রূপান্তরের গল্প ৩৮০ | Rupantorer Golpo 380

জাহাঙ্গীরের নাটাই আমার হাতে! | রূপান্তরের গল্প ৩৮০

জাহাঙ্গীরের নাটাই আমার হাতে! | রূপান্তরের গল্প ৩৮০ | Rupantorer Golpo 380 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ৩৮০ : ভোর থেকে হাঁক-ডাক চলছে। মাছ আসছে, ডাক চলছে। কাঁচা মাছ আর কাঁচা টাকার ঝনঝনানিতে মুখর রূপসা ঘাট। এটিই খুলনার মাছের আড়ত। সুন্দরবনের মাছও উঠে এখানে। রাতে খুলনার সাংবাদিকদের সাথে আড্ডা হলো। খাবার খেলাম জিরো পয়েন্টে, আব্বাসের হোটেলে। চুঁইঝাল দিয়ে খাসির মাংস। জাহাঙ্গীর ডাকাতের হয়ে কথা বলতে আসা সেই বনরক্ষীকে বিদায় দিয়ে হোটেলে ফিরেছি। ভোর বেলা ঘুম ভাঙলো। একটা রিক্সা নিয়ে এসেছি ঘাটে, মাছের আড়তে।

যাওয়ার পথে ফোন করলো দস্যুনেতা জাহাঙ্গীর। তার ওই একই কথা। বউ বাচ্চাদের বাঁচান। বললাম, আপনার স্ত্রী সন্তান এখনও যোগাযোগ করেনি? বললো, না। আমি বললাম, বিশ্বাস করি না। আপনার সাথে তাদের কথাও হয়। এখনও কেন মিথ্যা কথা বলেন?

বেশ দৃঢ়তার সাথে কথাগুলো বললাম। একটু রাগ দেখালাম। চরম বিরক্তি নিয়ে বললাম, আমি আপনার বিষয়টা নিয়ে আর কোনো কাজ করবো না ভাই। ফোন কেটে দিলাম। ও কিছুক্ষণ দুশ্চিন্তায় থাক। আমি রূপসা ঘাট ঘুরে আসি।

এখানে প্রথম বার যখন আসি, তখনও ভোর ছিলো। সাধারণত এসময়েই আড়ত খোলে। সারা রাত ধরে ঘাটে ভিড়ে ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ বোঝাই ট্রলার। ২০১০ সালের কথা। তখন বনদস্যুদের সাথে কথা হতো। কিন্তু দেখা করা সম্ভব ছিলো না। তাই উপকূলে ঘুরে ঘুরে বুঝতে চাইতাম দস্যুতার স্বরূপ। খোঁজ নিতে নিতে জানলাম, মাছের আড়তে অনেক কিছুই আছে।

এরপর মাঝে মাঝে আসতাম। দেখতাম মাছ ওঠে, ডাক চলে। নানা রকমের মাছ, বেচাকেনা হচ্ছে মণকে মণ। দেখতে দারুণ লাগে। আড়ত জুড়ে এতো ব্যস্ততা! সাত সকালে শুরু হয়, শেষ হয় কয়েক ঘণ্টার মধ্যে। তারপর হিসাব নিকাষ চলে। বন্ধ হয়ে যায় আড়ত। ওদিকে মাছের পেটি আলাদা হয়। শুনেছি বিভিন্ন জায়গায় উপহারের বাক্স যায় এখান থেকেই।

এক সময় সুন্দরবনের জীবন, দস্যুতার জটিল সমীকরণগুলো বুঝতাম না। চারপাশে শুধু বিভ্রান্তি। কেউই জানে না, জানাতে চায় না। তখন বুঝতাম না পূর্ণিমা কিংবা অমাবশ্যার গোনে জালে মাছ পড়ে। বেশি। ঘাটে দাঁড়িয়ে আড়ত জুড়ে ব্যস্ততা দেখতাম। সবকিছু গোলমেলে লাগতো।

মনে পড়ছে, খুলনার এই রূপসা ঘাট থেকে প্রথম বনদস্যুদের সাথে দেখা করতে যাই। দস্যু সম্রাট রাজু বাহিনীর সাথে হলো সেবার। তারপর অনেক ঘটনা-দুর্ঘটনা পেরিয়ে সুন্দরবন এখন দস্যুমুক্তির পথে। মাঝে স্থবিরতা এসেছিলো। দিশেহারা হয়ে ভাবছিলাম কাজ বন্ধ করবো। কিন্তু হঠাৎ করেই সবকিছু কেমন করে জানি ঘুরতে শুরু করলো। ভেবেছিলাম আলিফ বাহিনীকে আত্মসমর্পণ করাবো এবার। কিন্তু মাঝখানে ঢুকে পড়েছে জাহাঙ্গীর।

পরক্ষণেই ভাবনায় পড়লাম। পালিয়ে যাওয়া লোকগুলোকে পাবো কোথায়? এদিকে ফোন দিতে দিতে পাগল বানিয়ে ফেলেছে জাহাঙ্গীর। ফিরতি ফোন করলাম। বললাম, পরিবারের লোকজনের কী খবর? আবারও অস্বীকার করলো সে। বলে, যোগাযোগ হয়নি এখনও ভাই। পালানোর সময় ফোনগুলো নিতে পারেনি।

