রূপান্তরের গল্প ৩৮৯ | Rupantorer Golpo 389

ভদ্রা ধরে ছুটছে দস্যু বহর | রূপান্তরের গল্প ৩৮৯

ভদ্রা ধরে ছুটছে দস্যু বহর | রূপান্তরের গল্প ৩৮৯ | Rupantorer Golpo 389 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ৩৮৯ : কাউকে কিছু দিবো না আমি। এটা আমার পার্টি! প্রত্যেকটা মেশিন আমাগের। তাই বেতনের টাকার বাইরে কোনো কিছু পাবা না তোমরা! ট্রলারের এক পাশে বসা ময়না। পাশে তার স্বামী দস্যুনেতা জাহাঙ্গীর। সামনে দাঁড়ানো সদস্যরা। তারা বললছে, সেই টাকাও তো পায়নি তারা।

জাহাঙ্গীরেরও মাথা গরম! কারণ সারেন্ডারে যাওয়ার আগেই নিজেদের পাওনা চেয়ে বসলো দলের সদস্যরা। সে বলছে, অনেক টাকা নষ্ট হয়ে গেলো। একজন বললো, নষ্ট তো ইচ্ছা করে করলা। সারেন্ডারে কোনো টাকা লাগে না আমরা সবাই জানি। আর তুমি তোমার বৌ বাচ্চাকে বাঁচানোর জন্য লাখ লাখ টাকা খরচ করলা। ওটা তোমার ব্যাপার। জমিজমাও কম করোনি!!

জাহাঙ্গীর বলে, ওমুকের কাছে দশ লাখ টাকা রাখছিলাম। উঠে ওই টাকা তুলে তোমাদের দিবো। এখন তো হাতে টাকা নাই। উপরো চলো। জেলখানায় বসে পাকা হিসাব করে ফেলবোনে! সদস্যরা বললো, খালি আমাদের পাওনা দিতে তোমার সমস্যা বাধে। জাহাঙ্গীর আরও উত্তপ্ত হওয়ার আগে ময়না দাঁড়িয়ে গেলো। বললো, আমার এক কথা। নতুন করে আর কিছু দিতে পারবে না তোমাদের লিডার।

সর্দারের ট্রলারে বসে মজা দেখছি। প্রতিটি দস্যুদলের আত্মসমর্পণের দিন এমন পরিবেশ আসে। লেনদেন দিয়ে ঝামেলা চলে। শেষশেষ দস্যুনেতা বলে নগদ টাকা নাই। সারেন্ডার করে জেলখানায় যাবো। সেখানে বসে ভাগ বাটোয়ারা করে নিবো। তারপর জেলখানায় এর সুরাহা হয় না। বরং জেলখানার খরচ আর মামলা চালানোর খরচ নিয়ে বাধে নতুন ঝামেলা। এসবে আমার আগ্রহ নাই। ওদের কথায় তাল মিলাই। তবে আমার কথা একটাই। গরীবের রক্ত চোষা টাকা পানিতে পড়ুক।

ঝগড়া বাড়ছে। পরিস্থিতি মনে হয় খারাপের দিকে যাচ্ছে। সবার হাতেই গুলি ভরা বন্দুক। বাছেরকে ইশারা করলাম। বললাম, থামো তোমরা!

আর আগাতে দেওয়া যাবে না। চিৎতার করে বললাম, আপনারা থামবেন? না কি ফিরে যাবো আমি? ময়নাকে সরে যেতে বললাম। এগিয়ে গেলাম। জাহাঙ্গীরকে বললাম, আপনারা দস্যুনেতা। কিন্তু হিসাব পরিস্কার রাখেন না। সে বলে, আপনি একটা সমাধান দেন ভাই। বললাম, ডাকাতির টাকার কোনো সমাধান নাই। আপাতত থামেন সবাই। মেজর আদনান অপেক্ষা করছেন। দ্রুত তৈরি হন। খাওয়া দাওয়া সেরে নেন সবাই।

দস্যুনেতা বললো, উঠে পাওনা পরিশোধ করবে। সদস্যরা তাতে রাজি না। ওদের এক কথা জঙ্গল ছাড়ার আগে পাওনা পরিশোধ করতে হবে, করতেই হবে। সবাইকে আশ্বস্ত করলাম। বললাম, আমি বিষয়টা দেখবো। আপাতত চলেন রওনা দেই।

সকালের নাস্তা করতে করতে একটু দেরি হলো। তার মধ্যে নতুন ঝামেলা। খেতে বসার আগেই জাহাঙ্গীরের সাথে হিসাব-নিকাশে বসে সদস্যরা। তারা বেশির ভাগই পুরনো মানুষ। বুঝতে পারছি, দস্যু ও ব্যক্তি জীবনে এদের মধ্যে লেনদেন ছিলো। সেই অর্থের পরিমান নেহায়েত কম হওয়ার কথা না।

