রূপান্তরের গল্প ৩৮৫ | Rupantorer Golpo 385

কী করবে জাহাঙ্গীর? | রূপান্তরের গল্প ৩৮৫

কী করবে জাহাঙ্গীর? | রূপান্তরের গল্প ৩৮৫ | Rupantorer Golpo 385 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ৩৮৫ : ধুম করে ধাক্কা খেলো ট্রলার। সাথে সাথে চিৎকার! তোরা কি চোখেও দেখিস না? রাগে গজগজ করছেন সর্দার। কারণ আরেকটি ট্রলারের সাথে ধাক্কা লেগে গলুয়ে চিঁড় ধরেছে। ভাগ্যিস ওই ট্রলারে লোক ছিলো না। রাতের বেলা বলে বেঁচে গেলাম। কিন্তু সর্দারের চিৎকারে মনে হয় আশপাশে ঘুমিয়ে থাকা লোকজনও জেগে উঠবে! বললাম, ঠান্ডা হন ভাই। নতুন ছেলে। বুঝে উঠতে পারেনি।

শুরুতেই বাধা লাগলো ভাই। আজকে যে কী হবেনে! ট্রলারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ফিক করে হেসে দিলেন আমাদের ক্যাপ্টেন। বললেন, সারেঙ এর মাথা শুরুতেই গরম হয়ে গেলো! বললাম, সামনের দিকে কি বেশি ফাটছে? আমার হাতে সুকানি ধরিয়ে সামনে গেলেন। ফিরে এসে বললেন, চলা যাবে। নদী এখন ঠান্ডা আছে, সমস্যা হবে না।

মংলা খাল থেকে বের হলাম। দুটি ট্রলার চলছে পাশাপাশি। এখন পশুর নদীর পশ্চিম পাশে যাবো। তারপর ওই তীর ধরে এগুতে থাকবো। ভাটার স্রোতের সাথে গা ভাসাবো আজ। মংলা থেকে ভদ্রার মুখ পর্যন্ত যেতে যেতে প্রায় তিন ঘণ্টা লেগে যাবে।

ঢাংমারী খালের মুখে অনেকগুলো কার্গো দাঁড়ানো। সেগুলো কাটিয়ে একদম জঙ্গল ঘেঁষে চলছি। RAB এর ট্রলার চলছে পাশে পাশে। আজ বন বিভাগ নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা নাই। সে দায়িত্ব আজ মেজর আদনানের। উত্তরা বাতাস আছে। একটু একটু কুয়াশা পড়ছে। মধ্য রাত, আধা ভাটিতে নৌকা চলাচল কম করে। তাই এদিকে বন বিভাগের নজরদারি কম। আমরা করমজল পার হলাম। জোংড়া খালের মুখে বন বিভাগের কর্মীরা আলোর ইশারা দিলেন। পাল্টা টর্চ জ্বালিয়ে এগিয়ে গেলাম। এরপর মরাপশুর খাল পেরিয়ে ছুটছে ট্রলার।

ভাটার স্রোতের সাথে চলছি। তীব্র স্রোত! অমাবশ্যার গোন চলে। চারপাশ ঘুঁটঘুঁটে অন্ধকার। জঙ্গল ঘেঁসে আগানোটা সহজ হচ্ছে না। গতি বেশি বলে যখন তখন বাড়ি খাচ্ছি গাছের সাথে। সর্দার বললেন, মাঝ নদীতে যেতে হবে ভাই। পেছনের ট্রলার নির্ঘাৎ অ্যাক্সিডেন্ট করবে।

টর্চ জ্বালিয়ে পেছনের ট্রলারকে ইশারা দিলাম। মুখ ঘুরিয়ে পূর্ব দক্ষিণে এগুলাম। হাড়বাড়িয়া বরাবর এসে আবার পশ্চিমের পথ ধরলাম। সামনেই ভদ্রা।

ভদ্রা নদীর মুখটি বেশ চওড়া। কোণাটা একটু বাড়ানো। ভাঙ্গন আছে। মাস্টার বাহিনীকে আত্মসমর্পণের রাতে এখানে বিরতি নিয়েছিলাম। একবার ভাবলাম এপাশেই ভিড়াই। সর্দার বললেন, সারা রাত এখানে নোঙ্গর করে থাকা ওদের জন্য কষ্টকর হবে। তার চেয়ে ভদ্রা ফরেস্ট অফিসের জেটিতে যাই। আমাদের তো আর চুরি করে থাকা লাগছে না।