মিথ্যা বলা এদের স্বভাব। জাহাঙ্গীরের মধ্যে এই দোষটি খুব বেশি। তাই বিশ্বাস করি না তাকে। শুধু মনে হয়, সাময়িক বিপদ মাথা থেকে নেমে গেলেই চোখ পাল্টি দিবে। সেই কাজে বেশ সুনামও আছে তার।

বললাম, আর মিথ্যা কথা বলবেন না ভাই। বিপদ থেকে বাঁচতে হলে আপনাকে সত্য বলতে হবে। মনে করেন আমি আপনার উকিল বা ডাক্তার। কোনো কিছু গোপন রাখা যাবে না। আমতা আমতা করে ফোন রাখলো সে। আমি জানি, কয়েকটি জায়গায় সোর্সদের মাধ্যমে যোগাযোগ করছে এই দস্যুনেতা। যথারীতি টাকাও খরচ হচ্ছে। ভাবছি এভাবেই চলুক। এক সময় তার টাকা ফুরাবে, মানসিক ভাবেও ভেঙ্গে পড়বে। সেই সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করবো।

কেমন করে সামাল দিবো এতো কিছু? বুঝতে পারছি না। ফোন করে বিস্তারিত জানালাম RAB এর গোয়েন্দা প্রধান আজাদ ভাইকে। বরিশালের মেজর আদনানের সাথেও কথা হলো। শেষ ফোনটি দিলাম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে। বললাম, সুন্দরবনের সেই দস্যুনেতা জাহাঙ্গীর মনে হয় সারেন্ডার করবে। সবকিছু ঠিক থাকলে শিগগিরি সে উঠে আসবে। আপনার আসতে হবে। এবিষয়ে RAB থেকে বিস্তারিত জানাবে। উনি বললেন, জাহাঙ্গীর তো খুব খারাপ লোক! করবে সারেন্ডার? বললাম, দেখা যাক। কাজ আগাচ্ছে।

সেই বনরক্ষী আবার দেখা করতে আসলেন। একটু দূরে নিরিবিলি একটি চায়ের দোকানে বসলাম। যাতে পরিচিত কেউ না দেখে। বললো, রাতের বেলা বড় সাহেবরা বসছিলো। এই ঘাটের কাছে এক সাংবাদিকের অফিস আছে। সেখানেই বসে তারা। জানতে চাইলাম, কী আলোচনা হলো? বনরক্ষী ভাই বললেন, সে অনেক কথা! এরা কেউই আত্মসমর্পণ চায় না। বললাম, এদিকের কোনো খবর পেলে জানাবেন।

রিক্সা করে হোটেলে ফিরলাম। বিদায় দেওয়ার আগে সেই বনরক্ষীকে বললাম, সবই তো হলো। কিন্তু জাহাঙ্গীরের বৌ-বাচ্চাকে পাবো কোথায়?

হাত মিলিয়ে বিদায় নিলেন তিনি। রিক্সায় উঠতে গিয়ে একটু থামলেন। ফিরে তাকালেন। বললাম, কিছু বলবেন? উনি বললেন, ফোনে বলবোনে। বললাম, ফোন তো ট্র্যাক হচ্ছে। গোপন কিছু থাকলে সরাসরি বলেন।

ফিরে আসলেন। বললেন, জাহাঙ্গীরের পরিবারের খবর আমি জানি ভাই। আমার সাথে কথা হইছে। জাহঙ্গীর আপনাকে মিথ্যা কথা বলছে। তার সাথে ময়নার নিয়মিত কথা হয়। ওরা কোথায় আছে জানি আমি। বিস্তারিত জেনে নিলাম। কোথায়, কার বাড়িতে আছে জানলাম। গোপন ফোন নাম্বারটিও দিয়ে গেলেন সেই বনরক্ষী।

মুহুর্তেই মনটা আনন্দে ভরে গেলো। যাক, একটা কাজের খবর পেলাম। ভাগ্যিস খুলনায় বিরতি নিয়েছিলাম!

RAB এর গোয়েন্দা প্রধানকে ফোন দিলাম। জাহাঙ্গীরের স্ত্রী’র গোপন ফোন নাম্বারটি দিলাম। অনুরোধ করলাম, আপাতত কেউ যেন না জানে বিষয়টি। উনি বললেন, শুধু লোকেশনটা জেনে রাখি। বললাম, বাকীটা আমি দেখবো ভাই।

দুপুরে খুলনা ছাড়বো। যাবো বাগেরহাট। আজেকের দিনটা ওদিকে থাকবো। রাতে বা পরদিন ঢাকা ফিরবো।

হোটেলে ফিরলাম। ডেকে তুললাম পলিনকে। আমরা বের হবো। সে বললো, খুলনায় তার এক বন্ধু দেখা করতে চায়। বললাম, এখন আর খুলনায় থাকা যাবে না ভাই। জাহাঙ্গীরকে নিয়ে পরিস্থিতি বেশ জটিল হয়ে পড়েছে। গতকাল মংলার সোর্সদের ডেকেছিলাম। তারা কিন্তু আসেনি। ফোনও বন্ধ। শুনলাম, খুলনার কোনো একটি সংস্থা থেকে লোকজন তাকে ডেকে নিয়েছে। ওদের কাউকেই খুঁজে পাচ্ছি না। তবে হতাশ হওয়ার কিছু নাই। যে খবর পাওয়া দরকার তা পেয়ে গেছি!

