সাইক্লোন শেল্টারে ওঠা নিষেধ! | রূপান্তরের গল্প ৩৬৭ | Rupantorer Golpo 367 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ৩৬৭ : স্পিডবোট বের করো! দুবলার চর ফরেস্ট অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নির্দেশ! বললেন, ভাই আসছে আমার অফিসে। একটু ঘুরায়ে না আনলে হয়? বলতে বলতে এসে দাঁড়ালেন জেটির মাথায়।
আমি মাছ ধরতে বসেছি। শেষ ভাটিতে ভালো মাছ হচ্ছে বড়শিতে। বললাম, একটু পরে যাই ভাই। কয়টা মাছ ধরি। উনি বললেন, পাশেই মাঝের কেল্লা শুঁটকি পল্লী। ওখানে একটা মিঠা পানির পুকুর আছে। অনেক মাছ। সুন্দরবনের মাছ আছে আবার রুই-কাতলাও আছে।
মাঝের কেল্লায় আগেও গেছি। তবে থাকা হয়নি। অনেক আগে একবার পানি নিতে আসছিলাম। ওখানে একটি সাইক্লোন শেল্টার আছে। চরের এক সাহেব থাকেন। দুবলার চরে চারটি আশ্রয় কেন্দ্র আছে। তার মধ্যে তিনটিই সাহেবদের দখলে। খেজুর তলার শেল্টারটি প্রায় ভেঙ্গে পড়েছে। তার মধ্যেই বসবাস করেন বনরক্ষীরা
সাইক্লোন শেল্টারগুলো কেন মহাজন-সাহেবদের দখলে থাকবে? মোকাম্মেল ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম। বললেন, সেই শুরু থেকেই তো এগুলো সাহেবদের দখলে। আমি আসলাম কয়েক মাস হলো। বছর ঘুরতেই ফিরে যাবো। নতুন কেউ আসবে। দুবলার চর চলবে তার নিয়মে।
এটা কি আলাদা দেশ? আলাদা নিয়মে কেন চলবে? চাকরির প্রায় শেষ প্রান্তে আসা এই বরকর্তা বললেন, এগুলো নিয়ে বড় স্যারদের সাথে কথা বলবেন। উনারা জবাব দিতে পারবেন। বললাম, আপনি এখন এই অঞ্চলের দায়িত্বে। নিয়ম কানুন রক্ষার দায়িত্ব আপনারই।
এই মেম্বার, তুমি আমার বড়শিগুলো নিয়ে আসো। শহীদকে স্পিডবোট নামাতে বলো! আমার কথার উত্তর না দিয়ে চিৎকার করে আবারও মেম্বারকে ডাকলেন। মেম্বারের নাম ফিরোজ। বাড়ি রামপাল। দুবলার চর ফরেস্ট অফিসে চুক্তিভিত্তিক কাজ করেন তিনি। এখানে দীর্ঘদিন ধরে আছেন। আশপাশের হরিণগুলোর সাথে তার দারুণ খাতির। ডাক দিলেই চলে আসে। মেম্বারের হাতে খাবার খায়। আর শহীদ ভাই হলেন স্পিডবোট চালক। তিনি আর মেম্বার মিলে কাদা ঠেলে স্পিডবোট নামালেন।
জেটি থেকে ওসি সাহেব নামলেন। আমিও বড়শি আর মাছ ধরার জিনিষপত্র নিয়ে উঠলাম স্পিডবোটে।
কয়েক মিনিটের পথ। বন বিভাগের সামনে থেকে রওনা দিয়ে সাগরে বের হলাম। তারপর ডান দিকে ঘুরলেই ছোট্ট একটি খাল। তার ভেতরে ঢুকে মিনিট খানেক সময় এগুলেই ঘাট। দুই পাশে শুঁটকির ঘর। এরা সবাই খোকন সাহেবের জেলে। এই সাহেব দুবলার চরের বড় ব্যবসায়ী। তিনিই দখল করে রেখেছেন এখানকার সাইক্লোন শেল্টারটি।
