সারা রাত দুশ্চিন্তায় ছিলাম | রূপান্তরের গল্প ৩৯ | Rupantorer Golpo 39 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ৩৯ : খালের ভিতরে ঢুকতেই দেখি দু’টি নৌকা একসঙ্গে বাঁধা। নোঙ্গর করা একদম খালের মাঝখানে। সচরাচর জেলেদের নৌকা এমন ভাবে থাকে না। বনদস্যু আর বন বিভাগের চোখ এড়াতে তারা সব সময় ছোট খালের শেষ প্রান্তে গিয়ে থাকে। ছইয়ের ভিতরে কুপি জ্বলছে। মনে হলো নৌকার সবাই ঘুম। গলুইয়ে আমি দাঁড়ানো। আমাদের দেখেও একবিন্দু বিচলিত হলো না তারা। বিষয়টি স্বাভাবিক না।
খালটির নাম চাইলেবগী। দারুণ সুন্দর! ভদ্রা নদীর দক্ষিণের এই খাল ধরে চলে যাওয়া যায় শিবসা নদীতে। নৌকা বহরটি পার হয়ে কিছু দূর আগাতেই বামে একটি খাল পড়লো। বেলমারীর ভাড়ানি বা নিশানখালীর ভাড়ানি তার নাম। আমাদের সেই খালের মুখে নোঙ্গর করার কথা। দাঁড়ালাম সেখানে। গা শিরশির করছিলো। কারণ ওই খাল আর ভাড়ানিগুলো ছিলো বনদস্যুদের চলাফেরার পথ। ভাড়ানি বলতে সেই খালগুলোকে বুঝায় যে খাল দিয়ে এক নদী থেকে আরেক নদী অথবা এক খাল থেকে আরেক খালে বের হওয়া যায়।
বেলমারীর ভাড়ানির মুখে নোঙ্গর করলাম। বেলায়েত সরদারকে ঘুমাতে বললাম। তখনও অন্ধকার। সম্ভবত ভোর চারটার মতো বাজে। মামুন চা চড়িয়েছে। সরদারের ওই ছোট্ট রান্নাঘরে আর কিছু থাকুক না থাকুক চা, চিনি আর দুধের মজুত থাকতো। আর নির্দিষ্ট সময় পর পর চা বানানো ছিলো মামুনের প্রধান কাজ।
বসেছি ট্রলারের গলুই-এ। আকাশের হাল্কা মেঘ। এলোমেলো বাতাস। শরীরটা ঘুম চাচ্ছে। কিন্তু উপায় নাই। যেকোনো সময় দস্যুরা আসবে। মাস্টার বাহিনীর ট্রলার না আসা পর্যন্ত সেখানেই থাকতে হবে। চায়ের কাপ হাতে বসে থাকলাম একা একা। মামুনকেও পাঠালাম বিশ্রামে।
সুন্দরবনের ভিতরে বসে সকাল দেখাটা সবচেয়ে বেশি উপভোগ করি আমি। অদ্ভুত সুন্দর লাগে সময়টা। এদিকে জোয়ার এসেছে নদীতে। খালেও স্রোত ঘুরে গেছে। সেই সঙ্গে নৌকাও ঘুরে গেছে। খালের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি নৌকা দুটি নাই। পূর্ব আকাশে আলো ফুটছে। সকাল হচ্ছে। এবার দুশ্চিন্তা শুরু হলো। দস্যুরা তো নিতে আসলো না। আমরা সময় মতো, নির্ধারিত জায়গায় এসেছি। সকাল হয়ে গেলে তারা আসবে আর?
দুশ্চিন্তা বেড়ে গেলো। মাস্টার বাহিনীর মধ্যে বড় কোনো ঝামেলা হয়নি তো? মত পরিবর্তন হয়ে যায়নি তো তাদের? অন্য কোনো দস্যুদলের সঙ্গে দেখা হলে বিপদ! বিশেষ করে জাহাঙ্গীর বাহিনী নিয়ে চিন্তায় ছিলাম। ওই দস্যুদলটি তখন পুরোপুরি খুলনার গডফাদারদের কথা মতো চলতো। আমার সঙ্গে জাহাঙ্গীরের সম্পর্ক ছিলো বৈরী, আমাকে শত্রু মনে করতো। অন্য কোনো দস্যুবাহিনীর মুখোমুখি হলেও সমস্যা হতে পারে। বন বিভাগ কিংবা কোস্টগার্ডের সামনে পড়লে সবকিছুই ভেস্তে যাবে। সেখানে কোনো নেটওয়ার্কও নাই। জায়গা পরিবর্তন করার সিদ্ধান্তও নিতে পারছিলাম না।
এ দফায় মাস্টার বাহিনীর দস্যুরা দেখা না দিলে তো আমাদের পুরো কাজটিই থমকে যাবে। দ্রুত আকাশ পরিস্কার হচ্ছে। পানির স্রোত বাড়ছে। আমার সহযাত্রীরা সবাই গভীর ঘুমে। এমন সময় দূর থেকে গুনগুন শব্দ কানে এলো। বেলমারী খালের ভিতর থেকে কিছু একটা আসছে। সরসর করে পানি সরছে। মৌমাছির ঝাঁকের মতো গুনগুন শব্দ করে এগিয়ে আসছে মাস্টার বাহিনীর ট্রলার।