রূপান্তরের গল্প ৩৮৮ | Rupantorer Golpo 388

ময়নার লোভ কি তাকে ভালো হতে দিবে? | রূপান্তরের গল্প ৩৮৮

ময়নার লোভ কি তাকে ভালো হতে দিবে? | রূপান্তরের গল্প ৩৮৮ | Rupantorer Golpo 388 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ৩৮৮ : চারদিকে শুধু ভয়, ভয় আর ভয়। অথচ ছোট্ট এই খালে এতোগুলো মানুষ আমরা! প্রত্যেকের হাতে বন্দুক, সাথে অজস্র গুলি। গহীন এই বনে যেকোনো শত্রু মোকাবেলার জন্য এই রসদটুকুই যথেষ্ট। তারপরও আতঙ্কিত সবাই। রীতিমতো ভড়কে গেছি। শত্রুকে দেখা না গেলে এমনই হয়।

সুন্দরবনের সৌন্দর্যের কোনো সীমা নাই। আবার এই জঙ্গলে প্রতিকূলতারও হিসাব নাই। জঙ্গল ভর্তি বিষধর সাপ আছে। ওরা আপন মনে থাকে। বাাদাবনের মানুষ তাদের এড়িয়ে চলে। আবার সাপেরাও নাকী মানৃষ এড়িয়ে চলে। কিন্তু বাঘ আপনাকে সামনে পেলেও এড়িয়ে যাবে তার নিশ্চয়তা নাই। ওরা ঘাপটি মেরে থাকে। সুযোগ পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে। পাকা শিকারী না হলে বন্দুক তাক করার সময় পাবে না কেউ।

এই বনের প্রধান বৈশিষ্ট দুর্গমতা। ঘন জঙ্গলে ঠাসা পুরোটা। তার মধ্যে কেউ লুকিয়ে থাকলে দেখা সম্ভব না। তাই গাছের আড়ালে থাকা বাঘ কিংবা কোনো অস্ত্রধারী আপনাকে ঘায়েল করবে এক মুহুর্তে। সাত সকালে তেমন ভয়ের মুখোমুখি আমরা। ঝোপের আড়ালে কীসের শব্দ হলো জানি না। ওরাই নিশ্চিত না। এখন পর্যন্ত যেহেতু গুলি হয়নি, তার মানে অন্য কোনো দস্যু বা আইন শৃংখলা বাহিনী না। হতে পারে বন্যশুকর। বাঘও হতে পারে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কিছুই নিশ্চিত না।

বার বার বলছি, নৌকা ছাড়েন। কিন্তু ওদের মধ্যে উৎসাহ একটু বেশি। ভয়ও বেশি। কিন্তু জঙ্গল থেকে কীসের শব্দ এলো তা নিশ্চিত না হয়ে জায়গা ছাড়বে না। সুন্দরবনের মানুষেরা এমনই। জেলেদের ক্ষেত্রেও দেখেছি কখনও বাঘের আলামত পেলে জঙ্গলে নেমে পড়ে। নিজের চোখে দেখে আসে ভেতরটা। আবার রাতের বেলা কেউ অশরীরী কিছুর আলামত পেলে চুপ করে বসে থাকে না। বরং ভয়ের উৎস খোঁজার চেষ্টা করে।

আবারও বললাম, নৌকা ছাড়ো বাছের। এখানে আর এক এক সেকেন্ডও না। ভাটা হচ্ছে। একটু পরেই এই খাল শুকিয়ে যাবে। কিন্তু ওরা অনড়। ভেতরে কী আছে দেখবেই দেখবে। দস্যুনেতা জাহাঙ্গীরকে এবার বকা দিলাম। বললাম, সারেন্ডার কি করার ইচ্ছা আছে? নাকী এখানেই থাকবেন। ওদিকে অন্যরা কী অবস্থায় আছে সে খেয়াল আছে? সে বললো, এই নৌকা ছাড়ো।

নৌকা ঘুরলো। বৈঠা হাতে বনদস্যুরা বাইতে শুরু করলো। একজন বললো, মনে হয় জনি বন্ধু হবে। সুন্দরবনের মানুষরা বন্য শুকরকে ডাকে জনি বন্ধু। বানরকে ডাকে গাছবন্ধু। হরিণকে ডাকে ছাগল। বাঘকে ডাকে মামা নামে। কেউ আবার বলে সাহেব। শরণখোলা-মোড়েলগঞ্জের জেলেরা ডাকে হিয়াল বা শিয়াল। যে যে নামেই ডাকুক, বাঘকে সবাই ভয় পায়। আবার কেউ কেউ বলে, ও তো একটা চোর। চুরি করে শিকার করে বলে সুন্দরবনের বাঘকে এ নামে ডাকে।