কর্মচারিরা আছেন। সবাই বেশ ব্যস্ত। কারণ গোন শেষ। শুঁটকি উঠছে। চলছে মাপামাপির কাজ। জেলেরা আসছে মাছ নিয়ে। ওজন দিয়ে ফিরে যাচ্ছেন। বড় দাঁড়িডাল্লায় চলছে মাপ। নামতে নামতে জানতে চাইলাম, সাহেব কোথায়? উনার ম্যানেজার বললেন, খুলনায়। শরীর খারাপ। এই গোনে আসেননি।
স্পিডবোট থেকে নামতে নামতে ওসি সাহেব বললেন, খোকন সাহেবকে দিয়ে কী করবেন? চলেন পুকুর পাড়ে যাই। মাছ ধরতে বসবেন না? বলেই হাঁটা দিলেন। পিছে পিছে হাঁটা দিলাম আমরা। পুকুরটি বেশ বড়, শান বাঁধানো ঘাট। জেলেরা পানি তুলছে ড্রামে করে। খাওয়া ও রান্নায় ব্যবহার করা হয় এই পানি। মুখে নিয়ে দেখলাম। একটু লবণ লবণ। জেলেরা বললো, আইলার সময় এই পুকুরে সাগরের পানি ঢুকলো।
এটা শুকিয়ে ফেললেই তো নতুন করে বৃষ্টির পানি জমতো। এই জঙ্গলে একটা মিঠা পানির পুকুর যে কতো জরুরি! এক জেলে বললো, সাহেবে মাছ ছাড়ছে। পুকু্র শুকাতে দিবে? বললাম, এই পুকুরের মালিক তো সাহেব না, বন বিভাগ। তরুণ এক জেলে বলে বসলো, বন বিভাগ চালায় তারা।
মোকাম্মেল ভাই পাশে বসা। বললেন, বড়শি ফেলেন ভাই। এখানে বড় বড় সাদা মাছ আছে। একটা ধরতে পারলে মজা হবে। বড়শি রেডি করলাম। পুকুরে মাছ আছে, বুঝতে পারছি। কিন্তু বড়শি খাচ্ছে না। অনেক ক্ষণ বসে রইলাম। এর মধ্যে সাহেবের ঘর থেকে চা-নাস্তা আসলো। মুহুরি সাহেব রান্না করার কথা বললেন, না করলাম।
মুহুরিকে বললাম, আপনারা ডিজিটাল ওজন মেশিন ব্যবহার করতে পারেন না? এভাবে সঠিক ওজন মাপা যায়? জেলেদের তো এমনিতেই অবস্থা খারাপ। তার মধ্যে যদি ওজনও কম দেন! কেমন হয়? মুহুরি বেশ পুরনো মানুষ। বললেন, সাহেব যা বলবে এখানে তাই হবে। এর বাইরে কিছৃই করা যাবে না।
প্রসঙ্গ পাল্টে ফেললেন। বললেন, আপনি আসছেন, ওসি সাহেবও আছেন। এক বেলা রান্না করি। একটা ভেড়া বা ছাগল জবাই দেই? আপনার সাথে তো লোকজন আছে। সবাই মিলে খাওয়া যাবে। আবারও না করলাম। বললাম, দুবলার চর তো সুন্দরবন। এটা সংরক্ষিত বন। ছাগল বা ভেড়া এখানে থাকে কী করে? নিষেধ না? বন বিভাগের কর্তার দিকে ছুঁড়ে দিলাম প্রশ্নটি। বললেন, এসব কথা বড় স্যারদের বলেন। বছরের পর বছর ধরে দুবলা এই নিয়মেই চলছে।
গল্পে গল্পে আসলো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কথা। সাগরের মুখে এই জেলে পল্লীটির অবস্থান। যেকোনো দুর্যোগ সবার আগে এখানেও আছড়ে পড়ে। মুহুরি সাহেবের কাছে জানতে চাইলাম, সিডরের সময় কোথায় ছিলেন?
