আবার ভয় ফিরলো সুন্দরবনে? | রূপান্তরের গল্প ৩৬৩ | Rupantorer Golpo 363 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ৩৬৩ : তুমি সত্যি সত্যি সারেন্ডার করবে? ফোনে জিজ্ঞেস করলাম দস্যুনেতা আলিফকে। সে বললো, অবশ্যই করবো বাবাজি। বললাম, এই কথা গত ছয় মাস ধরে বলছো। কিন্তু সারেন্ডারের কোনো লক্ষণ নাই। RAB থেকে তোমাকে ফোন দিচ্ছে, ধরছো না। তারপর তোমার মূল ফোনটা বন্ধ করে রাখছো। তুমি আসলে চাচ্ছো কী?
ইনিয়ে বিনিয়ে আলিফ বললো, আরেকটু সময় দিতেই হবে। বললাম, ফোন বন্ধ রাখছো কেন? সে বলে, খুলনার কিছু লোক ফোন করে ডিস্টার্ব করছে। বললাম, তাহলে নতুন নাম্বারটা আমাকে দাওনি কেন? দস্যুনেতা আলিফ বললো, দিবো দিবো করছিলাম। এর মধ্যে দেখি আপনি ফোন দিয়ে বসছেন। এই নাম্বার তো একদম নতুন। দুই দিন হলো চালু করছি। আপনি এটা পেলেন কী করে বাপজান? বললাম, তুমি মনে হয় এখনও চিনতে পারোনি আমাকে! তুমি কী করো, কোথায় থাকো, কী খাও, কাকে ধরো, কাকে মারো, কাকে ছাড়ো সবকিছুই জানি।
দস্যুনেতা আলিফ বেশ চতুর। পশ্চিম সুন্দরবনে বেশ অত্যাচারী ডাকাত হিসাবে তার কুখ্যাতি। জেলেরা অনেকে ডাকে দয়াল নামে। আলিফকে দেখিনি এখনও। তবে জেলেদের মুখে শুনেছি, ভারী গলার সাথে তার অবয়বটাও ভয়ঙ্কর।
তবুও নাম দয়াল কেন? সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে। আলিফকেও বললাম, এই নামে জেলেরা ডাকে কেন? তুমি কি দয়ালু ডাকাত? হাসতে হাসতে সে বললো, কোত্থেকে নামটা আসছে জানি না। তবে জেলেদের প্রতি আমার দয়া আছে। এবার আমি হেসে দিলাম। বললাম, করো ডাকাতি-দস্যুতা। আবার বলো দয়া আছে? আলিফ বলে, আপনার সাথে কথায় পারবো না বাবাজি। বললাম, তুমি আর সময় নিও না। তৈরি হও। সারেন্ডার না করলে কিন্তু বাঁচতে পারবে না।
তোমাকে ধরার জন্য অনেকেই কাজ করছে। তার আগে যদি আসতে পারো তো ভালো হবে, বেঁচে যাবে। আলিফ বললো, তাহলে আমার ঋণের কী হবে? বললাম, আত্মসমর্পণ করার পর তোমার দায়িত্ব সরকারের। RAB তোমাদের দেখভাল করবে। ওই সূদের কারবারী মানে খুলনার সেই স্বর্ণকার তোমার কাছে টাকা চাইতেও পারবে না। তারপরও যদি সমস্যা হয় সেটা আমি দেখবো!
