিম সুন্দরবনের আলিফ বাহিনীকেও বলা হয়েছে একই কথা। গতকাল ফোন করে সেই কথা জানালো আলিফ।

আলিফের আত্মসমর্পণ করার কথা আরও কয়েক মাস আগে। মজনু বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর পর তার উঠে আসার কথা। কিন্তু কথা রাখেনি আলিফ। সেও সময় পার করছে। মোট বড় দস্যুদলগুলো সব সারেন্ডার করেছে, এখন ময়দান ফাঁকা। সুন্দরবনে তাদের প্রভাব বাড়ছে। মাঝে মাঝে সাগরে এক দুইটা কোপ দিতে পারলেই কোটি টাকার ধান্দা। অনেকে বলে, আলিফ আমাকে ব্যবহার করছে। আত্মসমর্পণ করবে করবে বলে সুযোগ নিচ্ছে।

সবকিছু ক্রমেই জটিল হয়ে আসছে। নানা কারণে উৎসাহ হারাচ্ছি। অন্য ভাবে বললে, আমাকে নিরুৎসাহিত করতে তৎপর কেউ কেউ। যেমন সদর দফতর থেকে জাহাঙ্গীরকে নিয়ে কাজ করার কথা বললেও মাঠ পর্যায় থেকে বলা হচ্ছে উল্টো কথা।

গত কয়েক বছর সুন্দরবন নিয়ে এতোটা ব্যস্ত যে বাসার খোঁজ খবর ঠিকঠাক নেওয়া হয় না। আমার স্ত্রী স্কুল শিক্ষক। নিজে বঞ্চিত হলেও দিনের পর দিন আমাকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে সে। আমি যখন দুর্গম জঙ্গলে বিপদসংকুল সময় কাটাই, তখন টের পাই, কেউ একজন জায়নামাযে বসে দোয়া করছে। বাবা-মাসহ পরিবারের অন্যরাও আমার এই কাজের প্রতি সমর্থন দেন। সেই সুযোগ পেয়ে আমি লেগে আছি একটি জনপদের মানুষদের কিছুটা স্বস্তি দেওয়ার আশায়।

গেলো সফর থেকে ফেরার পর আমি স্বস্তিতে নাই। বিষয়টি আমার স্ত্রী খেয়াল করেছে। রাতে খাবার টেবিলে বসে সে বললো, তোমার কি চাকরি নিয়ে কোনো সমস্যা হচ্ছে? বললাম, চাকরির সমস্যা না। সুন্দরবনে পরের কাজগুলো নিয়ে জটিলতায় আছি। আমি আর দস্যুদের আত্মসমর্পণে মধ্যস্ততা করতে চাই না। সে বললো, একটা কাজ অর্ধেক অবস্থায় বন্ধ করাটা কি ঠিক হবে? বললাম, পরিবেশ পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে বলতে পারছি না। তবে তুমি যখন বললে তখন আবার ভেবে দেখবো।

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙলো বড় সুমন বাহিনীর ফোনে। জানালো জাহাঙ্গীর বাহিনী থেকে পালিয়ে আসা দস্যু সাত্তার তাদের দলে ভিড়েছে। বললাম, সে আসুক, অসুবিধা নাই। আপনারা আত্মসমর্পণ করবেন কবে? দস্যুদলটির প্রধান জামাল শরীফ বললো, আরেকটু গুছিয়ে নিয়ে উঠে আসবো ভাই। বললাম, আপনারা শুধু বাহানা করছেন। ফোন রাখার আগে বললাম, সাত্তারের বিষয়ে সাবধান থাকবেন। বললো, সাত্তার আর আমি আগে একসাথে মাছ ধরতাম ভাই। অসুবিধা হবে না। বললাম, অসুবিধা আপনি দেখেন না, আমি দেখছি। দ্রুত সারেন্ডার করেন। না হলে দেখবেন এই সাত্তারই বড় বিপদে ফেলবে।

ফোন রেখে অফিসে গেলাম। আমাদের প্রধান বার্তা সম্পাদক ফাহিম আহমেদের সঙ্গে বসলাম। বিস্তারিত জানালাম তাঁকে। চাইলাম পরামর্শ। তিনিও বললেন, একটা কাজ মাঝ পথে ছেড়ে দেওয়ার কোনো মানে হয় না। নতুন করে এগিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন তিনি।

ভাবনায় ডুব দিলাম। একদিকে আমার স্বাধীন ও আরামদায়ক চাকরি, অন্যদিকে সেই জটিল, কঠিন, ঝঞ্ঝাময় সুন্দরবন। বেছে নিলাম সুন্দরবনকে। ফোন দিলাম বেলায়েত সর্দারকে। বললাম, আপাতত আপনারা নিয়মিত কাজ কারবার চালিয়ে যান। একটু বিরতি নিয়ে আবার কাজে নামবো। তখন দেখা হবে।

জাহাঙ্গীরের নাম্বারে ফোন দিলাম। ধরলো বাছের। জাহাঙ্গীরকে চাইলাম। পাশেই বসা দস্যুনেতা, কথা বলবে না। উল্টো বাছেরকে একটা গালি দিয়ে বললো, দুই টাকার সাংবাদিকের সাথে কথা বলি না। বলে দাও, বড় বড় স্যাররা এখন জাহাঙ্গীরের কথায় উঠে-বসে।

ছবিতে নিল গেঞ্জি পড়া ব্যক্তি জাহাঙ্গীর…!! (জানুয়ারি ২০১৭)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top