নৌকা ঘুরলো। সরু খাল থেকে বের হলাম। এবার যাবো অন্য পথে। আসার খালটি ধরে গেলে বেশ ঘুরতে হবে। বাছের বললো, আমি আগাচ্ছি। আপনারা পেছন পেছন আসেন।

সামনে পেছনে চলছে নৌকা দুটি। এদিকে খাল একটু চওড়া। তাই বাঘের ভয় কেটে গেছে। কিন্তু দুশ্চিন্তা কমেনি। সামনে আবার কার সাথে দেখা হয়ে যায় কে জানে! ছোট ছোট দস্যুদল এসব খালে লুকিয়ে থাকে। চোরা শিকারীরাও হেঁটে বেড়ায় জঙ্গলে জঙ্গলে। বিষ দিয়ে মাছ শিকারীর চক্র থাকে দলেবলে। আবার কাঠ চোরেরাও থাকে ঘর তুলে। বর্ষায় শুঁটকির ঘর করে দিনের পর দিন থাকে দলবদ্ধ মানুষ। তারা বেশ সাহসী আর আক্রমণাত্মক। হুট করে সামনে পড়লে ওরাও আক্রমণ করে বসে। এছাড়া বন বিভাগ বা আইন শৃংখলা বাহিনীর সামনা সামনি হলেও গোলাগুলি হয়ে যেতে পারে। তাও যদি বাদ দেই, দলের মধ্যেই গোলাগুলি হতে পারে। বিশেষ করে আত্মসমর্পণের সময় এই ঝুঁকি বেড়ে যায় নানা কারণে। যারা সারেন্ডার করতে চায় না তাদের দিক থেকে এমন ঘটনার শংকা করি সব সময়, সতর্ক থাকি।

প্রায় চল্লিশ মিনিট পার হলো। বললাম, রাস্তা ঠিক আছে তো বাছের? পাশে বসা একজন বললো, ঠিক আছে ভাই। বললাম, তুমি চিনো? বললো, চিনি না। তবে ঠিক দিকেই যাচ্ছি। বললাম, কেমন করে বুঝলে সেটা? এবার জাহাঙ্গীর বললো, ওদের কথার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছেন না? আমি কান খাড়া করলাম। না! কিছুই শুনছি না। ওরা বললো, আরও আগে থেকেই তো শুনতে পাচ্ছি। সুন্দরবনে নিরাপদে চলার জন্য চোখের চেয়ে বেশি কাজ করে কান আর নাক। কথায় বলে না, বিপদের গন্ধ পাচ্ছি? এদিকের মানুষ বিপদের গন্ধ পায়।

কিছুক্ষণ পর আমিও শুনলাম। বিরাট হই হুল্লোড় চলছে বনের ভেতর। কয়েক মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেলাম ওই খালের মুখে। সেখানে নৌকা নিয়ে পাহাড়া দিচ্ছে তিনজন। মজার ব্যাপার হলো, তিনজনই ঘুমাচ্ছে। বললাম, ওদের বন্দুকগুলো কেড়ে নাও বাছের। সবাই হেসে দিলো। ঘুম ভাঙলো ওদের। এরপর শুরু হলো অশ্রাব্য গালিগালাজ। জাহাঙ্গীরকে বললাম, বাদ দেন ভাই। সবাই ক্লান্ত, নির্ঘুম।

খালের ভেতর ঢুকলাম। দস্যুদের নৌকার সামনে বড় মাটির চুলা। চলছে রান্না বান্না। কাঁধে বন্দুক ঝুলিয়ে রান্নার দেখভাল করছে প্রধান বাবুর্চি। কয়েকজন জেলে ব্যস্ত নানা কাজে। অন্যদিকে আমাদের ট্রলারের সামনের দিকে ভীড় করেছে দস্যুরা। গোল হয়ে বসা সবাই, কেউ আবার দাঁড়িয়ে। মাঝখানে বসা আমাদের ময়না ভাবী।

দস্যুপত্নীর হাতে একটি দোনলা বন্দুক। লোড করছে, আনলোড করছে। সেফটি লক খুলে গুলি করার অভিনয় করছে। কাছে গিয়ে দেখি, পাশে ‌একটি একনলা বন্দুক রাখা। পয়েন্ট টুটু বন্দুকও আছে একটা। আমাদের দিকে হাতের বন্দুক তাক করলো। বন্দুকে চোখ লাগিয়ে নিশানা করছে ময়না। বললাম, টার্গেটে কে? আমি নাকী জামাই? ময়না বললো, আমার তো মন চায় ওকে গুলি করে শেষ করে ফেলি ভাই। জীবনটা আমার শেষ করে দিলো!