আলিফের সাথে কথা শেষ করে বরিশালে মেজর আদনান কবীরের কাছে ফোন দিলাম। বিস্তারিত জানালাম। তিনি বললেন, ওর ফোন বন্ধ রাখার কারণ কী? এছাড়া আলিফকে নিয়ে আমাদের কাছে গোয়েন্দা তথ্য অন্য রকম। কেমন? জানতে চাইলাম। আদনান বললেন, আগামী বর্ষা পর্যন্ত জঙ্গলে থাকবে সে। ইলিশ মৌসুমে সাগরে দস্যুতা করবে। তারপর টাকা পয়সা নিয়ে ভারতে চলে যাবে। বললাম, আমিও তেমন শুনছি। কিন্তু আমার মনে হয় সে শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করবে। কয়টা দিন সময় দাও। ওর সাথে দেখা করি। সামনা সামনি কথা বললে অনেক কিছু পরিষ্কার হবে।
আলিফ বেশ জানান দিয়ে দস্যুতা করে। নোয়া মিয়ার আত্মসমর্পণের পর পশ্চিম সুন্দরবনে তার একছত্র দাপট। সাগরেও আসা যাওয়া করছে। নিয়মিত ওদিকের তথ্যগুলো পাচ্ছি আমি।
পূর্ব সুন্দরবনে বড় সুমন আর মোশাররফ বাহিনী আছে। শামসু নামের একটি দস্যুদল নতুন করে নেমেছে। পশুর নদীর পূর্ব দিকের খবরগুলোও কম বেশি পাচ্ছি। কিন্তু মধ্য সুন্দরবনের খবর খুব গোলমেলে। অবস্থা বেশ খারাপ।
ওদিকে জাহাঙ্গীর বাহিনীকে ঘিরে তুমুল উত্তেজনা চলছে। ইদানিং নাম না জানা এক দুইটি গ্রুপও মধ্য সুন্দরবনে ঘুরছে অস্ত্র নিয়ে। তাদের মতিগতি খুব সন্দেহজনক। নিশ্চিত জানি যে জাহাঙ্গীর ডাকাতের লোকজন ভাগ হয়ে ঘুরছে ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে। আবার শুনছি নতুন করে আরেকটি দল নেমেছে। ছোট একটি ট্রলার, সশস্ত্র ৫-৭ জন।
গত কয়েক দিন ধরে ব্যস্ত আমি। ঢাকায় বসে দিন রাত কথা বলছি। সোর্সরা সবাই সক্রিয়। সুন্দরবনের লোকজন সকাল সকাল দিন শুরু করে। তাই সাত সকালেও ফোন আসে। সোর্সরা ফোন করে গভীর রাতে। আজ সকালে ফোন আসলো দুবলার চর থেকে।
…. আমার সবকিছু শেষ হয়ে গেলো ভাই! ডাকাতে সবকিছু নিয়ে গেছে আমার! দুবলার চর থেকে ফোন দিয়ে বলছিলেন এক জেলে। ফোন ধরে বসেই থাকলাম। কী বলবো বুঝতে পারছি না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে জিজ্ঞেস করলাম, ভালো করে বলেন তো কী হয়েছে? উনি বললেন, এই গোনে মাছ একটু বেশি পড়লো। বরফ ভর্তি কেবিনগুলো মাছে ভরে গেছে। তাই গোন শেষ হওয়ার আগেই ফেরির ট্রলার ছেড়ে দিলাম।
দিনের জোয়ারে রওনা দিলো ট্রলার। মাঝ পথে ডাকাতে ধরলো। মাছ শুদ্ধো ট্রলার নিয়ে গেলো। বললাম, কারা নিলো জানতে পারছেন? উনি বললেন, কেবল খবর পেলাম। ডাকাতে নিছে এটুকু জানি। বললাম, ওরা ফোন দিবে। অপেক্ষা করেন। আগে জানেন কারা নিলো, কী চায় তারা। তারপর দেখি কী করা যায়!
