দস্যু রাজনও আমাকে বিশ্বাস করেনি | রূপান্তরের গল্প ৪৫ | Rupantorer Golpo 45 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ৪৫ : সুন্দরবনের পাশাখালী ফরেস্ট অফিসে ছিলাম সারাদিন। মাস্টার বাহিনী অর্থাৎ দস্যু দলের সদস্যদের চলাফেরা দেখে মনে হচ্ছিলো সেটা যেন তাদের বাড়িঘর। বনকর্মীদের সঙ্গে কথাবার্তা সহজ, স্বাভাবিক। বন টহল ফাঁড়িটিতে কোনো অস্ত্র ছিলো না। তিন/চারজন বনকর্মী আর তাদের রান্নার সহযোগী দুইজন। দুটি কাঁকড়ার জেলেদের নৌকা ছিলো সেখানে। সেই নৌকাগুলোর কাঁকড়া শিকারীদের আটকে রেখেছিলো বনদস্যুরা।
প্রয়োজনীয় কাজ শেষে দস্যুরা আমাদের নিয়ে আগের রাতের পথ ধরে। পাশাখালী খালটি ধরে বড় নিশানখালী, তারপর বেলমারী ভাড়ানী হয়ে চাইলেবগী। সেখান থেকে পশ্চিমে রওনা দেয় বনদস্যুদের ট্রলার বহর। আমরা পূর্ব দিকে, অর্থাৎ পশুর নদী হয়ে উত্তরের পথ ধরি।
আসার আগে মাস্টার, সোহাগদের বলে এসেছিলাম, রাজনের দিকে খেয়াল রাখবেন। পরের মাসে দস্যু দলটি আত্মসমর্পণ করে। সেই দলে রাজন ছিলো না। কেন ছিলো না, দলের মধ্যে পরে কী হয়েছিলো সেই প্রসঙ্গে পরে আসবো। শুধু এটুকু জানিয়ে রাখি, সারেন্ডারের আগে অনেকে ভেগে গেলেও অন্ত্র-গুলি নিয়ে যেতে পারেনি। ৫২টি অস্ত্র নিয়ে মাত্র ১০ জন সদস্য শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করে। শুনেছি দল ভাঙ্গার চেষ্টা করেছিলো রাজন।
এরপর মাঝে মাঝে ফোন করতো সে। বলতো কখনও নোয়াখালী, কখনও চট্টগ্রাম, কখনও নারায়ণগঞ্জে সে। আগের সেই চাকরি করছে, পরিবার নিয়ে নাকী ভালোই আছে। বলতো দস্যুতা ছেড়েছে, সুন্দরবনে আর ফিরবে না কখনও। মামলাগুলো সামাল দিয়েছে, আপাতত কোনো সমস্যা নাই। আমার বিশ্বাস হতো না। কয়েক মাস পর তার প্রমাণও পেলাম।
মধ্য সুন্দরবনে “দাদা ভাই” নামে একটা ছোট দস্যুদল ঘোরাফেরা করছি। খুলনার এক গডফাদার তাদের অস্ত্র-গুলি দিয়ে নামিয়েছে। ২০১৭ সালের শুরুর দিকেই তারা দস্যুতা শুরু করে। আমার সোর্স সে খবর নিশ্চিতও করেছে। দাদা ভাই বাহিনীর সদস্য তখন সে। আমি যে বিষয়টি জেনেছি সেই খবর তার কানেও পৌঁছেছে। তখন থেকে রাজন নিজেই আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে শুরু করে। প্রায় প্রতিদিন ফোন দিতো। অনেক গল্প, সুন্দরবনের দস্যু জগতের নানা গল্প, ওপরের গডফাদারদের কথাও বলতো। শুধু তার গডফাদারের বিষয়ে কিছু বলতো না।