জাহাঙ্গীর হাসে। বলে, তোমাকে তো আমি সবকিছুই দিয়ে দিছি। কোনো সম্পদ তো আমার নামে করিনি। সব করছি তোমার আর তোমার পরিবারের নামে। ময়না বললো, তুমি রামপালের পরিবারেও টাকা দিছো। জানি আমি। তোমার মেয়ের বিয়েতে কতো টাকা খরচ করছো জানি না? জাহাঙ্গীর বলে, তোমাকে যা দিছি সেই তুলনায় ওদের কিছুই দেইনি। আমি বললাম, দেনা পাওনার হিসাব এখন করে আর লাভ নাই। চলেন রওনা দেই। ওদিকে মেজর আদনানরা অপেক্ষা করছে। সারা রাত বসা। আবার টেনশনও করছে। বাছেরকে বললাম, এখানে কোথাও কি মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক পাওয়া যাবে?

সামনের ভাড়ানী ধরে একটু আগালে পাওয়া যাবে মামা। তবে একটু কষ্ট করে গাছে চড়তে হবে। ভাবলাম একটু কষ্ট করি। ওদিকের দুশ্চিন্তাটা কমাই। আমার সহযাত্রীরা তখনও ঘুমাচ্ছে। শুধু বেলায়েত সর্দারকে ডেকে তুললাম। বললাম, চলেন একটু ঘুরে আসি। ডেক থেকে এক লাফে উঠে বসলেন সর্দার। হাত মুখ ধুয়ে আরেক লাফে নৌকায় চড়ে বসলেন। আমরা রওনা হলাম আবার। স্মার্ট ফোন এখানে কাজ করে না। বাছের বললো, আমার ফোন কাজ করবে মামা।

আবার বের হলাম। নৌকা নিয়ে চলে গেলাম ওই ভাড়ানীতে। তারপর জঙ্গলে নামলাম। কিছু দূর হেঁটে উঠলাম একটি কেওড়া গাছে। বাছের বললো, কষ্ট হচ্ছে মামা? সর্দার বলে, শরীরটা কিন্তু ভারী হয়ে গেছে ভাই। আগের মতো আর দৌড়াতেও পারেন না। বললাম, এই জঙ্গলে দৌড়ানো আমার কাজ?

বেশ কষ্ট হচ্ছে। বেয়ে উঠতে গিয়ে হাত আর বুকের কয়েক জায়গা ছিলে গেলো। অবশ্য অন্য দুজনের জন্য কাজটি বেশ সহজ। সর্দার বললেন, কেওড়ার কাঠ কিন্তু নরম ভাই। খুব সাবধান! এর মধ্যে একটি ডাল দেখে আমাকে বসালেন। তারপর গামছা দিয়ে বেঁধে ফেললেন যাতে পড়ে না যাই। ওদিকে পোসেস থেকে মোবাইল ফোন বের করলো বাছের। নেটওয়ার্ক খুঁজতে একটু সময় লাগলো। তারপর নাম্বার বললাম। কিন্তু মেজর আদনার কবীরের ফোনও বন্ধ, মানে ওদিকেও নেটওয়ার্ক নাই। এরপর স্যাটেলাইট ফোনে কল করলাম। কথা হলো RAB এর উপ অধিনায়ক আদনানের সাথে।

বিস্তারিত জানালাম। বললাম, দুশ্চিন্তার কিছু নাই। উনি বললেন, আপনি আছেন ভাই। আমার আর টেনশন কীসের? কিন্তু হাতে সময় নাই। আপনারা রওনা দিবেন কখন? বললাম, একটু রান্নাবান্না হচ্ছে। খেয়েই রওনা দিবো। এখন ভাটা চলে আমাদের আসতে সময় লাগবে না। আবার ভদ্রা থেকে মংলা পৌঁছাতেও সময় লাগবে না।

