জাহাঙ্গীরের বিশ্বাস নাই | রূপান্তরের গল্প ৩৭৮ | Rupantorer Golpo 378 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ৩৭৮ : আমি শেষ হয়ে গেছি ভাই। বাঁচান আমাকে! ভুল করছি, বে য়াদবী করছি! পা দুটো আগায়ে দেন ভাই! কান্না করতে করতে কথাগুলো বলছে জাহাঙ্গীর। সেই নাটা জাহাঙ্গীর! যে দস্যুনেতা এখন সুন্দরবনের ত্রাশ! যাকে নিয়ে সন্ত্রস্ত পুরো মধ্য সুন্দরবন। বঙ্গোপসাগরের জেলেরাও তটস্থ থাকে এই নামে। পুরনো দস্যুদের সারিতে নাটা জাহাঙ্গীরের পাত্তা ছিলো না। কিন্তু বড় দস্যু বাহিনীগুলো উঠে আসার পর সেই হয়েছে বড় নেতা। সুন্দরবন যেন তার পায়ের নিচে।
মামদো নদী ধরে যাচ্ছি আমরা। রাত প্রায় বারোটা বাজে। নেটওয়ার্ক আছে নাই এমন একটা অবস্থা। বললাম, আপনার কথা পরিস্কার বুঝতে পারছি না নেটওয়ার্ক সমস্যা। কাল সকালে কথা বলি? জাহাঙ্গীর বলে, না ভাই এখনই শুনতে হবে। বললাম, তাহলে ঘণ্টা খানেক পর কথা বলতে হবে। ভালো নেটওয়ার্কে গিয়ে ফোন দিবো। বললো, আপনি কি সুন্দরবনে? বললাম, আছি এদিকেই। জাহাঙ্গীর বলে, তাহলে ভাই আমার সাথে দেখা করে যান। শিবসা ধরে চলে আসেন। আমি সিগস্যাল দিয়ে ডেকে নিবো।
হতভম্ব আমি। এই তো সেই জাহাঙ্গীর যে আমাকে বলতো, দুই টাকার সাংবাদিক! জীবন থাকতে সারেন্ডার করবো না। প্রশাসনের সাথে নাকী তার ভালো খাতির! সারেন্ডার করবে করবে বলে সে তাদের ঝুলিয়ে রেখেছে। এদিকে কয়েক মাস ডাকাতি করে আত্মগোপণে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কম বেশি সবকিছুই জানি। কিন্তু কাউকে বলতে পারছি না। RAB এর সংশ্লিষ্টদের সাথে বললে উল্টো বুঝবেন। উনাদের কাছে তথ্য, জাহাঙ্গীরের সারেন্ডারে আমার মধ্যস্ততার প্রয়োজন নাই।
নৌকা দুলছে। মানে ভাটা শেষ, জোয়ার হলো। ওদিকে হুহু করে বইছে উত্তরা বাতাস। শেষ জানুয়ারিতে শীতের শেষ কামড় চলছে। বাতাস আর ম্রোতের সংঘর্ষে উথাল পাথাল নদী। আমরা একদম তীর ঘেঁষে এগুচ্ছি। ছন্দে ছন্দে চলছে নৌকা। হীম শীতল পানির ছিটা এসে পড়ছে নৌকায়। ভিজে গেছে বালিশ, কম্বল আর পরনের কাপড়। শীতের সময় জ্যাকেট, মাফলার ভিজে গেলে কেমন লাগে?
শীত লাগছে। কাঁপছি ঠকঠক করে। ওদিকে নির্বিকার বসা সহকর্মী পলিন। মোবাইল ফোনে কী যেন দেখছে। জামু ভাই হাত মিলিয়েছে মাঝিদের সাথে। ঢেউয়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলছে আমাদের ডিঙ্গি নৌকা।
প্রায় চল্লিশ মিনিট পর নদী একটু ঠান্ডা হলো। ততোক্ষণে এগিয়েছি অনেকটা পথ। সামনে লোকালয়। আকাশে আলোর আভা দেখতে পাচ্ছি। মাঝে মাঝে কারা জানি আকাশে টর্চ মারছে। এদিকে ফোনে মোটামুটি নেটওয়ার্ক পাচ্ছি। জাহাঙ্গীরের সাথে কথা বলার পর উত্তেজনা ভর করেছে।
ফোন করলাম আবার। ব্যস্ত পাচ্ছি। আবার করলাম। কল ওয়েইটিং। মিনিট দশ পর ফিরতি ফোন আসলো আরেকটি নাম্বার থেকে। ওপাশে বাছের। মানে জাহাঙ্গীরের ভাগনে, দলটির উপ প্রধান। বললো, জাহাঙ্গীর মামা প্রশাসনের সাথে কথা বলছে। বললাম, সে তো কাঁদতে কাঁদতে শেষ। হইছে টা কী বলো তো? বাছের বললো, আমি কিছু বলতে পারবো না। একটু পর মামাই বলবে। বললাম, ফোন রেখো না।
বাছেরের সাথে কথা বলছি, কিন্তু কানটা অন্যদিকে। পাশেই আরেক ফোনে কথা বলছে জাহাঙ্গীর। সেই একই সুরে চলছে কথা। যার মূল বিষয় বস্তু- আমার বউ বাচ্চাকে বের করে দেন স্যার। আমার যা কিছু সম্পদ আছে, সব নিয়ে নেন। কিন্তু আমার বাচ্চাটা, বৌটাকে বের করে দেন।
