ষড়যন্ত্র সফল হয়নি! সরিয়ে দেয়া হয় রাজনকে | রূপান্তরের গল্প ৪৬ | Rupantorer Golpo 46 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ৪৬ : অনেক দিন পরের কথা। সুন্দরবন তখন দস্যুমুক্ত। সেই সফলতা নিয়ে সিনেমা তৈরি হচ্ছে। প্রথম শ্যুটিং স্পট ছিলো সুন্দরবনের কালির চর আর ফোটকে এলাকায়। আড়পাঙ্গাসিয়া নদীটি সেখানে বিশাল। RAB এর নিমন্ত্রণে সেই চলচ্চিত্রের শ্যুটিং দেখতে গিয়েছিলাম সেখানে।
ঘন্টা খানেক কালির চরে ছিলাম। এক কাপ চা খেয়ে রওনা দেই। সন্ধ্যা নামার আগে বড় নদীটি পার হবো।
আড়পাঙ্গাসিয়া নদী ধরে দক্ষিণে যাচ্ছিলাম। বিশাল নদী। পশ্চিমে মাইটে খাল। সেখান থেকে বের হয়ে ছুটছে একটি স্পিডবোট। বড় নদীতে এসে আমাদের দিকে ঘুরলো সেটি। দূর থেকে গামছা উড়িয়ে সিগন্যাল দিলো একজন, থামতে বলা হলো। ট্রলার টবারে দিলেন সরদার। ইঞ্জিন নিউট্রালে রাখাকে ওদিকে টবার বলে।
কাছাকাছি আসতে দেখি কোস্টগার্ড এর স্পিডবোট। পিছনে দাঁড়ানো মানুষটিকে চেনা চেনা লাগছে। মনে হলো আমাকে দেখে হাসছে। আরও কাছে আসতেই দেখি সেই রাজন। একটু দূর থেকে সালাম দিয়ে কাগা দোবেকী অর্থাৎ কোস্টগার্ডের অফিসের দিকে রওনা হলো স্পিডবোট। বুঝলাম, রাজন সোর্স হিসাবে কাজ করছে। আগের বছর রাজনকে দেখেছিলাম খুলনায়। নাম্বার বিহীন মটরসাইকেল নিয়ে সে চষে বেড়াতো সাতক্ষীরা থেকে বরিশাল। তখন আরেকটি আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সোর্স সে। মটরসাইকেলটি সেই বাহিনীরই দেয়া।
রাজন কি আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সোর্স ছিলো? নাকি অন্য কোনো দস্যুদলের। অথবা এমনও হতে পারে সে খুলনাভিত্তিক কোনো গডফাদারের গুপ্তচর? সব প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নাই।
সুন্দরবনের দস্যুদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে অনেক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি। শুধু সাংবাদিকতা করলে হয়তো এতো কিছু জানতে পারতাম না। দস্যুদের আত্মসমর্পণে মধ্যস্ততা করতে গিয়ে কখনও ঝুঁকির মধ্যে পড়েছি, কখনও ট্র্যাপড হয়েছি। আমাকে নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরীর অপচেষ্টা হয়েছে। সেই অপচেষ্টা চলেছে কখনও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সোর্সদের মাধ্যমে, কখনও বা সরাসরি। শহর ভিত্তিক যে সিন্ডিকেট দস্যুতা পরিচালনা করতো তার একটি অংশও সেই অপপ্রচার চালাতো। রাজন হয়তো সেই সিন্ডিকেটের হয়ে কাজ করতো!
আগের পর্বে লিখেছি, মাস্টার বাহিনীর ভিতরে বেশ বড় দুর্ঘটনা ঘটতে যাচ্ছিলো। তার আঁচও পাচ্ছিলাম ঢাকায় বসে। শহর ভিত্তিক সিন্ডিকেট তখন নড়ে চড়ে বসছে। মাস্টার বাহিনীর সারেন্ডারের আবেদনসহ প্রথম সংবাদটি প্রচারের পর থেকেই শুরু হয়েছিলো ভিতরে ভিতরে ষড়যন্ত্র। যার প্রভাব পড়েছিলো দস্যু দলটির ভিতরে।
সুন্দরবনে দস্যুদল হিসাবে মাস্টার বাহিনীর উত্থান হয় বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে। ফলে তাদের অস্ত্র গোলা বারুদের মালিকানা ছিলো তাদেরই। শহরের কোনো গডফাদারের মালিকানায় অস্ত্র ছিলো না। তাই সরাসরি সশস্ত্র সেই দস্যুদের নিয়ন্ত্রণ করা ছিলো খুব কঠিন। নানা ভাবে তাদের সারেন্ডার করতে নিষেধ করা হচ্ছিলো। কিন্তু সেই দলটি কথা শুনছিলো না। তখন সদস্যদের ভয় দেখানো হয়। দলের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা করে তারা। কিন্তু মাস্টারসহ দলটির ছয়জন একাট্টা ছিলো। সেই জায়গায় ভাঙ্গন ধরানোর চেষ্টা সফলও হয়। হয়তো রাজনের মতো একজনকে দস্যুদলে ভিড়ানো হয়েছিলো সেকারণেই।
এরপর দলের প্রধান আর উপ-প্রধানের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়। মাস্টারকে মেরে ফেলার প্লট তৈরি হয়। সেটা ঘটাতেই হবে। কারণ আত্মসমর্পণ শুরু হয়ে গেলে গডফাদারদের বিরাট লোকসান হয়ে যাবে। শহরে বসে টাকার বান্ডিল গনা বন্ধ হবে। অবৈধ অস্ত্র-গুলি বিক্রি বন্ধ হবে। একটি দল সফল ভাবে আত্মসমর্পণ করলে তার প্রভাবে অন্যরাও উঠে আসার চেষ্টা করবে। এতো বড় সিন্ডিকেটের ভিতরে আমি যে কখন ঢুকে পড়েছিলাম টের পাইনি তখন। যখন বুঝতে পেরেছি তখন দ্বিতীয় বারের মতো ছুটে গেছি সুন্দরবনে।
২০১৬ সালের এপ্রিলে পাশাখালীতে মাস্টার বাহিনীর সঙ্গে দ্বিতীয় দফার বৈঠকটি কাজে এসেছিলো। দলের মধ্যে বিভেদ কাটিয়ে ফিরেছিলাম। বলেছিলাম রাজনের মতো সন্দেহজনক সদস্যদের দল থেকে বের করতে। তারা কথা শুনেছে। এক মাস পর অর্থাৎ ২০১৬ সালের ৩১ মে সুন্দরবনের সবচেয়ে বড় দস্যুদলটি আত্মসমর্পণ করে। (ছবিটি সাবেক দস্যুনেতা মাস্টারের)