রূপান্তরের গল্প ৩৭০ | Rupantorer Golpo 370

গোপন মিশন শুরু: গন্তব্য আলিফ ডাকাত | রূপান্তরের গল্প ৩৭০

গোপন মিশন শুরু: গন্তব্য আলিফ ডাকাত | রূপান্তরের গল্প ৩৭০ | Rupantorer Golpo 370 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ৩৭০ : এই ডাকাতের ভয়ে জেলেরা থরথর করে কাঁপে। নাম তার আলিফ। কেউ কেউ বলে আলিম। দয়াল নামে সবাই চিনে। তবে দয়া-মায়ার লেশমাত্র নাই। জেলেরা বলে, আচরণেই এই দস্যুনেতা ভয়ঙ্কর। ভীষণ অত্যাচারী। গাবুরার মান্নান ডাকাতের পর এই আলিফ বাহিনী বেশি অত্যাচার করে। মানে জেলেদের দেখলেই ধরে, মারপিট করে, মাছ কেড়ে নেয়, টাকা পয়সা, মোবাইল ফোন এমন কী খাবার পানিও কেড়ে নেয় সে। তারপর টাকা পয়সায় বনিবনা না হওয়া পর্যন্ত চলে মারপিট।

জেলেদের ধরে মেরে ফেলার ঘটনা নাই। তবে হাত-পা ভেঙ্গে ফেলার ঘটনা নাকী ঘটিয়েছে এই বনদস্যু। দলের মধ্যে বিশ্বাসঘাতকদের গাছে ঝুলিয়ে পেটানো হয়। তারপরও দয়াল নামে কেন ডাকে মানুষ, বুঝি না।

আলিফ মাঝে মাঝেই লোকালয়ে উঠতো। টাকা পয়সা জমিয়ে বেনাপোল, যশোর, খুলনা বা বরিশালে থাকতো। কখনও পাড়ি জমাতো ভারতে। তারপর জমানো টাকা ফুরিয়ে গেলে আবার নামতো সুন্দরবনে। তার সাথে দস্যুতা করে আলম সর্দার, মিলন পাটোয়ারীসহ স্থানীয় কয়েকজন যুবক।

কয়েক বছর আগে RAB এর এক অভিযানে লোকালয় থেকে গ্রেফতার হয়েছিলো আলিফ। অস্ত্র মামলায় জেল খেটেছে কয়েক মাস। তারপর জামিন নিয়ে বের হয়েছে। তারপর থেকে ফেরারি। এরপর থেকে কখনও সে আত্মগোপনে, কখনও নেমেছে সুন্দরবনে ডাকাতি করতে।

আলিফের মালিকানায় বেশ কয়েকটি অস্ত্র ছিলো। গুলি ছিলো হাজার খানেক। ২০১৪-২০১৫ সালের দিকে আত্মগোপণ থেকে বেরিয়ে আসে। অস্ত্র-গুলি নিয়ে যোগ দেয় নোয়া বাহিনীতে। মূলত সাগরে দস্যুতার দায়িত্ব ছিলো তার। পটুয়াখালী থেকে ফিসিং ট্রলার আনা থেকে শুরু করে সাগরে গিয়ে দস্যুতা করায় তার পারদর্শীতা ছিলো বেশ। এই দলের মধ্যে বিদ্রোহ করেছিলো মাস্টারসহ ছয়জন দস্যু। অস্ত্রগুলো কেড়ে নেয় তারা। সেবার অন্যদের সাথে আলিফকেও আটক করেছিলো মাস্টার। তবে প্রাণে মারেনি। কয়েক দিন পর তাদের উঠিয়ে দেওয়া হয়। তারপর আবারও চলে যায় আত্মগোপণে।

বছর খানেক আগে নতুন করে দস্যুতায় নেমেছে আলিফ। থাকে পশ্চিম সুন্দরবন অর্থাৎ সাতক্ষীরা সুন্দরবনের নদী খালে। চলাফেরা করে ট্রলারে। তবে মাঝে মাঝে ডিঙ্গি নৌকাতেও চলে। দিনের বেলা থাকে সরু খালের আগায়। আর রাতের বেলা ছোট নৌকা নিয়ে ওঁৎ পেতে থাকে লোকালয় ঘেঁষা খালে খালে। জেলেরা ঢুকতে গেলেই ডাক দেয় আলিফ। পিলে চমকানো সেই হুংকারে হাত পা শীতল হয়ে আসে জেলেদের। অন্ধকার থেকে বনদস্যুদের সেই ডাক সুন্দরবনের বাঘের চেয়েও ভয়ঙ্কর। জেলেরা বলে, বাঘ ধরলে শুধু আমার জীবনটা নিবে, টাকা পয়সা নিবে না। কিন্তু বনদস্যুতে ধরলে যে টাকা নিবে তার দায় টানতে টানতে এক জীবন কেটে যায়।