ঠিক কী হলো বুঝতে পারছি না। যাই হোক। কিছু একটা হয়েছে। বাছের বললো, আপনি কি আসবেন মামা? বললাম, কেমন করে যাবো? তোমরা আছো শিবসায়। আর আমি আছি মামদো নদীতে। মানে একদম পশ্চিমে, বর্ডারের দিকে। এখান থেকে আসতে না হলেও দেড় দিন লাগবে। বাছের বললো, মামা তো মাথা খারাপ করে দিচ্ছে। আপনি না আসলে হবে না। বললাম, তোমরা ধৈর্য ধরো।
কিছুক্ষণ পর ফোন দিলো জাহাঙ্গীর। সেই একই সুরে কান্নাকাটি করছে। বলছে, যে করেই হোক আপনি আসেন ভাই। বললাম, আসবো। কিন্তু আপনার যে সমস্যা তার সমাধান তো জঙ্গলে নাই। বরং কী হয়েছে বলেন। দেখি কিছু করতে পারি কী না। সে নাছোড়বান্দা। কিন্তু আমি হুট করে তার আস্তানায় যাবো না। তাকে বিশ্বাস করি না।
পরদিন কথা হবে বলে ফোন রাখলাম। ফোন দিলাম বরিশার RAB এর মেজর আদনান কবীরকে। বিস্তারিত জানালাম। আলিফের সাথে দেখা হওয়া, জাহাঙ্গী ডাকাতের ফোন, সব বিষয়ে জানালাম। বললাম, আলিফ সারেন্ডার করবে। তোমরা কাজ শুরু করো।
আলিফের সাথে মেজর আদনানেরও কথা হয়। শুরু থেকেই আমরা দুজনই কথা বলি। তবে সাম্প্রতিক টানাপোড়েনে কাজে একটু ভাটা পড়েছে। দস্যুদের আত্মসমর্পণ করা না করা নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় আড়ষ্ঠ আমরা। সেকারণেই এই গোপন সফর।
নৌকা চলছে। নদীর পানি এখন একটু ঠান্ডা। মানে ঢেউ কমেছে। শুরুর জোয়ারে আশেপাশের খালগুলো থেকে একটা দুইটা নৌকা বের হচ্ছে। কুয়াশা কম থাকায় পরিস্কার দেখছি তাদের। কাঁকড়ার নৌকা বেশি। মরা গোনে কাঁকড়া শিকারীরা বেশি থাকে। জামু ভাইকে বললাম, এখন কাঁকড়া ধরা নিষেধ। তারপরও এতো কাঁকড়ার নৌকা চলে কী করে? এর উত্তর দিলো পেছনে বসা মাঝি। বললো, টাকা দিলে সুন্দরবনে সবকিছু করা যায়। ডাকাত আর ফরেস্ট ম্যানেজ করলে পুরো সুন্দরবনই আপনার হয়ে যাবে। বাঘের চোখ খুলে নিলেও কেউ কিছু বলবে না।
মাঝিরা জিজ্ঞেস করছে, কোন জায়গায় ভিড়াবো? কোন ঘাটে নামবে ভাইয়েরা? জামু বললেন, বাড়ির ঘাটে চলো। বললাম, এখন আর বাড়িতে যাবো না ভাই। গাড়ি আসতে বলেছি। রাতেই এলাকা ছাড়বো। না হলে জানাজানি হয়ে যাবে, ঝামেলা বাড়বে। বিষয়টি আমি গোপন রাখতে চাই। নৌকা কালিঞ্চির খেয়া ঘাটে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন জামু ভাই।
মামদো নদী পার হয়ে উঠলাম মাথা ভাঙ্গা নদীতে। এখান থেকে পশ্চিমে অর্থাৎ বাম পাশে গেলে কৈখালী সীমান্ত। উজান থেকে সেখানে নেমেছে ইছামতি। সীমান্ত নদী কালিঞ্চির সাথে মিশেছে। এদিক দিয়ে মাথা ভাঙ্গা গিয়ে পড়েছে ওই মোহনায়। আরেকটু দক্ষিণে ওপাশ থেকে এসেছে রায়মঙ্গল। এই জায়গাটিতে বলা হয় পাঁচ নদীর মোহনা।
আমাদের ডান দিকে আছে চুনকুড়ি নদী। ওদিক দিয়ে নেমে গেলে খাশিটানা নামে দারুণ সুন্দর একটি খাল আছে। দক্ষিণে চুনকুঁড়ি গিয়ে আবার মিশেছে মামদো নদীর সাথে। পরের খালের নাম ফিরিঙ্গি। আর বাম পাশে অর্থাৎ পূর্ব দিকে খোপড়াখালী। খালটি সোজা গিয়ে ঠেকেছে দোবেঁকীতে। মালঞ্চ নদী ধরে সেখান থেকে সাগরে যাওয়া যায়। আর উত্তরে উঠলে লোকালয়। কলাগাছিয়া নদী পার হলেই খোলপেটুয়া। মোহনায় দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরা। সুন্দনবনের দস্যুদের নিয়ে আমার কাজ শুরু ওখান থেকেই।
জামু ভাই অবাক হয়ে শুনছেন। বললেন, এদিকের সব নদীই তো চিনেন। বললাম, নিচের দিকের খাল-নদীগুলো আরও ভালো চিনি ভাই। পাগড়াতলী চরে চরপাটা জালে প্রচুর মাছ হয়। এর দখল নিয়ে আপনারা মারামারি করেন। ওদিক দিয়ে পূষ্পকাটি, বেহালা, কয়লা, তালতলা, মাইটে, মান্দারবাড়িয়া, তালপট্টি সব জায়গায় গেছি। চোর ডাকাতদের সাথে দেখা করতে করতে এসব জায়গা চেনা হয়েছে ভাই। মাঝিরাও অবাক হয়ে শুনছে। একজন তো বলেই বসলো, কোনো জায়গা তো বাদ রাখেননি ভাই!
