ট্রলার তখন পাগলা ঘোড়া! | রূপান্তরের গল্প ৫৬ | Rupantorer Golpo 56 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ৫৬ : সাইলেন্সার পাইপ দিয়ে কালো ধোঁয়া বের হচ্ছে। বিকট শব্দ! কট কট কট…… রাত দেড়টা। আমরা যে কোন মহাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম তা ট্রলারের অন্যরা বুঝতেও পারছিলো না। তাদের বুঝতে দেইওনি।
নদীতে নামার আগে এক কাপ দুধ চা খাওয়ার ইচ্ছা ছিলো। সুযোগ হয়নি। তাই ট্রলারে উঠেই চুলা জ্বালাতে বলেছিলাম। ট্রলার ছাড়ার পর পরই তাই রান্নাঘর খোলা হয়। চা বানাতে বসেছিলো মামুন। কিন্তু হুট করেই ট্রলারের গতি বেড়ে গেছে। স্রোত আর ঢেউ কাটানোর সুযোগ ছিলো না। ঝাঁকি খেতে খেতে তাই চুলার উপর রাখা পানি ভরা পাতিলটি উল্টে পড়ে। ভাগ্যিস পানি তখনও বেশি গরম হয়নি। রান্নাঘরের সামনে বসা মামুন বেশ অপ্রস্তুত। বললাম চা পরে খাবো। তুমি চুলা বন্ধ করো, রান্নাঘরটা আটকে দাও, কিছু একটা ধরে বসো। কিছুক্ষণ আমাদের যুদ্ধ করে এগুতে হবে।
ঢাংমারী ফরেস্ট স্টেশনের ট্রলারটি চালু হয়েছে ততোক্ষণে। মুখ ঘুরিয়ে আমাদের দিকে চলতে শুরু করেছে। যেহেতু পালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি তাই পালাতেই হবে। ধরা পড়লে এবার ঝামেলা বাড়বে। কোনো ঝামেলায় জড়ানো যাবে না। আবার সেই রাতেই পৌঁছাতে হবে দস্যুদের আস্তানা পাশাখালীতে। এদিকে একটা ফরেস্ট অফিসের এলাকা পার হলেই চলবে না। সামনে করমজল, জোংড়া, মরাপশুর আর ভদ্রা বন টহল ফাঁড়ী আছে। আমাদের খবর নিশ্চয়ই তাদেরও জানিয়ে দেয়া হবে। আমাদের বিকল্প কিছু করতে হবে, বন বিভাগের চোখ ফাঁকি দিতে হবে।
পশুর নদীর পশ্চিম পাশ থেকে সোজা পূর্ব পাশে যাবো। মানে সোজা না গিয়ে নদীর উল্টো পাশে যাবো। পরিস্থিতি বেগতিক দেখলে কোনো কোনো একটা খালে ঢুকে পড়বো। সেক্ষেত্রে চিলা খালে গিয়ে ঢুকবো। চিলা বেলায়েত সরদারের এলাকা। সেখানকার মানুষ আমাদের লুকানোর ব্যবস্থা করে ফেলবে।
পশুর নদীতে তখন প্রায় অর্ধেক ভাটা। আর ঘন্টা খানেকের মধ্যে জোয়ারের পানি অনেকটা নেমে যাবে। পশুরের পূর্ব পাশ দিয়ে বিশাল বড় চর জেগেছে। শেষ ভাটায় অবধারিত ভাবে ট্রলার আটকে যাবে। আমরা ধরা পড়ে যাবো। সিদ্ধান্ত পাল্টাতে হবে। সরদারকে বললাম, ধরেন আমরা সুন্দরবন থেকে কিছু চুরি করে পালাচ্ছি। বন বিভাগ পিছনে তাড়া করছে। কী করে পালাবো বলেন, ধরা পড়া যাবে না কিছুতেই। সরদার বললেন, তাহলে উঠে বসেন। বাঁকীটা তাঁর ওপর ছেড়ে দিয়ে ডেক এর ওপর উঠে বসলাম।
এবার শুরু বেলায়েত সরদারের খেলা! মাঝ নদী ধরে ছুটলাম। নদী জুড়ে চিংড়ির পোণা ধরার জাল। সাথে বাঁধা নৌকাগুলো দুলছে ঢেউ আর বাতাসের তালে তালে। প্রতিটি নৌকায় জ্বলছে কেরোসিনের বাতি। অন্ধকার রাতে সারি সারি নৌকায় জ্বলা বাতিগুলোকে দেখে মনে হচ্ছিলো এক ঝাঁক তারা জ্বলছে। এতো বাতাসের মধ্যেও কী করে জ্বল জ্বল করে জ্বলছে বাতি? সরদার বললেন, টেমিগুলো এমন ভাবেই বানানো যাতে মোটামুটি বাতাসের মধ্যেও জ্বলতে পারে, সহজে নিভে না। জিজ্ঞেস করলাম, টেমি কী? সার হাসতে হাসতে খুন। বলেন, কেরোসিনের বাতিকে ওদিকে টেমি বলা হয়। ২০১৬ সালের মে মাসের কথা। তখনও সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার ততোটা বাড়েনি।
ঢাংমারীর ফরেস্টাররা কি আমাদের ধরতে পারবে? পাশে থেকে মামুন বললো, তাদের এলাকা পার করে ফেলেছি আমরা। এখন চাঁদাপাই স্টেশনের অন্তর্গত এলাকায়। সেজন্য পশুর নদীর মাঝ পর্যন্ত এসে আমাদের ধরতে না পেরে ফেরত গেছেন তাঁরা। কিন্তু সেক্ষেত্রে আশেপাশের স্টেশন ও ফরেস্ট অফিসে জানিয়ে দেয়ার কথা। আমি ছিলাম সেই দুশ্চিন্তায়।
যাচ্ছি কতো বড় একটা কাজ করতে। সুন্দরবনের সবচেয়ে বড় দস্যু বাহিনী আত্মসমর্পণ করবে। আমি নিজে গিয়ে তাদের নিয়ে আসবো। অস্ত্র-গুলিসহ তাদের তুলে দিবো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে। এতো ভালো একটা কাজ করতে এভাবে চোরের মতো চলতে হবে? আসলে সুন্দরবন এমন একটা জায়গা যেখানে নিয়মের কোনো শেষ নাই, নিয়ম ভেঙ্গে সীমাহীন অপকর্মের কোনো শেষ নাই। এসব ভাবছি আর পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটছে আমাদের ট্রলার।