আবার চা আসলো। গল্প বেশ জমে উঠেছে সুন্দরবনের জেলে পল্লীর এই প্রান্তে। কিছুক্ষণের মধ্যে বেশ কয়েক জন জেলে এসে অংশ নিলো। আমার প্রশ্নের উত্তরে ম্যানেজার বললেন, সিডরের সময় এখানেই ছিলাম। সে এক ভয়ঙ্কর সময় গেছে। জীবনটা যে চলে যায়নি সেটা আল্লাহর রহমত। প্রবীন এক জেলে বললেন, সেদিন আমরাও ছিলাম এখানে। ঝড় আসার আগে ট্রলার নিয়ে জঙ্গলে ঢুকে পড়ছিলাম। সে কী কান্ড! পানি উঠতে উঠতে গাছের মাথায় চলে গেলো। জঙ্গলের পশু-পাখিরা সব এক হয়ে গেলো। কেউটে সাপ এসে গায়ে বাড়ি খাই। হরিণ, শুকোর, বাঘেরা ভাসছে চোখের সামনে। সবাই বিপদে। মজার কথা হলো সাইক্লোনের বিপদ সবাই বুঝে। কেউ কাউকে আক্রমণ করে না।
আপনারা তখন জঙ্গলে গেলেন কেন? সামনেই আশ্রয় কেন্দ্র। ঝড় আসলে তো এখানেই উঠার কথা। আরেক জেলে বললো, এটা তো সাহেবের ঘর। ওরা ঢুকতে দেয়নি।
ম্যানেজার সাহেবের দিকে তাকালাম। বললাম, এই সাইক্লোন শেল্টার কি আপনার সাহেবের বাবার করা? এখানে উঠতে দেননি কেন? অস্বীকার করলেন। বললেন, না ভাই। ওরা মিথ্যা কথা বলছে। বললাম, চরের শেল্টারগুলোর মধ্যে শুধু মাত্র অফিস কেল্লার শেল্টারে কিছু জেলে আশ্রয় নিতে পারছে। বাকী তিনটার একটাতেও সাধারণ জেলেদের ঢুকতে দেননি। আপনারা তাদের তাড়িয়ে দিয়েছেন। এবিষয়ে কয়েকশ’ জেলের সাথে আমি কথা বলেছি। সবাই একই কথা বলেছে।
এখানকার সাইক্লোন শেল্টারটি বেশ মজবুত। কয়েকশ’ জেলে এখানে আশ্রয় নিতে পারতো। কতো মানুষ মারা গেলো সেই দুর্যোগে। এর দায় নিতে হবে কিন্তু। সেদিন জেলেরা জঙ্গলের খালে খালে মৃত্যুর সাথে লড়ছিলো। আর আপনারা এখানে বসে ভুড়িভোজ করেছেন। কী দিয়ে ভাত খেয়েছেন বলবো সে কথা?
বড় সাহেবের মুহুরির চেহারা শুকিয়ে গেছে। বললাম, আপনারা ঠিক মানুষ না। জঙ্গলে থাকতে থাকতে কেমন জানি হয়ে গেছেন। জেলেদের রক্ত চুষে খাচ্ছেন। সুন্দরবনের নিয়ম কানুনের ধার ধারেন না। বন বিভাগ আপনাদের কিছু বলার সাহস পায় না। সবই বুঝি। কিন্ত একটা জিনিষ বুঝি না। সেটি হলো, এই যে জঙ্গল ভর্তি এতোগুলো দস্যু বাহিনী। ওরাও আপনাদের কিছু বলে না কেন? ওরা আপনাদের মাছের ট্রলার ধরে না কেন?
কোনো উত্তর নাই। বললাম, এই বিশাল জঙ্গল-সাগরে রাজত্ব করছেন আপনারা। জেলেরা মাছ ধরে। আপনাদেরকেই দেয়। অথচ তাদের ভালো মন্দ দেখেন না। ফরেস্টের লোকজন চুপ করে থাকে কেন বুঝি না। এই অঞ্চল তাদেরই নিয়ন্ত্রণ করার কথা। এখানে দেখি উল্টোটা ঘটে। এই শেল্টারগুলোতে আপনারা থাকেন। পুকুরগুলোর মাছ ধরে বাড়ি নিয়ে যান। একটা মাছও কাউকে ধরতে দেন না।
নারকেল গাছগুলোও মনে হয় আপনাদের। একটা ডাবও কাউকে খেতে দেন না। সংরক্ষিত বনে কয়েকশ’ ছাগল আর ভেড়া পালেন। কেউ কিছু বলে না। খেজুর তলায় সারা বছর আরেক সাহেব ঘর তুলে থাকেন। অথচ শুঁটকির মৌসুম ছাড়া এখানে থাকার নিয়ম নাই। মেহের আলীর খালের সাইক্লোন শেল্টারেও সাহেবরা থাকেন।