২০১৮ সালের মার্চ-এপ্রিলের দিকে যোগাযোগ বেড়ে গেলো। দলের ভিতরে সমস্যা চলছে। সেই মাস্টার বাহিনীতে যেভাবে সারেন্ডারের আগে বিভাজন তৈরি হয়েছিলো, দাদা ভাই বাহিনীতেও একই রকম ঘটনার পুণরাবৃত্তি ঘটছিলো। রাজন বলছিলো সে খুব বিপদে আছে। যেকোনো সময় তাকে মেরে ফেলতে পারে দস্যুনেতারা। এবারও আমি বিশ্বাস করিনি। তারপর কিছুদিনের জন্য বিচ্ছিন্ন সে।
এপ্রিল মাাস। মধুর মৌসুম চলে পুরোদমে। ফোনে রাজনের সঙ্গে কথা হলো দিন পনেরো পর। হঠাৎ ফোন দিয়ে বেশ খোশ মেজাজে কথা বলছে রাজন। বললাম, লিডারকে মেরে ফেললেন? বিদ্যুতের শক খেলে যেমন হয় রাজনের চেহারা সম্ভবত তেমনই হয়েছিলো। কয়েক সেকেন্ড কোনো কথা নাই। সামলে নেয়া সহজ ছিলো না তার জন্য। কারণ সেই অভ্যন্তরীণ খুনোখুনির কথা আমি জেনে গেছি সেটা ভাবতেও পারেনি রাজন।
রাজন বললো, লিডার খুব বাড়াবাড়ি করছিলো। সদস্যদের টাকা পয়সা ঠিকমতো দিচ্ছে না। ডাকাতির টাকা লিডার আর তার ভাই মিলে সরিয়ে ফেলছে। ভাগ বুঝিয়ে না দিয়ে সারেন্ডার করলে সদস্যরা বঞ্চিত হবে। তাই দলের সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়ে বিচার করা হয়েছে। তার সাথে উপরের কারও নির্দেশও ছিলো শুনেছিলাম। আমি বললাম, দুজনকেই মেরে ফেললেন? রাজন বলে, ছোট ভাইটা টের পেয়ে পালিয়ে গেছে। তবে বড় ভাই অর্থাৎ লিডারকে পানি মাপতে পাঠানো হয়েছে। আমি বললাম, কাজটা খুব খারাপ হলো। আমার সঙ্গে তাদের সেই দস্যুনেতার কথা চলছিলো। দ্রুতই তাদের সারেন্ডার করার কথা। মধ্যস্ততায় আমারই থাকার কথা। তার আগে তাদের আস্তানা থেকে ঘুরেও আসবো বলে কথা আগাচ্ছিলো। কিন্তু সব থমকে গেলো। বাহিনীটির নতুন লিডার রাজন।
সুন্দরবনের ১৭টি দস্যুদল ততোদিনে আত্মসমর্পণ করেছে। অন্য দলগুলোর সঙ্গে কথা চলছে। দাদা ভাই বাহিনীর সঙ্গেও সেভাবেই কথা চলছিলো। লিডার পরিবর্তনের পর রাজনকে একদিন কথায় কথায় জিজ্ঞেস করলাম, সারেন্ডার করবেন না? বললো, মৌমাছি তাড়া করেছে! বলতে বলতে ফোন কেটে দিলো। রাজন বুঝে গেছে যে আমি তার ভিতরের খবরগুলো জেনে যাচ্ছি। তার কিছুদিন পর ২৩ মে ২০১৮ তারিখে ছয়টি ছোট ছোট অপরিচিত দস্যুদল সারেন্ডার করে। সেই বহরে যুক্ত হয় রাজনের নেতৃত্বে দাদা ভাই বাহিনী। খুলনা RAB এর যে কর্মকর্তার সোর্স ছিলো সে, তাঁর মাধ্যমে সারেন্ডার করে তারা। সেই আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়ার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক ছিলো না। রাজনকে আমি কখনোই বিশ্বাস করেনি, সেও করেনি আমাকে!!
(রাজন সম্পর্কে আপনাদের আগ্রহের প্রতি সম্মান জানিয়ে এই পর্বটি লিখেছি। আরেক পর্বে রাজন চ্যাপ্টারের ইতি টানবো। তারপর রূপান্তরের পর্বগুলো লিখতে থাকবো, আপনারা পড়তে থাকবেন। ধন্যবাদ)