রূপান্তরের গল্প ৩৮১ | Rupantorer Golpo 381

জাহঙ্গীরের বিষয়ে আর একটা কথাও না! | রূপান্তরের গল্প ৩৮১

জাহঙ্গীরের বিষয়ে আর একটা কথাও না! | রূপান্তরের গল্প ৩৮১ | Rupantorer Golpo 381 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ৩৮১ : “ওই সাংবাদিকেে পাল্লায় পড়ো না। ওর হাতে পড়লে আর বাঁচতে পারবা না। ওদিক দিয়ে সারেন্ডার করলে তোমার কোনো লাভও হবে না। এছাড়া আগে যারা আত্মসমর্পণ করছে তারা কেউ ভালো নাই। টেলিফোনে কথাগুলো বনদস্যু জাহাঙ্গীরকে বলছেন একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি। উত্তরে জাহাঙ্গীর বলছে, আমিও তাকে পছন্দ করি না স্যার। তবে বিপদে পড়ার পর যার কাছে সাহায্য চাইছি সেই টাকা নিছে। একমাত্র মোহসীন সাংবাদিক কিছু নেয়নি। নগদ টাকাও ফিরায়ে দিছে”। কল রেকর্ডটি এসেছে এক সোর্সের কাছ থেকে।

জাহাঙ্গীরের মামা কামাল শিকারী এসেছে দেখা করতে। সময় রাত নয়টা। আমরা বড়শি ফেলেছি বাগেরহাটের খান জাহান আলীর মাজারের দিঘীতে। সন্ধ্যার পর থেকে সেখানেই বসা। বিকালে শহরের দশানীতে হোটেল ধানসিঁড়িতে উঠেছি। রাতে ওখানেই থাকবো। তবে তার আগে নিরিবিলি একটু সময় কাটাতে এসেছি। মাছ ধরার সাথে আড্ডা দিচ্ছি। সোর্সদের সাথে কথাবার্তা চলছে এখানে বসে।

কামাল শিকারীর বাড়ি রামপালে। পরিচয়, সুন্দরবনের জেলে। দস্যুনেতা জাহাঙ্গীরের মামা বলে জঙ্গলে তার আলাদা দাপট। ডাকাত সর্দার ভাগ্নের নামে তার চলছে বেশ। শুনেছি এই লোকটি জাহাঙ্গীরকে অস্ত্র-গুলি পৌঁছে দেয়। এই মুহুর্তে সুন্দরবনের ঝাপসি-জোংড়া আর ভদ্রা এলাকায় মাছ ধরে তার জেলেরা। নিশানখালী-বেলমারী আর পাশাখালীও তার দখলে। এখন জাহঙ্গীর বিপদে পড়ায় কামাল শিকারীও বেকায়দায়। তাই ভাগ্নেকে বিপদ থেকে উদ্ধারে মরিয়া সে। ছুটে বেড়াচ্ছে এদিক ওদিক। আমার কাছেও এসেছে ওই একই কারণে।

দস্যুদের আত্মসমর্পণের বিরোধীতা করছে কিছু মানুষ। তারা হয় পৃষ্ঠপোষক অথবা সুবিধাভোগী। তারা করে ভয়ের ব্যবসা। যতো ভয়, ততো ব্যবসা। এখন দস্যুরা চলে গেলে ভয় কাটবে। জেলেরা সাহসী হবে। তখন আর সাধারণ জেলেদের নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। ওদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে খাওয়া হবে না। বিনা পূঁজির ব্যবসাটা বন্ধ হয়ে ঙাবে। কাজে তারা বিরোধীতা করবেই। কিন্তু দায়িত্বশলীল মানুষেরা কেন তা করবে?

কামাল শিকারীর ফোনে বেশ কয়েকটি কল রেকর্ড শুনলাম। দায়িত্বশীল কিছু মানুষের সাথে দস্যুনেতা জাহাঙ্গীরের কথাবার্তাও শুনলাম। তাদের বেশির ভাগই জাহাঙ্গীরকে এখন আত্মসমর্পন না করতে বলছে। সবচেয়ে অদ্ভুত কথা ছিলো- আরও কিছুদিন ডাকাতি করো, টাকা জমাও। তারপর আত্মসমর্পণ করো। কেউ না করছে। কেউ বলছে, যতো কিছুই হোক, আমার মাধ্যমে যাতে আত্মসমর্পণ না করে।

আসলে বনদস্যুতার গডফাদাররা সব শহরে থাকে। এই মুহুর্তে জাহাঙ্গীর সবচেয়ে বড় দস্যুদলের নেতা। তাই শহরের ওই মানুষদের আগ্রহ জাহাঙ্গীরকে ঘিরে। খুলনায় এসে তা টের পেয়েছি। খবর পেলাম এই মুহুর্তেও খুলনায় বৈঠক করছে জাহাঙ্গীরের সুবিধাভোগীরা।

ওরা যা পারে করুক। ভাবছি কাল ফিরে যাবো। তারপর যা হয় হবে। জাহাঙ্গীরের সমস্যার সমাধান খুব জটিল কিছু না। শুধু তার পালিয়ে থাকা স্ত্রী-সন্তানের নাম্বার ও লোকেশন নিশ্চিত করতে হবে। তারপর তাদের নিরাপদ কোথাও থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। এটুকু তার প্রয়োজন। কিন্তু আমার তো এসবের দরকার নাই। এই সহযোগিতাটা করলে সে কি আত্মসমর্পণ করবে?