হাতের ডানপাশে গোলাখালী, বাম পাশে কালিঞ্চি। আমরা আছি মাথা ভাঙ্গা নদীতে। নৌকা পার হচ্ছে আড়াআড়ি। হঠাৎ একটা কথা মনে পড়লো। এটা তো সেই গোলাখালী ভাই! জামু ভাই বললেন, জ্বি ভাই। এর পরেই সুন্দরবন। বললাম এদিক দিয়ে একবার তিনটা বাঘের বাচ্চা পাচার হইছিলো না? জামু ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম। বললেন, জানি না ভাই। বললাম, না জানলে চলবে কী করে?
বাঘের বাচ্চা তিনটা তো এক সপ্তাহ এই গোলাখালীতেই ছিলো। উনি বললেন, রাখেন তো ভাই। ওই বাচ্চাগুলো তো পরে ধরা পড়েছে। হুম। ঢাকার কল্যাণপুরে ধরা পড়লো। একসাথে তিনটা বাচ্চা! ধরলো কী করে? আবার এক সপ্তাহ রাখছিলো এই গোলাখালীর কোনো একটি ঘরের মুরগির ঘরে। আমি খবর পেয়েছিলাম। কিন্তু বিশ্বাস করিনি। পরে তো দেখি ঘটনা সত্য! এদিকে প্রচুর হরিণ শিকার হয়। সীমান্ত হওয়ায় চোরাচালানও হয়। জামু ভাই বললেন, আমরা এসবের মধ্যে নাই ভাই। হাসলাম। বললাম, আপনার নাম তো সবখানেই আছে। যাক, এবার ভালো হয়ে যেতে হবে ভাই। সুযোগটা হাতছাড়া করবেন না।
খেয়া ঘাটে নামলাম। একটি মটরসাইকেল নিয়ে রওনা হলাম। এবার মূল সড়ক ধরে পৌঁছে গেলাম সেই ব্রিজের কাছে। রাত বাজে প্রায় দুইটা।
গাড়ি আগেই চলে এসেছে। বিদায় নেওয়ার সময় জামু ভাইকে বললাম, রেজাউল আর জামুর মধ্যে কোনো ঝামেলা যেন না হয়। কিছু হলে তার দায় আপনাকে নিতে হবে। এছাড়া আপনি চাইলে আত্মসমর্পণ করতে পারেন। জোর করবো না। এই পথ না ছাড়লে বাঁচতে পারবেন না। সামনে কিন্তু আরও কঠিন হবে সবকিছু!
বিদায় নিলাম। গাড়ি ছুটলো আঁকাবাঁকা পথ ধরে। বংশীপুরে এসে বিরতি নিলাম। একটি চায়ের দোকানে বসলাম। হাতমুখ ধুলাম। দুধ চা খেলাম। তারপর আবার রওনা হলাম খুলনার উদ্দেশ্যে। হোটেলে বলা ছিলো আগে থেকে। ভোরবেলা পৌঁছে বাসায় একটা টেক্সট করলাম। আজ ঠিক করেছি সহজে বিছানা ছাড়বো না। লম্বা বিশ্রাম নিবো।
ফোনটা কাছে রাখলাম। কারণ সকাল সকাল জাহাঙ্গী ফোন দিবে। তার বিষয়টা জানতে হবে। মন বলছে, জাহাঙ্গীর এবার বশ মানবে। তবে সতর্ক থাকতে হবে। কারণ জাহাঙ্গীরকে বিশ্বাস করা যায় না।
(সুন্দরবন, ২৬ জানুয়ারি, ২০১৭)