ভাগাভাগি নিয়ে যে শোরগোল শুরু হলো তার পরিণতি কোথায় গিয়ে ঠেকবে জানি না। এবিষয়ে পুরনো অভিজ্ঞতা ভালো না। হিসাব করতে গিয়ে বিরাট কাহিনী শুরু হয়। প্রতিবারই রওনা দেওয়ার আগে হিসাব নিয়ে গন্ডগোল লাগে। না পেরে মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াই। বলি, জঙ্গলের হিসাব জঙ্গলে ফেলেন। আজ থেকে নতুন করে হিসাবের খাতা খোলেন। জেলখানায় গিয়ে বাকী হিসাবটা মিলাবেন।

জাহাঙ্গীরের হিসাব পরিস্কার। সবগুলো অস্ত্রের মালিক সে। তাই এতোদিন যা রোজগার করেছে তার ষাট শতাংশ পাবে। বাকী টাকার অর্ধেক চলে যায় বাজার সদা কিনতে। তারপর যা থাকে তা দিয়ে চলবে দলের সদস্যরা। তার মানে সাধারণ দস্যুদের চলতে হয় বেতনে। মাস ভিত্তিক টাকা পায় না কেউ। দস্যুনেতার যখন মন চায় তখন দেয়। চেষ্টা করে না দেওয়ার।

এই সময়টা বেশ স্পর্শ্বকাতর। অনেক বেশি সতর্ক থাকতে হয়। সহকর্মীরা যে যার দায়িত্ব সম্পর্কে জানে। সকলেই সতর্ক। এখন দস্যুদের নিরস্ত্র করতে হবে। বললাম, সবাই এদিকে আসেন। অস্ত্রগুলো আনলোড করেন। গুলির পোসেস আর বন্দুকগুলো আমাদের ট্রলারে রাখেন।

একে একে সবাই অস্ত্র রাখছে। সামনে দাঁড়ানো বাছের আর দস্যুনেতা। বললাম, এখান থেকে ভদ্রার গোঁড়া পর্যন্ত দেড় ঘণ্টার পথ। ওদিকে ফারুকের দলটা আছে। আরও কোনো খুচরা ডাকাতের দল থাকতে পারে। তাই চারটা বন্দুক হাতে রাখেন। জাহাঙ্গীর, বাছের, ফরিদ আর মারুফ ছাড়া সবার অস্ত্র জমা হলো। সাথে চাপানো অস্ত্রের প্যাকেটগুলো নিলাম। পলিন আর বেলায়েত সর্দার সেগুলো বেঁধে ফেললো। রাখা হলো আমাদের ট্রলারের ছইয়ের ভেতর।

গোছাতে গিয়ে দেখলাম বেশ কিছু অন্য রকম গুলি! এগুলো কোন বন্দুকের? এর বন্দুকটা কোথায়? বাছের বললো, এগুলো নোয়া মিয়ার গুলি। সেদিন ট্রলার শুদ্ধা ধরে আনলাম না? ওখানে ছিলো। বললাম, এগুলো তাহলে ৩১০ বন্দুকের গুলি? তার মানে এই বন্দুক নোয়া মিয়া জমা দিয়েছে!

জেলেদের বিদায় দিলাম। ছোট খালটি থেকে বের হলাম। তারপর লগি দিয়ে ঠেলে ঠেলে চললাম। তারপর পড়লাম একটি মাঝারি খালে। এখান থেকে সোজা চলে গেলে আদাচাইয়ের ভাড়ানী। তারপর ডান দিকে গেলেই পড়বে ভদ্রা। ওখান থেকে সোজা পূর্ব দিকে পশুর নদী। সেখানে আছে RAB এর ট্রলার।

ছুটছে জাহাঙ্গীর বাহিনীর ট্রলার। একটু ভয় ভয় লাগছে। রাত হলে সমস্যা ছিলো না। দিনের বেলায় দস্যু বহরের চলাফেরা ভীষণ ঝুঁকির। বিশেষ করে যারা ট্রলার নিয়ে চলে তাদের জন্য ঝুঁকি শতভাগ।

সামনে দস্যুদের ট্রলার। পেছনে বেলায়েত সর্দারের। আমি আছি জাহাঙ্গীর বাহিনীর ট্রলারে। মোটামুটি সাঁজোয়া নৌযান। সামনে, পেছনে ও দুই পাশে বসা-দাঁড়ানো বনদস্যুরা। চারজন সশস্ত্র, বন্দুক ভর্তি গুলি, আঙ্গুল ট্রিগারে।

