চাপে ভাঙলো ভয়ঙ্কর দস্যুনেতা | রূপান্তরের গল্প ৩৮২ | Rupantorer Golpo 382 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ৩৮২ : ও ভাই, ও কি মানুষের মধ্যে পড়ে? আপনি একটু ইশারা দিলে দলের লোকজনই তো তাকে বাইন্দে ফেলবে! চা খেতে খেতে বলছিলেন বেলায়েত সর্দার। দড়াটানা ব্রিজের আগে আমরা চা খাচ্ছিলাম। রাত তখন প্রায় বারোটা। সারাদিনের ধকলে ক্লান্ত আমি। বললাম, জাহাঙ্গীর ভয়ঙ্কর মানুষ। ওকে ভাঙতে হবে। ওদের সারেন্ডার করানোর এমন সুযোগ আর আসবে না।
বেলায়েত সর্দার বললেন, একজনের জন্য এতো চাপ নিবেন কেন? তার দলের অন্য সবাই আপনাকে পছন্দ করে। ওরা আত্মসমর্পন করতে চায়। আপনি বললে ওরা জাহাঙ্গীরকে রেখেই আত্মসমর্পণ করবে। বললাম, তাতে কোনো লাভ হবে না। নতুন করে আবারও দস্যু বাহিনী গড়ে তুলবে সে।
সারাদিন কাজে ব্যস্ত ছিলেন সর্দার। বাগেরহাট থেকে রাতেই বাড়ি যাবেন। বললাম, এই রাতে যাবেন? বাড়ি ঢুকতে ঢুকতে রাত তিনটা বাজবে। তার চেয়ে আমার সাথে থেকে যান।
বাগেরহাটের দশানীর মোড়ে আমাদের হোটেল- ধানসিঁড়ি। এদিকে আসলে এই হোটেলেই উঠি। নিরিবিলি থাকার জন্য জায়গাটি বেশ ভালো। তবে ইদানিং অনেকে জেনে গেছে। নিরিবিলি আর থাকা হয় না। সর্দারকে নিয়ে ফিরে দেখি তখনও জাহাঙ্গীরের মামা দাঁড়িয়ে। বললাম, আমার পেছনে ঘুরে কোনো লাভ হবে না মামা। আপনারা শুধু শুধু কষ্ট করছেন। জাহাঙ্গীরকে আমি সারেন্ডার করাবো না।
২৮ জানুয়ারি ২০১৭। সকাল বেলা ঘুম ভাঙলো আমার স্ত্রীর ফোনে। বললো, আর কতোদিন থাকবে? সর্বনাশ! ভুলে গেছিলাম আজ বিকালে তার ডাক্তার দেখানোর কথা! বললাম, আমি রওনা দিচ্ছি।
একে একে সবাইকে ফোন দিলাম। আপাতত বন্ধ থাকবে কাজ। হোটেল ছেড়ে আবার ওই বাগেরহাট পুলিশ লাইনের সামনের ছাপড়া রেস্তোঁরায় বসলাম। ভরপেট ভাত খেলাম। চায়ে চুমুক দিতে দিতে ফোন দিলাম ঢাকায় RAB এর গোয়েন্দা প্রধানকে। জানালাম ঢাকা ফিরছি আজ। জাহাঙ্গীরকে নিয়ে কাজটি আপাতত বন্ধ রাখছি।
গোয়েন্দা প্রধান লে. কর্নেল আজাদ ভাই বললেন, বিষয়টা বেশি দিন নিয়ন্ত্রণে থাকবে বলে মনে হচ্ছে না। বললাম, আমার ঢাকা ফিরতে হবে ভাই। এছাড়া জাহাঙ্গীরের যে কোনো ঠিক ঠিকানা নাই সেটা বুঝতেই পারছেন। ওদের বলেছি যে আমি এর মধ্যে নাই। তবে সবকিছু নজরে রাখছি, খোঁজ খবরও রাখছি। গোয়েন্দা প্রধান বললেন, গত রাতেই জাহাঙ্গীরের পরিবার জায়গা পরিবর্তন করেছে। ওরা এখন আছে খুলনার লবণ চরায়। বললাম, জানা থাকলো ভাই।
কাটাখালী মোড় খেকে মংলার গাড়ি যায়। সেখানে সর্দারকে নামিয়ে দিলাম। তারপর ছুটলাম ঢাকার পথে। ফিরবো গোপালগঞ্জ হয়ে। পদ্মা পাড়ি দিবো মাওয়া ফেরা ঘাট দিয়ে। সবকিছু ঠিক থাকলে বিকাল পাঁচটার মধ্যে বাসায় ফিরতে পারবো। আজ কোথাও দেরি করবো না। ডাক্তারের আজকের অ্যাপয়েন্টমেন্টটা ধরতেই হবে।
আমার এই দিনের পর দিন সুন্দরবনে থাকা নিয়ে পরিবারের আপত্তি নাই। তবে আমি বুঝি এটি কষ্টের। এই জটিল-কুটিল কাজে নেমে একটা বড় কাজ হচ্ছে ঠিক। কিন্তু নিজের পরিবারকে আমি বঞ্চিত করছি। সুন্দরবন আর সাংবাদিকতা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে থাকতে আমার আর পরিবারে সময় দেওয়া হচ্ছে না। খারাপ লাগে, আবার চিন্তা করি আমরা খেমে গেলে বন উপকূলের ত্রিশ-চল্লিশ লাখ মানুষের জীবন আবার ঝুঁকিতে পড়ে যাবে।
ফকিরহাট পেরিয়ে ছুটছে গাড়ি। সকাল খেকে জাহাঙ্গীর ফোন দিচ্ছে। কিন্তু তার সাথে আর কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। সে নিজেই আছে বিপদে। আমি সহযোগিতা করার চেষ্টা করলাম। অথচ সেই আমাকে থ্রেট করলো?