আধা ঘণ্টার মতো সময় লাগলো। ভিড়লাম ভদ্রা ফরেস্ট অফিসের ঘাটে। জেটিতে ট্রলার বেঁধে নেমে পড়লাম। একটু দূরে ফরেস্ট অফিস। ঘাটে কেউ নাই। একটু হেঁটে এগিয়ে গেলাম। পরিচিত কেউ থাকলে একটু বলে যাবো। কিন্তু কারও কোনো সাড়া নাই। আমাদের দেখে সম্ভবত দরজা জানালা বন্ধ করে শুয়ে পড়েছেন তাঁরা।

ঝামেলা বাড়ালাম না। চিৎকার করে বললাম, আমরা একটা কাজে এসেছি। ঘাটে ট্রলার বাঁধা থাকবে। আপনাদের দুশ্চিন্তা করবেন না। RAB এর একটা অভিযান আছে। তারপরও কেউ সাড়া দিলো না। আমরা হাঁটা দিলাম ঘাটের দিকে। আমার কথাগুলো ওরা শুনলে ভালো, না শুনলেও অসুবিধা নাই।

সময়ের আগেই পৌঁছে গেছি। ভাটা চলবে আরও আধা ঘণ্টা। তারপর থমকে যাবে পানি, কয়েক মিনিটের জন্য। শুরু হবে জোয়ার। আমরা ‌ওই জোয়ারে রওনা দিবো ভদ্রা নদী ধরে। যাবো বরাবর পশ্চিমে। RAB এর ট্রলারটি থাকবে এখানেই। অপেক্ষা করবে ভদ্রা ফরেস্ট অফিসের জেটিতে।

এদিকে চা উঠলো আমাদের ট্রলারের চুলায়। আমরা গল্পে বসলাম। দেখি RAB কর্মকর্তাদের চোখেমুখে দুশ্চিন্তা। সত্যি বলতে এই সফরটি অনিশ্চয়তায় ভরা। যদি দস্যুদলটিকে নিয়ে সময় মতো না ফিরলে অনেকগুলো ঝামেলায় পড়তে হবে। ওদিকে আত্মসমর্পণের আয়োজন করা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসবেন। কিন্তু জাহাঙ্গীরকে নিয়ে ফিরতে না পারলে সব আয়োজন ভেস্তে যাবে। মাঠ পর্যায়ে নেতৃত্ব দেওয়া একজন মধ্য পর্যায়ের কর্মকর্তার জন্য সেটি দুশ্চিন্তার বিষয়। আমি তা অনুভব করছি।

পরিস্থিতি হাল্কা করার চেষ্টা করছি। মাঝে মাঝে ময়নাকে ডাক দিয়ে নানা কথা জিজ্ঞেস করছি। এসব দেখে ওই টিমের সশস্ত্র সদস্যরা একটু অপ্রস্তুত। তারা ঠিক বুঝতে পারছে না কী হচ্ছে, কী হতে যাচ্ছে! মেজর আদনানকে বললাম, আজ সফল হতে পারি, ব্যর্থও হতে পারি। এমনও হতে পারে ওখানে গিয়ে আমাদের আটকে ফেলবে, পরিবারের সদস্যদের নিয়ে পালিয়ে যাবে জাহাঙ্গীর। এর চেয়ে খারাপ আর কী হতে পারে? মাথা গরম করে গুলি না চালালেই হলো।

হাসতে হাসতে কথাগুলো বলছি। এর মধ্যে চায়ের ট্রে নিয়ে আসলেন সর্দার। মেজর সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, গোলাগুলির সামনে পড়ার অভ্যাস আছে স্যার। ওরা কোনো ঝামেলা করলে ওদের ট্রলারে ট্রলার তুলে দিবো। সব গিয়ে পড়বে পানিতে। বলেই হাসিতে ফেটে পড়লেন। আমার হাতে চা তুলে দিয়ে বললেন, ও ভাই চলেন। এখানে থাকলে টেনশন বাড়বে। তার চেয়ে ভদ্রার মাঝখানে গিয়ে নোঙ্গর করি! বললাম, এমনিতেও রওনা দেওয়ার সময় হয়ে গেছে, রেডি হন।