দস্যুনেতার মামা কামাল শিকারীকে প্রশ্নটি করলাম, ও কী সারেন্ডার করবে? মামার মুখে উত্তর নাই। বললো, সে তো আত্মসমর্পণের কথা বলে না। বললাম, তাহলে আপনি চলে যান। জাহাঙ্গীরকেও বলবেন আমার সাথে আর যোগাযোগ না করে। ডাকাতের পরিবারের প্রোটেকন দেওয়া আমার কাজ না। এছাড়া তাকে আমি বিশ্বাসও করি না।

জাহাঙ্গীর বাহিনীর সদস্য সংখ্যা আনুমানিক ২০ জন। অস্ত্রও আছে অনেকগুলো। এইট শ্যুটার, সিক্স শ্যুটার শর্টগানও আছে তাদের কাছে। এবং দিনকে দিন বড় হচ্ছে এই বাহিনী। এখন সারেন্ডার না করলে তার জন্য কেন কাজ করবো? কিছু বার্তা দিয়ে কামাল শিকারীকে ফেরত পাঠালাম।

আরও ঘণ্টা খানেক মাজারের সামনে বসে আড্ডা দিলাম। অনেক চেষ্টা করেও মাছ পেলাম না। দুটি বড় বড় কুমির আছে এখানে। রাতের বেলা এই দিঘীর চারপাশ নিরিবিলি থাকে। কিছুদিন আগে একজনকে কুমিরে আক্রমণ করেছিলো। তাই ঝুঁকি নিলাম না। দিঘীর পাড় থেকে উঠে গেলাম ফকিরহাট। রাতের খাবার খেয়ে ফিরলাম বাগেরহাটের হোটেল ধানসিঁড়িতে। সেখানে আগে থেকে হাজির ছিলো সাবেক দস্যুনেতা মাস্টার। আরও কয়েকজন সাবেক বনদস্যু এসেছে দেখা করতে।

নাটা জাহাঙ্গীরের বিষয়টি নিয়ে সাবেক দস্যুদের সাথে আলাপ করলাম। যা বুঝলাম, এক সেকেন্ডের জন্যও জাহাঙ্গীরকে বিশ্বাস করা যাবে না। বেঈমানী আর অকৃতজ্ঞতা নাকী তার রক্তের ভেতর। গত দুই দিন যা হচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে, জাহাঙ্গীর চোখ পাল্টি দিবে।

সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠলাম। ঢাকার পথ ধরবো। তবে তার আগে রামপাল ও মংলার কয়েকজন সাবেক বনদস্যুদের বাড়ি যাবো। ওদের খোঁজ খবর রাখার চেষ্টা করি। সুযোগ পেলে বাড়িতেও যাই। আজ ফজলুর দোকানে যাবো, রামপালে দেখা হবে সোহাগ আকনের সাথে। মাস্টার বাহিনীর সাবেক দস্যুরা সকলেই জামিনে আছে।

সকাল থেকে কয়েক বার ফোন করেছে জাহাঙ্গীর। উতলা সে। সে চায় স্ত্রী-সন্তানকে নিরাপদে তার কাছে পৌঁছে দিবো। বললাম, বিনিময়ে আপনি সারেন্ডার করবেন তো? বললো, আগে আমার কাজটা করে দেন। তারপর অবশ্যই বিবেচনা করবো। বললাম, বিবেচনা? আপনি কি আমাকে পাগল না বোকা ভাবছেন? আপনার বিবেচনার অপেক্ষায় বসে আছি আমি?