গাছ থেকে নামতে আরও কষ্ট হলো। হাত আর পা ছিললো কয়েক জায়গায়। আমার অবস্থা দেখে হাসছে ওরা। বললাম, এখন এদিকে দেখার সময় নাই। নৌকায় চলো। আদনান বলতে পারছে না যে এখনই রওনা দেন। ওরা ভেবেছিলো দেখা হয়ে গেলে সাথে সাথে রওনা দিবো। কিন্তু তখন ফিরলে লুকিয়ে রাখা বন্দুকগুলো নিতে পারতাম? প্রসঙ্গটি ইচ্ছা করে তুললাম। কারণ আরও কোনো অস্ত্র আছে কী না তা জানবে এই বাছের। সে বললো, অস্ত্রগুলো সে লুকাইছে দুই দিন আগে। আপনি বুদ্ধি করে না বললে, এগুলো জঙ্গলেই থেকে যেতো। তবে যা ছিলো ওখানেই। আর কোনো অস্ত্র নাই তার।

দস্যুনেতা জাহাঙ্গীরের ভাগ্নে নামে পরিচিত বাছের। বয়স কম, আকারেও ছোট। তবে চলাফেরায় বেশ স্মার্ট। বন্দুকও চালায় ভালো। হাতে তার একটি সিক্স শ্যুটার শর্টগান। নৌকার সামনে বসে নৌকা বাইছে বাছের। পেছনের বৈঠা ধরেছেন বেলায়েত সর্দার।

দ্রুত নৌকা বেয়ে আধা ঘণ্টার মধ্যে ফিরেছি দস্যু বহরে। এবার শুরু হবে মূল কাজ। কিন্তু পলিন তখনও গভীর ঘুমে। ইয়ামীন ভাইসহ অন্যরা উঠেছেন। বেলায়েত সর্দারকে বললাম, পলিনকে ডাকেন। ওরা রান্না শেষ করতে করতে শ্যুটিং এর কাজগুলো সেরে নেই। আমিও উঠলাম। ভারী শীতের কাপড়গুলো খুলে রাখলাম। কিছু প্রয়োজনীয় জিনিষ নিয়ে বের হলাম।

বনদস্যুরা গোছগাছ করছে। অস্ত্র-গুলিগুলো বের করছে। ট্রলারের ছাদে বসা জাহাঙ্গীর। জেলেনা সব তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে। কী কথাবার্তা চলছে সেখানে জানি না। পলিনকে রেডি হতে বলে এগিয়ে গেলাম। দেখি সুখ দুঃখের আলাপ হচ্ছে।

জেলেরা বেশ সংকুচিত। দস্যুনেতার এমন ব্যবহার কখনও দেখেনি তারা। পাশে গিয়ে বসলাম। ওদিকে ক্যামেরা গুছিয়ে বের হয়েছে পলিন। দূর থেকে ক্যামেরা ধরলো। সাথে সাথে বদলে গেলো দস্যুনেতার চেহারা। শুরু হলো কান্না। জেলেদের জড়িয়ে ধরে বলছে, তোমরা আমাকে ক্ষমা করে দিও। অনেক অত্যাচার করছি, মাফ করে দিও। সেই সাথে পাঁচশ’ টাকার একটা করে নোট বের করছে, গুঁজে দিচ্ছে জেলেদের হাতে।

লোকটা ভারী চালাক। ক্যামেরা ধরতেই অভিনয় শুরু করলো। কী আশ্চর্য! সে জানে যে এটা আমি টিভিতে দেখাবো।

পলিনকে কাছে ডাকলাম। সাক্ষাৎকার নিলাম। দেশের মানুষের কাছে ক্ষমা চাইলো জাহাঙ্গীর। দুই দিন আগের সেই ভয়ঙ্কর দস্যুনেতার চেহারা একেবারেই বদলে গেছে। ভাবছি পুরোটাই কি অভিনয়? হতেও পারে। আবার সংশোধনও হতে পারে। দেখা যাক কী হয়। মানুষ তো! নিরাশ হওয়া যাবে না।
ওদিকে কোমড়ে গামছা বেঁধে গোছগাছে নেমেছে ময়না। দস্যুদের ট্রলারের খুঁটিনাটি জিনিসগুলোও বুঝে নিচ্ছে। বলা যায় অস্ত্র আর গুলি ছাড়া সবকিছুই নিয়ে যাবে। বললাম, এগুলো জেলেদের দিয়ে গেলে হয় না? ময়না বলে, চাল-ডাল, বাজার, তেলসহ মেলা জিনিষ আছে। কয়েক লাখ টাকার মাল। সব রেখে যাবো?

লোভ দেখছি। মানুষের লোভ! একটু আগেই বেশ আশা জেগেছিলো মনে। ভেবেছিলাম, জাহাঙ্গীর ভালো হয়ে যাবে। কিন্তু ময়নার লোভ কি তাকে ভালো হতে দিবে?

(২৯ জানুয়ারি ২০১৭, সুন্দরবন)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top