চা খেতে খেতে কিছু পরিকল্পনা করে নিলাম। মেজর আদনানকে বললাম, যেদিকে যাচ্ছি ওই পাশে ফোনের নেটওয়ার্ক নাই। তোমরা এখানেই থাকবে। সফল হই বা না হই, এখানেই ফিরবো। আমরা ফিরে আসার আগ পর্যন্ত কোনো ট্রলার যেন ভদ্রা নদীতে না ঢুকে। আদনান বললেন, আমাদের সশস্ত্র সদস্যদের কি সাথে নিবেন? বললাম, একদম না। আমার কাজটা চলছে পুরোপুরি বিশ্বাসের উপর। ওই পক্ষ নয় ছয় করতেই পারে, আমি করবো না। খালি হাতেই চলবে আমার কাজ।

কুকু পাখি ডাকছে। তার মানে ভাটা শেষ হয়ে জোয়ার এসেছে। উঠে দাঁদালাম। আদনান বললেন, জাহাঙ্গীরের পরিবারের লোকজনদের নিয়ে যাবেন না ভাই? বললাম, না। সবাইকে নিবো না। উনি বললেন, শুধু ময়না আর ইয়াসিনকে নিয়ে যান। বললাম, তাও না। RAB এর এই কর্মকর্তা বললেন, তাহলে কাকে নিবেন সাথে? বললাম, শুধু ময়নাকে নিবো। ‌ইয়াসিনকেও রেখে যাবো। এখানে ময়নার মা আছেন। তার কাছেই থাকুক।

জাহাঙ্গীরের স্ত্রী ময়নার বাড়ি সাতক্ষীরা। গ্রামের মেয়ে হলেও বেশ স্মার্ট। আমার পরিকল্পনা বুঝে
গেঝে। গলা চড়িয়ে সে বললো, চলেন ভাই। আমি একাই যাবো আপনার সাথে।

ইঞ্জিন চালু হলো। সর্দার দাঁড়িয়েছেন সুকানিতে। দস্যুনেতা জাহাঙ্গীরের স্ত্রী ময়না এসে পাশে দাঁড়ালো। সহকর্মীদের পাঠিয়ে দিলাম সামনে, ছইয়ের ভেতর। বললাম, চুপচাপ ঘুম দিবেন। ভেতরে কোনো রকম আলো জ্বলবে না।

জেটির সাথে বাঁধা দড়ি খুললাম, ট্রলার ভাসলো ভদ্রায়। পশুর নদী থেকে জোয়ারের পানি ঢুকতে শুরু করেছে। রাত বাজে একটা। সম্ভাব্য গন্তব্যে পৌঁছাতে খুব বেশি সময় লাগবে না। জাহাঙ্গীরের স্ত্রী বললো, কতোক্ষণ সময় লাগবে ভাই? বললাম, ঘণ্টা দুই তো লাগবেই। আপনি বিশ্রামে যান। মঢনা বলে, এখানেই থাকি। বললাম, এখানে দাঁড়ানো যাবে না। আমার হাতে সুকানি দিয়ে সর্দার গেলেন ইঞ্জিন রুমে। ওখানে একটা ছোট্ট কেবিন আছে। ময়নাকে সেখানে পাঠিয়ে দিলাম। বললাম, নিশ্চিন্তে ঘুম দেন। সময় হলে ডেকে নিবো।

এখন থেকে সামনের পথ আর সময়টুকু ভীষণ স্পর্শ্বকাতর। ফিরে আসার আগ পর্যন্ত দম নেওয়ার সুযোগ নাই। এই মুহুর্ত থেকে প্রতিটি মুহুর্ত উৎকণ্ঠার। তবে পাত্তা দেওয়া যাবে না। আমি বিচলিত হলে তা অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে। অঘটন ঘটতে সময় লাগবে না।

বনদস্যুদের সাথে অসংখ্য বার দেখা করেছি। আত্মসমর্পণের জন্য বনদস্যুদের তুলে এনেছি। এখন পর্যন্ত বড় কোনো বিপদ হয়নি। কাজগুলো একটা পর্যায়ে সহজ হয়ে আসে। নিজের মতো করে করতে পেরেছি। কিন্তু আজকের ঘটনাটি একেবারেই ভিন্ন। আজকের আত্মসমর্পণটি অনিশ্চয়তায় ভরা।