আবার কান্না জুড়ে দিলো। এবার বুঝলাম, কান্নাটা তার অভিনয়। বললাম, দেখা যাক। আপনার মামার সাথে কথা হলো কাল। কয়েকটি ফোন রেকর্ড শুনলাম। কোথাও তো সারেন্ডারের কথা বললেন না।

জাহাঙ্গীর বললো, সারেন্ডার তো করতেই চাই। কিন্তু আপনারা তো ভালো হতে দিবেন না। লোকটির কথা শুনলে মাথা ঠান্ডা রাখা মুশকিল হয়ে যায়। বললাম, ফোন রাখেন। পরে কথা হবে।

মাথাটা এলোমেলো। কী করবো, কী ভাবে সবকিছু নিয়ন্ত্রণে নিবো বুঝতে পারছি না। সকালের নাস্তা করলাম পুলিশ লাইনের উল্টোপাশে একটু ছোট্ট রেস্তোঁরাতে। ভাত, ডাল, শুকনো মরিচের ভর্তা, ডিম ভাজা। পরিচ্ছন্ন রান্না। সুযোগ পেলেই সকালের নাস্তাটা করি এখানে।

ভাত খেয়ে চা নিয়ে বসেছি। এমন সময় ফোন আসলো ঢাকা থেকে। RAB এর গোয়েন্দা প্রধান জানালেন, ওদের লোকেশন পাওয়া গেছে। খুলনাতেই আছে। বিস্তারিত আলোচনা করলাম। কী ভাবে কী করবো তার দিকনির্দেশনা নিলাম। যদিও জাহাঙ্গীরের বিষয়ে কোনো কিছুই নিশ্চিত না। শুধু বললাম, বরিশালে একটু বলে রাখবেন। মন্ত্রীর সাথে কথা হয়েছে। তাঁকেও আপনারা বলবেন। যাতে অনুষ্ঠানটা দিনে দিনে করা যায়।

এবার ফোন দিলাম সুন্দরবনে। ধরলো তার ভাগ্নে বাছের। পাশে বসে জাহাঙ্গীর কার সাথে জানি আরেক ফোনে কথা বলছে। বিকট চিৎকার! সমানে গালি দিচ্ছে কাকে জানি। বলছে, আমার বারো লাখ টাকা তুই ফেরত দিবি!

একটু পর ফোনে আসলো জাহাঙ্গীর। ভীষণ গরম! মনে হচ্ছে ফোনেই গুলি করে বসবে! ওখানকার পরিবেশ দেখছি না। তবে বুঝতে পারছি। দলনেতা আজ একটু বেশিই গরম! বেশ মজা পাচ্ছি।

শোনেন ভাই, আপনাদের মধ্যে কিছু লোক আছে যারা খালি দুই নম্বরী করে। থামিয়ে দিয়ে বললাম, বারো লাখ টাকা কি মার গেলো? বললো, সে কথাই বলছিলাম। ওই লোক RAB এর সোর্স। স্যারদের কথা বলে বারো লাখ নিলো। এখন শুনি স্যারে জানেই না! বললাম, দুই দিনে কতো টাকা খরচ হলো? বললো, প্রায় ত্রিশ লাখ। বললাম, কাজ হইছে? বললো, হবে না ভাই। আমার আর ভালো হওয়া হলো না। আপনারা ভালো হতে দিলেন না।

হেসে দিলাম। বললাম, ময়না আর আপনার ছেলে ইয়াসিন তো আপনার সাথে কথা বলে। তারা আছে খুলনায়, ওমুক জায়গায়। এখন কী করবেন বলেন?

মুহুর্তেই থেমে গেলো সব। দাপুটে স্বভাবের জাহাঙ্গীর পরিণত হলো বিড়ালে। আবার সেই কান্না। বললো, ওদের কিছু হলে আপনি দায়ী থাকবেন। এবার থমকে গেলাম আমি। বললাম, আপনি যা পারেন করেন। আমি আর এর মধ্যে নাই।

পুরো বিষয়টি নিজের মধ্যে রাখলাম। এরপর সারাদিন এলোমেলো ঘুরলাম। রামপাল আর মংলার সাবেক দস্যুদের বাড়ি বাড়ি গেলাম, খোঁজ খবর নিলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম আরেকদিন থাকবো।

সারাদিন জাহাঙ্গীরের ফোন আর ধরিনি। সন্ধ্যায় ফিরলাম বাগেরহাটে। মাজার মোড়ে সাবেক দস্যুনেতা মাস্টারের মটরসাইকেলের গ্যারেজ। সেখানে বসলাম। আড্ডা দিলাম। রাতে মাস্টারের বাড়িতে খাওয়া দাওয়া করে দশানীতে হোটেলে ফিরলাম।

হোটেলের সামনে দাঁড়ানো কামাল শিকারী। জাহাঙ্গীরের মামা। সাথে আরও দুইজন। বললাম, আমি এখানে আসবো কে বলেছে আপনাদের? আর যার জন্য আপনারা দৌড়াচ্ছেন, সে কি মানুষ? সে বললো, আমাদের ফিরায়ে দিয়েন না মামা। বললাম, কাল আমি ঢাকা ফিরবো। জাহাঙ্গীরের বিষয়ে আর একটা কথাও না।

(জানুয়ারি ২৭, ২০১৭, বাগেরহাট)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top