দুপুর হয় হয়। ব্যাগ গুছিয়ে হোটেল ছাড়লাম। ওদিকে সুন্দরবন থেকে আলিফ ঘন ঘন ফোন দিচ্ছে। গাড়িতে উঠে ফোন ধরলাম। বললো, এমনিতে খোঁজ খবর নিতে ফোন দিয়েছে। ঠিকঠাক পৌঁছালাম কী না! বললাম, আমরা ঠিক আছি। খুলনায় আছি। সে বললো, তাহলে বাবাজি কিছু মনে না করলে একটা কথা বলবো। আপনি কোন হোটেলে উঠেছেন? বললাম, হোটেল দিয়ে কী করবে তুমি? আসবে? হেসে দিয়ে সে বললো, আমার এক ভাইকে পাঠাবো। কয়টা বড় মাছ পাঠাচ্ছি তার হাতে। বাড়ীর জন্য নিয়ে যাবেন!

আর ভালো লাগে না। বললাম, খুলনায় কি সবগুলো দস্যুনেতার ভাইয়েরা থাকে? বললাম, আমি মাছ নেই কারও কাছ থেকে? সে বললো, না বাবাজি। তারপরও ছেলে হিসাবে দিতে পারি না? বললাম, আমার এই ছেলে ডাকাতি ছাড়ুক। তারপর বাড়ি ফিরুক। তখন গিয়ে খাবো। আলিফ বললো, আমাদের সারেন্ডারের বিষয়ে উপর মহলে কথা বলেছেন? বললাম, সব জানানো হইছে। তোমরা গোছগাছ করো, রেডি হও।

রূপসা সেতু পার হলাম। সামনে কাটাখালীতে একটু চা বিরতি নিবো। বেলায়েত সর্দারকে আসতে বলেছি। আজ আর কোনো কাজ করবো না। বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদ দেখতে যাবো। বিকালে হযরত খান জাহান আলীর মাজারের পুকুরে মাছ ধরতে বসবো।

কাটাখালীতে বিরতি নিলাম। চা খেলাম। বেলায়েত সর্দার যোগ দিলেন। রওনা হলাম বাগেরহাটের পথে। এর মধ্যে আবারও ফোন দিলো জাহাঙ্গীর। বললাম, তুমি মিথ্যা বলছো। তাই তোমাকে নিয়ে আমি কোনো কাজ করবো না। তুমি তোমার স্যারদের মাধ্যমে আত্মসমর্পণ করো। জাহাঙ্গীর বললো, আমি বেকায়দায় বলে আপনারা মাথায় চেপে বসছেন! বিপদ কাটলে দেখবোনে! বললাম, আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন?

জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে ফোন কেড়ে নিলো কেউ। ওপাশ থেকে একজন বললো, ওর মাথা খারাপ হয়ে গেছে ভাই। কার সাথে কী বলে নিজেও জানে না। আমি বললাম, বলে দাও জাহাঙ্গীরকে নিয়ে আমার কোনো মাথা ব্যাথা নাই। তোমরা বাঁচো, মরো, ধরা খাও, বন্দুকযুদ্ধ করো, আমার কিছু আসে যায় না। বলে ফোন রাখলাম।

আমি আসলে অপেক্ষা করছি। জাহাঙ্গীরের পরিবারের লোকজনদের লোকেশনটা জেনে তারপর চুড়ান্ত চাপটা দিবো। সে পর্যন্ত একটু সময় পার করতে হবে।

আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে পৌঁছে গেলাম বাগেরহাট। সেখানে অপেক্ষায় আমার সহকর্মী ইয়ামীন ভাই। বললেন, এদিকে গরম খবর আছে ভাই। বললাম, এই শীতের মধ্যেও গরম খাচ্ছি। একটু আগে নাটা জাহাঙ্গীর যে গরম দিলো! ইয়ামীন ভাই বললেন, জাহাঙ্গীরের এক চাচা আছে। বাড়ি রামপাল, সুন্দরবনে মাছ ধরে। নাম তার কামাল শিকারী। জানতে চাইলাম, ঘটনা কী? উনি বললেন, আপনার সাথে দেখা করতে চায়। বললাম, কখন? বললেন, ফোন দিলেই চলে আসবে। বললাম, ফোন দেন। বিকালে মাজারে আসতে বলেন।

জাহাঙ্গীর না আলিফ? কোনটা আগে? কে আগে সারেন্ডার করবে? হিসাব কষছি।

(জানুয়ারি ২৭, ২০১৭, খুলনা-বাগেরহাট)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top