আলিফকে এখনও দেখিনি। কোথাও তার ছবিও খুঁজে পাইনি। জেলেদের কাছে তার চেহারার বর্ণনা শুনেছি। কৃষ্ণকায়, বিশালদেহী এই তরুণের মুখ ভর্তি দাড়ি-গোঁফ। একদম সিনেমার দস্যুদের মতো। তার সাথে কথা হয়েছে। কণ্ঠটি বেশ দরাজ। হুঙ্কার দিলে কেমন হবে তা মোটামুটি বুঝতে পারি। বাড়ি তার সাতক্ষীরার শ্যামনগরের মুন্সিগঞ্জে। এবার দল বেশি বড় করেনি। আশপাশের কয়েকজন পুরনো দস্যুদের নিয়ে গড়েছে দল। পশ্চিম বাদায় আলিফ বাহিনী নামেই পরিচিতি। সীমান্ত ঘেঁষা সুন্দরবনের নদী-খালে চলাফেরা তার।

সুন্দরবনের এই অঞ্চল থেকে এখন পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করেছে মজনু বাহিনী, ইলিয়াস ও আলম বাহিনী। এখনও দস্যুতা করছে আলিফ ছাড়াও জোনাব বাহিনী। শুনছি জিয়া নামে এক বনদস্যুও চলাফেরা করছে। জোনাবের ভাই নূর ইসলাম বা নূর আলমের নামও শুনি। শুনেছি এই দস্যুদের পৃষ্ঠপোষক সীমান্ত ঘেঁষা ওই জনপদের এক মেম্বার। সীমান্তে চোরাচালান ও অবৈধ অস্ত্রের কারবার তার নেতৃত্বে চলে এমন গোয়েন্দা প্রতিবেদনও আছে। তবে আলিফকে ওই মেম্বার নিয়ন্ত্রণ করে না। তবুও সতর্ক থাকতে হবে। কারণ আমরা এবার সুন্দরবনে নামবো তার এলাকা থেকে।

সাতক্ষীরার সুন্দরবন ঢাকা থেকে অনেক দূরের পথ। ফেরি পার হয়ে খুলনা পর্যন্তযেতে যেতে ঘণ্টা দশ লেগে যায়। তারপর সাতক্ষীরা হয়ে শ্যামনগর যেতে শরীরের হাড়গোড় আর জায়গায় থাকে না। মানে রাস্তা এতোটাই খারাপ! ফরিদপুর-যশোর হয়ে রাস্তাটি আরও খারাপ। কাজ চলছে ওদিকের রাস্তাগুলোতে। তাই খুলনা হয়ে যাবো এবার। সব মিলিয়ে সময় লাগবে ১২ থেকে ১৪ ঘন্টা। আমরা ২৪ জানুয়ারি সকাল বেলা রওনা হলাম। সঙ্গী হলেন বায়েজীদ ইসলাম পলিন। সাতক্ষীরা থেকে যোগ দেওয়ার কথা আহসান রাজীবের। তবে অন্য কাজ থাকায় তিনি সুন্দরবনে যেতে পারবেন না।

লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে শ্যামনগর উপজেলা সদরে পৌঁছাতে রাত ৮টা বেগে গেলো। একটু বিরতি নিতে হবে। তবে এখানে দাঁড়ানো যাবে না। শ্যামনগরের অনেক মানুষ আমার পরিচিত। এই সফর সম্পর্কে কাউকে কিছু বুঝতে দেওয়া যাবে না। আলিফের সাথে সবশেষ কথা হলো ঘন্টা খানেক আগে। বললো, জামু নামে একজন আমাকে নিয়ে যাবে তার কাছে। জামু নামটি বেশ পরিচিত লাগছে। দস্যুদের স্থানীয় গডফাদারের তালিকায় তার নাম দেখেছি। যাই হোক। সেই ফোন কলের অপেক্ষা করছি।