গাড়ি ছুটছে। রাস্তাটা ভীষণ সুন্দর! দুই পাশে গাছের সারি। চারপাশে মাছের ঘের। এদিকের পানি এখনও লবণাক্ত হয়নি। তাই ঘেরগুলোতে গলদা চিংড়ি হয়, রুই কাতলাও হয়। এদিকের ডাব-নারকেলের সুনাম আছে। একটু পর পর ভ্যানে করে বিক্রি হচ্ছে। ডাবের সাথে পাকা পেঁপে, কলা, বাতাবি লেবু, বেল, সফেদাসহ নানা জাতের ফল পাওয়া যায়। দেশি হাঁস-মুরগির ডিম নিয়েও বসে মানুষ। সাধারণত ফিরতি পথে কেনা কাটা করি। কিন্তু আজ হাতে সময় নাই।
বেলা ১১টার মতো বাজে। প্রতি মিনিটে ফোন দিচ্ছে জাহাঙ্গীর। নতুন-পুরাতন সব নাম্বার খুলেছে সে। তার দলের সদস্যরাও কল করছে। ঠিক করেছি, আজ আর সুন্দরবনের এই দস্যুনেতার ফোন ধরবোই না। এমন সময় খুলনার খুব চেনা এক মাছ ব্যবসায়ীর ফোন আসলো।
কী খবর ভাই? এতো দিন পর কী মনে করে ফোন দিলেন? জাহাঙ্গীরেে কোনো বিষয় না তো? তার বিষয়ে আমি আর কোনো কাজ করবো না। কাল আমাকে থ্রেট করেছে সে। ওপাশ থেকে ওই ব্যবসায়ীর কথা নাই। শুনছি জাহাঙ্গীরের কণ্ঠ! কী বিষয়? আপনি কোত্থেকে? আপনার সাথে কোনো কথা নাই বলছিই তো! কাঁদতে কাঁদতে জাহাঙ্গীর বললো, আমাকে ক্ষমা করে দিবেন ভাই।
কল কনফারেন্স করাটা এরা ভালো পারে। একজনকে ধরিয়ে রেখে আরেকজনের সাথে কথা বলা। গোপন কথা বের করা। কল রেকর্ড করা এদের কাছে ডাল-ভাত। মানে হর হামেশা চলে। বিষয়টি মাথায় রেখে আমি কথাবার্তা বলি। যখন মনে হয় তৃতীয় কেউ আমাদের কথা শুনছে তখন ইচ্ছা মতো বিভ্রান্ত করি। যাই হোক, আজকের ফোন কলে চতুর্থ কেউ আছে কী না জানি না। অনেক সময় প্রশাসনের লোকজনও থাকে কল কনফারেন্সে। যাই হোক জাহাঙ্গীর সোজা সাপ্টা বললো, সারেন্ডার করবে। তবে শর্ত আছে।
বললাম, শর্ত তো দিবো আমি। আপনি আবার কীসের শর্ত দেন? সে বললো, আমার ময়না আর ইয়াসিনকে আপনি আমার কাছে এনে দিবেন। বললাম, তারপর? সে বললো, তারপর আমাকে এক মাস সময় দিবেন। গোছগাছ করে আপনাকে ডাক দিবো। বললাম, আপনি ডাকাতিই করেন। সারেন্ডার করার দরকার নাই। ফোন কেটে দিলাম।
মোল্লারহাট অতিক্রম করতে করতে আবার ফোন। এবার কল এসেছে বাছের এর নাম্বার থেকে। জাহাঙ্গীর বাহিনীর এই দস্যু আমার বিশ্বস্ত। ধরবো না ধরবো না করেও ধরলাম। সে বললো, লিডারের মাথা ঠিক নাই মামা। তার কথায় কিছু মনে রাখবেন না। বললাম, এতো দায় পড়েনি তো বাবা। এখন তোমরা বাঁচো-মরো তোমাদের ব্যাপার।