বাজে সকাল সাড়ে আটটা। সূর্য উঠেছে অনেক আগে। আজ কুয়াশা নাই। তাই চারপাশ রোদ ঝলমল করছে। গতিতে পেরে উঠছে না বেলায়েত সর্দারের ট্রলার। সহযাত্রীরা সবাই ওখানে। শুধু বায়েজিদ ইসলাম পলিন আমার সাথে বনদস্যুদের ট্রলারে। পলিনকে বললাম, চলতি পথে কিছু কাজ করে নিয়েন। এখনকার পরিবেশটা অন্য রকম। ক্যামেরায় দস্যুদের বাস্তব চেহারাটা পাবেন এখন।

কয়েক মিনিট লাগলো। সামনে ভদ্রা। নদীতে উঠতে যাবো। এমন সময় দেখি সাদা একটি কেবিন ক্রুজার! চিৎকার করে গতি কমাতে বললাম। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হবে না। কারণ ওরা আমাদের দেখে ফেলেছে। বললাম, এটা কাদের জাহাজ? কোস্টগার্ডের? দস্যুরা বললো, বুঝতে পারছি না ভাই। জাহাঙ্গীর বললো, ওরা যারাই হোক, কাছে আসতে দেওয়া যাবে না। তোমরা বন্দুকগুলো চেক করো। আমি বললেই গুলি চালাবা।

কী এক বিপদে যে পড়লাম। আমরা শুয়ে পড়লাম। ভদ্রায় উঠলাম। আমরা আছি দক্ষিণ পাশে। আর সাদা জাহাজটি যাচ্ছে উল্টো পাশের তীর ধরে। সাথে স্পিডবোট বাঁধা।

বুকটা ধক ধক করছে। ভাবছি, এদিক দিয়ে এতো বড় নৌযান চলে আসলো? গোঁড়ায় তো RAB আছে। ওদের বলেছিলাম, আমরা আসার আগে যেন কাউকে ঢুকতে না দেয়! এখন কী হবে?

ভীষণ দুশ্চিন্তার মুহুর্ত। দস্যুনেতা বললো, কোনো টেনশন করবেন না ভাই। আমাদের কাছে আসতে হলে ওদেরও যুদ্ধ করতে হবে। এছাড়া ওদের মতিগতি খারাপ ঠেকছে না। মনে হয় চলে যাবে!

হঠাৎ করে দাঁড়িয়ে পড়লো বাছের। হাত তুলে চিৎকার করে বললো, আপনারা ভালো আছেন মামা? উঠে বসলাম। তাকিয়ে দেখি সাদা ওই কেবিন ক্রুজারের উপর দাঁড়ানো একজন বনরক্ষী। হাত তুলে পাল্টা ইশারা করছেন তিনি। বাছের বললো, উঠে বসেন মামা। ওরা ফরেস্টার। স্মার্ট টিমের ফাইবারের লঞ্চ! ওরা যাচ্ছে ভদ্রার আগায়।

উফ! আবারও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। ট্রলার দুটো নিয়ে উঠে পড়লাম ভদ্রার মাঝখানে। নদীটি বেশ গভীর। কোথায় চর পড়ার সম্ভাবনা নাই। বললাম, এক পাশ দিয়ে গেলে হয় না? বাছের বললো, গুলির রেঞ্জের বাইরে থাকতে হবে মামা। জঙ্গলে কেউ লুকিয়ে থাকলে কী হবে? আমাদের তো শত্রুর অভাব নাই!

ভাটার স্রোতে তরতর করে ছুঠলাম। সকাল সকাল পৌঁছে গেলাম ভদ্রার গোঁড়ায়। RAB এর ট্রলারটি যেখানে রেখে গেছিলাম সেখানেই আছে। বাহিনীটির সসস্ত্র সৈনিকরা উপরে বসা। আমাদের দেখে নড়েচড়ে দাঁড়ালো তারা। ভয়ঙ্কর বনদস্যু জাহাঙ্গীরের বহর নিয়ে এগুচ্ছি আমরা। কিছৃক্ষণের মধ্যে তাদের হেফাজতে নিবেন মেজর আদনান কবীর। উনি ছাদেই বসে আছেন। হাত তুললেন। পাল্টা ইশারা দিলাম আমিও? দূর থেকে বুঝতে পারছি, হাসছেন মেজর আদনান! আরেকটি বড় সাফল্য তাহলে ধরা দিলো!

(২৯ জানুয়ারি ২০১৭, ভদ্রা নদী, সুন্দরবন)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top