জোয়ারের স্রোত লেগেছে ভদ্রায়। ট্রলার চলছে ঠিক মাঝ বরাবর। এদিকে নদীটি বেশ প্রশস্ত। দুই পাশে ছোট ছোট খাল। তার ভেতরে জেলেরা আছে। অন্ধকার বলে ভালো দেখা যায় না। তবে বুঝতে পারছি। ট্রলারের শব্দ শুনে কেউ কেউ বড় নদী থেকে ছুটছে খালের ভেতর। দুই পাশের জঙ্গল বেশ গভীর। সুন্দরী, কেওড়ার বনগুলো দিনের বেলায় দেখতে ভীষণ ভালো লাগে। এদিকে বাঘের চাপ বেশি। হরিণ আর বন্য শুকরের অভাব নাই। নদীটি বেশ গভীর। জেলেরা বলে, ভদ্রা নদী নাকী কুমিরের আঁতুর ঘর।

সিগন্যাল বাতি দুটি ছাড়া কোনো আলো জ্বলছে না। ইঞ্জিন রুমে বসা তরুণ ডাক দিলাম। বললাম, একটু সামনে যাও, পলিনকে ডেকে আনো।

সহকর্মীরা কেউ ঘুমায়নি। ডাক দেওয়ার সাথে সাথে ডেক এ আসলেন পলিন। বললাম, আজকের সফরটি একটু ঝামেলার, বুঝতেই পারছেন। আপনারা সতর্ক থাকবেন। ছইয়ের ভেতরেই থাকবেন। সামনে গিয়ে বাম পাশের খালে ঢুকবো আমরা। তখন আমি সামনে গিয়ে দাঁড়াবো। যেকোনো মুহুর্তে সিগন্যাল দিবে বনদস্যুরা। কিন্তু আমি না বলা পর্যন্ত আপনারা বের হবেন না। পরিস্থিতি খারাপ হলে বুঝতে পারবেন। তখন বুদ্ধি খাটিয়ে যা করার করবেন।

বেলায়েত সর্দারকে বললাম, ট্রলারের ইঞ্জিন বন্ধ করবেন না। যেকোনো মুহুর্তে সামনে বা পেছনে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে রাখবেন। যদি কোনো বিপদেও পড়ি আপনারা আমাকে উদ্ধার করতে যাবেন না। এক মুহুর্ত সময়ও নষ্ট করবেন না। সাথে সাথে টান দিবেন। যেদিকে সুবিধা মনে হবে সেদিকে চলে যাবেন।

সর্দার বললেন, আমার হাতে যতোক্ষণ সুকানি আছে ততোক্ষণ কোনো চিন্তা করবেন না। তবে ঝামেলা হলে আপনাকে রেখে যেতে পারবো না ভাই। যে করেই হোক আপনি ট্রলারে থাকবেন। বাকীটা আমি দেখবো। পলিন বললো, আমি আপনার পেছনেই থাকবো ভাই। তখন যা করার আমি করে ফেলবো। বললাম, আমাকে বাঁচাতে গিয়ে সবাই মিলে বিপদে পড়বেন না। সর্দারকে বললাম, ঝামেলা হলে, সোজা টান দিবেন।
সামনে পড়বে আদাচাই ফরেস্ট অফিস। সেখানে গিয়ে দাঁড়াবেন। আর পেছনের দিকে গেলে ভদ্রা ফরেস্ট অফিসে গিয়ে থামবেন। ট্রলারের সহযোগী ওই তরুণকে বললাম, ইঞ্জিন রুমেই থাকবে তুমি। ভেতরে যে মেহমান আছেন তার দিকে খেয়াল রাখবে।

জোয়ার হচ্ছে। পানি ফুলছে। বাড়ছে স্রোত। প্রায় ঘণ্টা দেড় চললাম। নদীটি কিছুদূর এগিয়ে চলে গেছে উত্তরে। ঝাপসি আর জোংড়া খাল পেরিয়ে চলে গেছে লোকালয়ের দিকে। আমরা ওদিকে যাবো না।

বেলায়েত সর্দার রাতে ভালো দেখেন না। আন্দাজের উপর ট্রলার চালান। সামনে আমরা বাম পাশের খালটিতে ঢুকবো। ভালো মতো না চিনলে মুশকিল। একবার পার হয়ে গেলে সারা রাতে আর জায়গায় পৌঁছানো হবে না। এসময় নিজেকেই দায়িত্ব নিতে হয়। এদিকটা আমার চেনা। অসুবিধা হবে না।

ভারী জ্যাকেট, মাফলার আর কানটুপি পড়ে নিলাম। টর্চ হাতে দাঁড়ালাম এগিয়ে গেলাম। দাঁড়ালাম একদম সামনে। গলুইয়ের ওখানে দাঁড়ালে সামনে থেকে আসা বাতাসের ঝাপটা লাগে বুকে, চোখে-মুখে। শীতকালের উত্তরা বাতাস বইছে। ভীষণ ঠান্ডা।

