রূপান্তরের গল্প ৪১ | Rupantorer Golpo 41

এবার দস্যুদের আস্তানা- পাশাখালী | রূপান্তরের গল্প ৪১

এবার দস্যুদের আস্তানা- পাশাখালী | রূপান্তরের গল্প ৪১ | Rupantorer Golpo 41 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ৪১ : পশুর নদীর পশ্চিমের একটি খাল পাশাখালী। ছোট্ট খাল। কিন্তু বেশ বিখ্যাত। অন্যভাবে বললে এই খালের নামে কুখ্যাতি আছে, ঘটনাবহুল জায়গাও বটে। সুন্দরবন নিয়ে কাজ করতে গিয়ে এই খালের নাম অনেক শুনেছি। কারণ এই খাল দিয়ে পূর্ব থেকে পশ্চিম সুন্দরবনের যেকোনো জায়গায় চলে যাওয়া যায়। ভৌগলিক অবস্থানের কারণে দস্যুদের সময় কাটানোর জন্য সুবিধাজনক। একটা সময় সুন্দরবনের সবচেয়ে বড় দস্যুদলটির বিশ্রাম নেয়ার জায়গা ছিলো এই পাশাখালী। সেবারের সফরে আমরা গেছি সেই পাশাখালীতেই।

তখন সকাল ৬টার মতো বাজে। জোয়ারে খাল উপচে পানি ঢুকেছে বনের ভিতরে। শুধু ফরেস্ট অফিসের স্থাপনাটুকু ছাড়া পুরোটাই পানির নিচে। কলকল করে স্রোত যাচ্ছে পূর্ব থেকে পশ্চিমে। অমাবশ্যা বা পূর্নিমার সময় সাগর-নদীর ফডলে ফেঁপে থাকে। স্রোতের তোড়ে ট্রলারগুলো বেঁধে রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে। অনেক কসরৎ করে আমাদের ট্রলারটাও বাঁধা হলো সেখানে। এসবের ফাঁকে ফাঁকে দস্যুদের ট্রলারগুলোতে নজর রেখেছিলাম। নতুন নতুন চেহারা আছে, আবার পুরনো অনেকে নাই।

আমাকে বলা হলো কয়েকজন ছুটিতে গেছে। সারেন্ডারের আগে আবার আসবে। কথা বলতে বলতে জানলাম আসলে অধিকাংশই আত্মসমর্পণ করতে চায় না। তারা হয় চলে গেছে, অথবা উঠিয়ে দেয়া হয়েছে। উঠিয়ে দেয়া মানে বের করে দেয়া। যখন কাউকে উঠিয়ে দেয়া হয় তখন তাদের কাছে থেকে অস্ত্র-গুলি বুঝে নিয়ে বিদায় করে দেয়া হয়। আগেই বলেছি, মাস্টার বাহিনীর মধ্যে আত্মসমর্পণ নিয়ে বিভক্তি তৈরি হয়েছে আমার আগের সফরের পর থেকে। 

মূল ট্রলার থেকে নামলাম অন্য ট্রলারে। অপরিচিতদের মঙ্গে পরিচিত হলাম। পুরনো কয়েকজনের সঙ্গে আবার দেখা হলো। মাস্টার বাহিনীর দস্যুরা এবার সংখ্যায় কম, ২০/২২ জন হবে। তাদের মধ্যে রাজন নামের একজন এগিয়ে আসলো। হাত বাড়িয়ে আমাকে নিয়ে বসালেন সেই ট্রলারে। জলদস্যু মাস্টার বাহিনীর সেটি তিন নম্বর ট্রলার। আকারে একটু ছোট আর তার মধ্যে ছোট ছোট খোপ করা। প্রতিটি খোপ-এ একজন করে বসা। প্রত্যকের হাতে অস্ত্র। রাজন আমাকে নিয়ে গেলেন গলুই-এ।

রাজনকে বললাম আগে তো দেখিনি! সে বললো আমাকে অনেক আগে থেকেই চিনে। টেলিভিশনে নিউজ দেখেছে আমার। দুই দিন অস্থির সময় পার করেছি। চেহারায় ক্লান্তি স্পষ্ট। রাজন বললো আসেন ভাই, আপনাকে একটু চাঙ্গা বানিয়ে দেই। তেলের সাথে টাইগার বাম মিশিয়ে মাথা, কপাল আর কাঁধে মাসাজ করে দিলেন। ঘুম চলে আসলো। কিন্তু ঘুমানো যাবে না। বললাম এক কাপ চা খাওয়ান।

ওদিকে দস্যুনেতার ডাক। নিচে নামবো। বললাম এটা তো বন বিভাগের অফিস। ফরেস্টের লোকজনের সামনে আমরা যাবো? বললেন, কোনো সমস্যা নাই। সব আমরা আমরাই। কোনো সমস্যা নাই। অর্থাৎ বনকর্মীদের সঙ্গে তাদের সখ্য এমন পর্যায়ের? শুনেছি, তবে নিজের চোখে দস্যু আর বনকর্মীদের সখ্য দেখবো নিজের চোখে! পাশাখালী খালের যে গল্প শুনেছি সেটিও তাহলে ভুল না? সে দফায় অনেক কিছুই দেখেছি। লিখবো পর্যায়ক্রমে। শুধু এটুকু বলতে পারি, সুন্দরবন জুড়ে দস্যুদের সঙ্গে বনরক্ষীদের সম্পর্ক ছিলো। কারও সঙ্গে বন্ধুত্বের, কারও সঙ্গে দূরত্বের সম্পর্ক। কেউ ডাকাতদের বাধ্য হয়ে সমীহ করতেন, কেউ বা পুরোদমে দস্যুদের সহযোগী ছিলেন। সম্পর্ক যাই থাকুক সুন্দরবন তখন শাসন করতো জলদস্যু-বনদস্যুরা। পাশাখালীতে সেই বাস্তবতা দেখেছিলাম নিজের চোখে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top