দুবলার চরে শুঁটকির মৌসুম চলছে। শীতকালের পাঁচ মাস জেলেরা এখানে থাকে। শুঁটকির কারবার ছাড়াও এখানে কাঁচা মাছের ব্যবসা চলে। জেলেরা বলে সাদা মাছের কারবার। মানে চিংড়ি ছাড়া যেসব মাছ আমরা কাঁচা কিনি, সেগুলোকে সাদা মাছ বলে। ভেটকি, লাক্ষা, রূপচাঁদাসহ সামুদ্রিক মাছ, কাউইন, পায়রা, পারশে, ট্যাংড়া, মেদ, মোচন মাছগুলো বরফে করে আড়তে যায়। দুবলা থেকে ট্রলারে করে নেওয়া হয় এসব। তার আগে ভরা হয় বরফের কেবিনে।
ঘটনাটি ভালো করে শুনলাম। বনদস্যুদের ভয়ে রাতে মাছ ভর্তি ট্রলার ছাড়ে না তারা।
সকালের জোয়ারে ছাড়ে সেই মছ ভর্তি ট্রলার। পশুর নদী ধরে এক জোয়ারে মংলা পার হয়ে চালনার কাছাকাছি চলে যায় তারা। পথে চারগাঙ থেকে ভদ্রা পর্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। ডাকাতির ঘটনাগুলো এই অঞ্চলেই ঘটে। তবে এখন দিনের বেলা দস্যুরা বড় নদীতে বের হয় না। এদিকে এখন আর দিনে ডাকাতি হয় না। এবারের দস্যুতাটি তাই ব্যতিক্রম।
পাইকগাছার এই জেলে গত কয়েক বছর ধরে ভালো মাছ পাচ্ছে। সামান্য পূঁজি হয়েছে। তারপর পুরনো মহাজনের দাদন থেকে বের হয়ে নতুন এক মহাজনের দাদন নিয়েছে। শর্ত একটু সহজ বলে মহাজন পরিবর্তন করেছে সে। এর পর থেকে পুরনো মহাজনের লোকজন নানা ভাবে ভয় দেখাচ্ছে। কিন্তু এই জেলে একটু সাহস করে নিজের মতো করে ব্যবসা করতে চাচ্ছে। নিজের পূঁজির সাথে কিছু টাকা গ্রামের লোকজনদের কাছ থেকে সূদে এনেছে।
ঠিকঠাক পুরো মৌসুম ব্যবসা করতে পারলে বিরাট লাভ হবে। এই আশায় ঝুঁকি নিয়েছে জেলে। অর্ধেক মৌসুম ভালোই গেলো। কিন্তু জানুয়ারিতে এসে ধাক্কাটা লাগলো। গত কয়েক বছরে দিনের বেলা পশুর নদীতে দস্যুতা হয়নি। এখনকার বনদস্যুরা দিনে চলাফেরাও করে না। অথচ এই ঘটনাটি ঘটেছে দিনে, পাশাখালী আর চাইলেবগীর মাঝামাঝি কোনো জায়গায়।
জানতে চাইলাম, কতো টাকার মাছ ছিলো ট্রলারে? বললেন, প্রায় এগারো লাখ টাকার মাছ ছিলো ভাই। ট্রলার গড়ছিলাম প্রায় সাত লাখ টাকা দিয়ে। ঋণ আছে প্রায় দশ লাখ। এখন কী দিকে কী করবো? আমার তো সব শেষ! বললাম, আমি কী করতে পারবো জানি না। তবে খোঁজ নিচ্ছি। আপনি একটু কোস্টগার্ড আর RAB এর ক্যাম্পে জানান।
তখনও সোর্সরা খবর পায়নি। জেলে ভাইয়ের ফোন রেখে একটার পর একটা ফোন দিলাম। দস্যুদলগুলোকে ফোনে পাচ্ছি না। সুমন বাহিনীকে পেলাম, ওরা বললো বড় নদীতে তারা নামেই না। এছাড়া ঘটনা পশুর নদীর পশ্চিমে। ওদিকে আমরা যাই না।
পশ্চিম মানে তো জাহঙ্গীর! তার পক্ষে দিনে দুপুরে ডাকাতি করা সম্ভব। কিন্তু যে জায়গার ঘটনা সেখানে বের হওয়ার মতো সাহস আর সুযোগ দুটোই কম। তাহলে অঘটনটি ঘটালো কে?
সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত খোঁজ খবর নিয়ে যা পেলাম তা হলো, চিহ্নিত কোনো দস্যু বাহিনী মাছ বোঝাই ট্রলারটি অপহরণ করেনি। তবে সন্ধ্যার দিকে ওই জেলে তার মাঝির নাম্বার থেকে ফোন পায়। অর্থাৎ নিজেদের কোনো নাম্বার ব্যবহার করেনি দস্যুরা। বলা হয়, দশ লাখ টাকা দিলে ট্রলার ছাড়বে। আর সেই টাকা এক দিনের মধ্যে দিতে হবে। কী ভাবে দিবে তা পরে জানানো হবে। একই সাথে পুরো বিষয়টি গোপন রাখতে হবে। পুলিশকে জানালে ট্রলারের লোকজনকে মেরে ফেলা হবে বলেও হুমকি দেয়।
টেলিটক নাম্বার থেকে ফোন দিয়েছে দস্যুরা। তার মানে ওদের অবস্থান মধ্য সুন্দরবনের নিচে। মোটামুটি ধারনা করছি, পাশাখালীর ওদিকে আছে তারা। নাম্বারটি নিয়ে দায়িত্বশীলদের দিলাম। উনারা ফোন ট্র্যাক করে ব্যবস্থা নিবেন বলে জানালেন।
এর পর দুই দিন গেলো। ট্রলার ছিনতাই করা ওই দস্যুদলের কোনো খোঁজ নাই, দুবলার ওই জেলেরও খবর নাই। আগের সেই নাম্বারও বন্ধ। দুবলার চরের পরিচিত অন্য জেলেদের ফোন দিয়ে খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু মুখ খুলছেন না কেউ। এসময় বেলায়েত সর্দার চরে থাকলে বিস্তারিত জানতে পারতাম। কিন্তু উনি এখন মংলায়, নিজের বাড়িতে।
সর্দারকে এসব বিষয়ে খোঁজ খবর নিতে দেই না এখন। বার বার না করেছি তাকে। কারণ শত্রুরা তৎপর। কোন কথা থেকে কোন কথায় গড়াবে বলা মুশকিল। ওদিকে ফোন কল রেকর্ড করার চল আছে। কখন কাকে কী ভাবে ফাঁসানো হয় বলা মুশকিল। এমনিতে দস্যুদের পৃষ্ঠপোষকরা বেলায়েত সর্দারকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে। দস্যুতায় সহযোগি হিসাবে তার নাম ছড়ানোর চেষ্টা করছে।
ভাবছি, দশ লাখ টাকার মাছ লুটের পরও ওই ট্রলারের মালিক চুপ করে গেলেন কেন? কারও কাছে কোনো অভিযোগও দেননি। আরও দুদিন পর শুনলাম, খুলনার এক ব্যক্তির মাধ্যমে সমঝোতা করেছে সে। দুই লাখ টাকা খরচ করে ট্রলারটি ফেরত পেয়েছে। কিন্তু মাছগুলো আর পাওয়া যায়নি।
এটাই হলো ভয়। সুন্দরবনের ভয়। মনে হয় শেষ পর্যন্ত আবার ভয়েরই জয় হয়েছে। এ বছর মহাজন বদলে নতুন মহাজনের দাদন নিয়েছে সে। পরিকল্পনা ছিলো, পরের বছর নিজেই করবে ব্যবসা, কোনো দাদন নিবেন না। কিন্তু সেই পরিকল্পনা বোধ হয় ভেস্তে গেলো। শুনলাম, পরের বছর আবার আগের মহাজনের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে সেই জেলে। চুক্তি বলতে লিখিত কিছু না।
রাজনীতিটা এবার বুঝতে পেরেছি। হাতে কোনো প্রমাণ নাই। কিন্তু সুন্দরবনে জেলে আর মহাজনের মধ্যে মৌসুম জুড়েই খেলাধূলা চলে। জেলেরা জানে তাদের ঠকানো হয়। চাইলেই তারা নিজের ব্যবসা নিজে করতে পারে। কিন্তু মহাজনের ছাতার নিচে না গেলে কোন দিক থেকে বিপদ আসবে বলা যায় না। ভয়ের পরিবেশটা বেশ জমে গেছে এখন। মনে হচ্ছে পরিবেশটা উল্টোদিকে যেতে শুরু করেছে।
(জানুয়ারি ২০১৭, সুন্দরবন)