শ্যামনগরে অফিসের গাড়ি নিয়ে দাঁড়ানো যাবে না। আবার সামনে গিয়ে কোথায় দাঁড়াবো তাই বুঝতে পারছি না। এখন যতো দক্ষিণে যাবো আমাদের পরিচিত লোকজনের সাথে দেখা হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও বাড়বে। এখন কোনো রকম ঝুঁকি নিবো না। এই সফরটি সর্বোচ্চ গোপনীয়তার সাথে করছি। নানা রকম ঝুঁকি মাথায় নিয়ে যাচ্ছি সুন্দরবনে আলিফ বাহিনীর ডেরায়। অচেনা পথ, অচেনা লোকজনদের নিয়ে যাচ্ছি এবার। গাড়িতে যমুনা টিভির ব্রান্ডিং করা। তাই একটু এগিয়ে দাঁড়ালাম।

দুই পাশে চিংড়ির ঘের। মানুষের চিহ্নও নাই। গাড়ি থেকে স্টিকারগুলো তুলে ফেললাম। তারপর একটি পেট্রোল পাম্পে গিয়ে বিরতি নিলাম। সেখানে ছোট্ট একটি চায়ের দোকান আছে। জ্যাকেট আর মাফলার জড়িয়ে নেমে পড়লাম। শীতের রাত। কুয়াশাও পড়ছে জমিয়ে। চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছি আর ঠকঠক করে কাঁপছি। এমন সময় বেজে উঠলো ফোন।অচেনা নাম্বার দেখেই বুঝেছি এটি আলিফের সেই লোকের নাম্বার। এই ফোনে যে কারও ফোন দেওয়ার কথাও নয়। আমার দুটি ফোনই বন্ধ রেখেছি। যাতে কেউ অনুসরণ করতে না পারে।

ওপাশ থেকে কর্কষ কণ্ঠে একজন বললো, আপনারা কতো দূর? বললাম, কে বলছেন? উনি বললেন, নাম না বলি। কে বলছি বুঝতেই পারছেন। বললাম, আমি শ্যামনগরের কাছাকাছি। আসবো কোথায়? উনি বললেন, সোজা কালিঞ্চি চলে আসেন। বললাম, রাস্তা চিনি না। আসবো কী করে? বললেন, কয়েক কিলো আগালে পড়বে বংশীপুর। ওই মোড় থেকে পশ্চিমে আসবেন। সোজা কৈখালীর রাস্তা। কালিঞ্চি এসে খেয়া পার হলেই আমার বাড়ি। গোলাখালীতে থাকি আমি।

কিছুই বুঝলাম না। এদিকে আগেও এসেছি। তবে রাস্তা ঘাট ভালো চিনি না। এছাড়া এদিকের রাস্তা ঘাটগুলো সরু। মটরসাইকেলের পথ। জায়গায় জায়গায় খেয়া পার হতে হয়। বন উপকূলের জটিল পথ। সেখানে গাড়ি নিয়ে কী করে যাবো বুঝতে পারছি না। বললাম, ও জামু ভাই। আমরা তো গাড়ি নিয়ে আসছি, মটরসাইকেল না। উনি বললেন, তাহলে তো বেশি দূর আসতে পারবেন না।

শীতের রাত। পথ দেখানোর লোকজনও পাবেন না। আপনারা আসতে থাকেন। বংশীপুর থেকে আধা ঘণ্টা এসে দেখবেন একটা নতুন ব্রিজ। সেখানেই দাঁড়াবেন। আমি মটরসাইকেল নিয়ে আসছি। বলেই ফোন কেটে দিলেন। তারপর থেকেই বন্ধ সেই ফোন।

কী করি এখন? আপাতত ওই ব্রিজ পর্যন্ত যেতে হবে। গাড়ি ছাড়লাম। বংশীপুর থেকে ডানের রাস্তায় উঠলাম। রাস্তা এখানে বেশ ভালো। তবে কয়েক কিলোমিটার যেতেই বিপত্তিতে পড়লাম। রাত বাজে প্রায় দশটা। কুয়াশায় ঢেকে গেছে চারপাশ। আমাদের গাড়ি চলছে শামুকের গতিতে। আশেপাশে একটি মানুষও নাই। আমাদের ফিরে যাওয়ারও উপায় নাই। গাড়ি চলছে সামনের দিকে। জানি না জায়গা মতো পৌঁছাতে পারবো কী না!

(২৪ জানুয়ারি ২০১৭, সুন্দরবন)

(ছবি: গোলাখালী। পেছনে সুন্দরবন। আলিফের আস্তানা এদিকের খাল-নদী)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top