দশ মিনিট পর আবার ফোন। এবার জাজাঙ্গীর বাহিনীর অন্যরা একে একে কথা বললো। সবাই সারেন্ডার করতে চায়। দস্যুতা করে জমানো টাকা সব জাহাঙ্গীর খরচ করে ফেলেছে। এখন জাহাঙ্গীরকে সরিয়ে হলেও ওরা সারেন্ডার করবে। বললাম, আমি ঢাকায় যাচ্ছি, পরে কথা হবে।
আবার ফোন আসলো। এবার ওপাশে জাহাঙ্গীর। খুব ঠান্ডা কণ্ঠে সে বললো, আমি সারেন্ডার করবো ভাই। আপনি ঢাকায় যাবেন না। দয়া করে ফিরে আসেন। আজকেই আসেন, রাতেই উঠে যাবো।
ফোনে কথা বলতে বলতে গাড়ী চালককে ইশারা করলাম। থামলাম মধুমতি ব্রিজের আগে। সদস্যদের চাপে সারেন্ডার করতে রাজি হয়েছে জাহাঙ্গীর! পলিনকে বললাম, কাজ হয়ে গেছে ভাই। ড্রাইভারকে বললাম, গাড়ি ঘুরাও।
প্রথম ফোন দিলাম বরিশাণ RAB এর অধিনায়ককে। তারপর সংস্থাটির গোয়েন্দা প্রধানকে বললাম, সব রকমের প্রস্তুতি নিয়ে নিতে হবে। আজ রাতে জঙ্গল থেকে তুলে আনবো ওদের। কাল হবে আনুষ্ঠানিকতা। উনি বললেন, এটুকু সময়ের মধ্যে কেমন করে এতো কিছু সামাল দিবো? যাই হোক, আপনি কাজ এগিয়ে নিন। আমি বরিশালে বলে দিচ্ছি।
সময় কম। এর মধ্যে অনেকগুলো কাজ করতে হবে। সর্দারকে ফোন করে ট্রলার রেডি করতে বললাম। মেজর আদনানকে একটি আগাম টিম পাঠাতে বললাম। উনিও রওনা দিবেন বিকালে। জঙ্গল আমরা এক সাথেই যাবো।
মংলা থেকে রওনা দিবো রাতের ভাটায়। দস্যুনেতা জাহাঙ্গীরের সাথে আবারও কথা বললাম। ওকে তো বিশ্বাস করি না। দলের সবাইকে বলেছি, ঝামেলা হলে তোমরা একজনও বাঁচতে পারবে না। ওরা খুব আন্তরিক। বলছে, কোনো রকমে রাতের মধ্যে আসেন। সে পর্যন্ত কোনো ঝামেলা হতে দিবো না।
জাহাঙ্গীরকে বললাম, খুলনা যাচ্ছি। আপনার বউ বাচ্চাকে সাথে নিবো। রাতে তাদের সাথে করে নিয়ে আসবো। সে বলে, তা কেন ভাই? আমার শ্বশুর, শাশুড়ি আর শালাকেও সাথে আনবেন! মাথাটা শুধু শুধু গরম করে দেয় এই ডাকাত। বললাম, আপনার পুরো গুষ্ঠিশুদ্ধা নিয়ে যাবোনে।
মোল্লারহাট থেকে ফকিরহাট হয়ে ফিরছি আমরা। পথে টাউন নোয়াপাড়া খেকে উঠবেন বাগেরহাটের সহকর্মী ইয়ামীন আলী। অফিসে ফোন করে নতুন বাহিনীর আত্মসমর্পণের কথা জানালাম। হঠাৎ মনে হলো, আমি তো ঢাকায় ফিরছিলাম। আজ বিকালে আমার স্ত্রীকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা! ফিরছি বলে কথাও দিলাম সকাল বেলা। এখন কী করে তাকে জানাই এ কথা?
(২৮ জানুয়ারি ২০১৭, বাহেরহাট)