একটু পর পর টর্চ জ্বালিয়ে নিজেদের অবস্থান বুঝে নিচ্ছিলাম। ট্রলার এখন চলছে বাম পাশের জঙ্গল ঘেঁষে। কিছুদূর এগিয়ে বাম পাশের খালটি ধরে ঢুকলাম। গদি কমিয়ে চারপাশে টর্চ মেরে নিশ্চিত হলাম।

এই খালের নাম আদাচাইয়ের ভাড়ানী। কদিন আগে নোয়া বাহিনীকে নিয়ে এ পথে ফিরেছিলাম। তাই চিনতে সমস্যা হলো না।

এখানে দুই তিনটি খাল আছে। ঢুকলাম ডান পাশের খালে। এই খাল গিয়ে পড়েছে আদাচাই খালে। সেখান থেকে সোজা চলে গেলে পড়বো শিবসায়। সেখানে একটি বন টহল ফাঁড়ী আছে। নাম- আদাচাই ফরেস্ট অফিস। ওখানে বনদস্যুদের আসা যাওয়া থাকে সারা বছর।

জাহাঙ্গীর বাহিনীর সাথে আমাদের দেখা হবে এই খালেই। যতোটুকু বুঝতে পারছি সামনেই আছে তারা। ট্রলারের শব্দ ওদিকে পৌঁছে গেছে এতোক্ষণে। সর্দারকে ইশারা দিলাম। মাঝারি গতিতে চলছে ট্রলার, খালের মাঝখান দিয়ে।

আধা ঘণ্টার মধ্যে যা হওয়ার হবে। আমরা প্রস্তুত। ভয়ঙ্কর দস্যুনেতা জাহাঙ্গীর তার লোকজন নিয়ে আশেপাশেই আছে। শিরদাঁড়া সোজা কে দাঁড়িয়ে পড়লাম। প্রতিটি মুহুর্ত এখন ভয়ঙ্কর।

বিশাল বড় আলো জ্বললো সামনে। মানে বড় টর্চের ইশারা। একবার জ্বলার পর পর আমিও দুইবার টর্চ জ্বাললাম। এই ইশারা দিতে টর্চ মারতে হয় পানিতে। পাল্টা ইশারা পেয়ে ওরা আবার দুই বার টর্চ জ্বাললো। ইঞ্জিনের গতি কমে আসলো। সর্দার জানেন এ সময় কী করতে হয়।

ইঞ্জিন নিউট্রালে। আমরা চলছি স্রোতের সাথে সাথে। মিনিট খানেকের মধ্যে একটি নৌকা এগিয়ে আসলো। অন্ধকারে অবয়বটি ছাড়া আর কিছুই দেখছি না। দেখতে দেখতে নৌকাটি ভিড়লো। বুকের ভেতরটা ধকধক করছে। মনে হচ্ছে বিক ফেটে বেড়িয়ে আসবে আমার হৃদপিন্ড।

নৌকা ভিড়তে ভিড়তে একজন উঠে আসলো ট্রলারে। এই তো জাহাঙ্গীর। কী করবে সে এখন? বন্দুকটি শক্ত হাতে ধরা। নৌকায় কয়েকজন দস্যু দাঁড়ানো। প্রত্যেকের বন্দুক আমার দিকে তাক করা।

আমি জায়গা রেখে দাঁড়িয়েছি। একদম গলুইয়ে না, ট্রলারের ধারেও না। মাথার ভেতরটা একদম ফাঁকা। শুধু মনে হচ্ছে, যা হওয়ার হবে। জাহাঙ্গীর এগিয়ে আসলো। ট্রলারে উঠেই ঝুঁকে পড়লো। আমি শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে। পেছন থেকে একটি হাত আমাকে শক্ত করে ধরলো। বুঝতে পারছি সেটি পলিনের হাত। ওইটুকু সময়ের মধ্যে ভরসা জাগলো মনে। তবে জাহাঙ্গীর কী করতে যাচ্ছে বুঝতে পারছি। অন্ধকারের মধ্যে ভয়ঙ্কর মানুষটি চলে এসেছে আমার কাছে, একদম কাছে

চলবে….
ছবি: দস্যুনেতা জাহাঙ্গীর শিকারী
(২৯ জানুয়ারি রাত ৩টা, সুন্দরবন)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top