পুকুরে মাছ ধরতে এসেছিলাম। একবেলা সময় কাটিয়ে ফিরবো। দুবলার চরের ওসি সাহেব বললেন, চলেন ভাই, মাছ হবে না আজ। অফিসে রান্না করা আছে। একসাথে ভাত খাবো।
বড়শি গুটিয়ে হাঁটা দিলাম। এবার আর স্পিডবোটে নয়। কারণ সাগর বেশ উত্তাল। এখান থেকে সমুদ্রের তীর ধরে হেঁটে যাওয়া যায়। একটু সময় লাগবে। পথে চট্টগ্রামের এক ট্রলার মাঝির সাথে পরিচয়। হাতে বড়শি দেখে বললেন, মাছ পাইলেন? বললাম, পুকুরে পাইনি। দেখি অফিসের জেটিতে বসে মাছ ধরবো।
বাঁশখালীর সেই মাঝি নিজেও বড়শি ফেলেছেন। আমাদের একটু দাঁড়াতে বলেন। সমুদ্রের তীরে নোঙ্গর করা ট্রলারে গেলেন। আগে থেকে ফেলে রাখা বড়শি তুললেন। দুটি তাইড়েল মাছ নিয়ে ফিরে আসেন। একটি মাছ হাতে দিয়ে বললেন, আপনারা রান্না করে খাবেন। বললাম, আমাদের কাছে বাজার আছে, মাছও আছে। উনি বললেন, আপনাকে চিনতে পারছি বদ্দা! সেই সাংবাদিক না?
আপনিই তো মাস্টার, ইলিয়াস ডাকাতদের আত্মসমর্পণ করাইছেন। ইলিয়াস বাহিনী আমাকে অপহরণ করছিলো একবার। দুই লাখ টাকা দিয়ে ছাড়ায়ে আসলাম। বলেই জোর করে আমার হাতে মাছটি ধরিয়ে দিলেন। বললেন, এটা আপনাকে নিতেই হবে। আমার বড়শির মাছ।
হাঁটতে হাঁটতে ফিরলাম অফিস কেল্লায়। মানে দুবলার চর বন বিভাগের অফিসে। ততোক্ষণে সন্ধ্যা হয় হয়। জোয়ারও হয়ে গেছে। অফিসের বারান্দায় বসে ভাত খেলাম। বিদায় নেওয়ার আগে ওসি সাহেবকে বললাম, চরের বাজারের কম্পিউটারের দোকানগুলো যেন বন্ধ না হয়। উনি বললেন, সে আমি দেখবো। তবে আপনি একটু সাবধানে চলবেন। সাহেবদের কিন্তু মেলা পাওয়ার। শুনছি মন্ত্রী মিনিস্টাররাও তাদের কথা শোনে। বললাম, আমার নিরাপত্তা নিয়ে ভাববেন না ভাই। শুধু দোয়া করবেন। আর সাহেবদের ভয় পাবেন না। একজন সাধারণ জেলে যে অধিকার নিয়ে সুন্দরবনে আসে সেই অধিকারটুকু যেন তারা পায়।
ট্রলার ছাড়লো। বড় খাল থেকে ছোট খালে ঢুকতে ঢুকতে সন্ধ্যা নামলো। সরু খাল ধরে ফিরলাম আলোর কোলে। আজ আবার নিউমার্কেটে যাবো।
নিউমার্কেট জমজমাট। জেলেরা উঠে এসেছে সাগর থেকে। পশুর নদীতে ডাকাতির ভয়। তাই এবারের মরা গোনে দুবলা থেকে ট্রলার ছাড়বে না। আড্ডায় বসলাম। জেলেরা যা বললো তার অর্থ হলো, মহাজনরা নিরাপদে ব্যবসা করছেন। লাভের পুরোটাই যায় তাদের পকেটে। তবে লোকসানের ভাগ নেয় না। লোকসানের দায় যায় জেলেদের কাঁধে। আর বিপদ আপদের দায় তুলে দেয় বনদস্যুদের ঘাড়ে।
আজ মৌচাকে ঢিল মেরেছি। এর শেষ না দেখে চর ছাড়বো না। ওদিকে ওহিদুল বড় ভাই নাকী নতুন করে ডাকাতি করতে নেমেছে। সেই খবরও নিতে হবে।
ছবি: দুবলার চরের একটি সাইক্লোন শেল্টার