রূপান্তরের গল্প ৫৭ | Rupantorer Golpo 57

বিপদের উপর নতুন বিপদ! নদী ভর্তি জাল-নৌকা | রূপান্তরের গল্প ৫৭

বিপদের উপর নতুন বিপদ! নদী ভর্তি জাল-নৌকা | রূপান্তরের গল্প ৫৭ | Rupantorer Golpo 57 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ৫৭ : অন্য সবাই ট্রলারের ছই-এর ভিতর। সুকানিতে আমি, বেলায়েত সরদার আর মামুন। বললাম, টেনশন করে তো আমাদের কোনো কাজ আগাবে না। তুমি আবার চা উঠাও, চুলা জ্বালাও। এক কাপ চা না খেলে আমার মাথা ঠান্ডা হবে না। বলতে বলতে দেখি এরই মধ্যে চুলা জ্বলছে। আরেক সহযোগী রান্নাঘরের সামনে বসেছেন। চা হচ্ছে দেখে নড়েচড়ে বসলাম। ট্রলারের ইঞ্জিনের শব্দ এতো বিকট যে চিৎকার করে কথা বলা ছাড়া উপায় ছিলো না।

ট্রলার ছুটছে সর্বোচ্চ গতিতে। সুকানি হাতে বেলায়েত সরদারের তখন মেজাজ খারাপ। আমাদের চা নিয়ে ব্যস্ততা তাকে আরও বিরক্ত করছে। আমাকে কিছু বলতে পারছিলেন না। কিন্তু মামুনকে বিরাট বকা দিয়ে বসলেন। বললেন, এখন চা রাখ। টর্চ নিয়ে সামনে যা। নদীর পানি তখন টগবগ করছে। বাতাস আর স্রোতের সংঘর্ষে পশুর নদী তখন মাতাল ঘোড়া। রোলিং, পিচিং একসাথে মোকাবেলা করে ট্রলার এগিয়ে নেয়া কঠিন। তার ওপর নদীতে শত শত জাল পাতানো, সঙ্গে বাঁধা নৌকা। সংঘর্ষ ঘটে গেলে অনেক বড় দুর্ঘটনা ঘটে যাবে। ওই রোলিং এর মধ্যে আমাদের ট্রলার রীতিমতো লাফঝাঁপ দিচ্ছে। তার মধ্যেই টর্চ হাতে হাঁটা দিলো মামুন। গলুই-এ দাঁড়িয়ে পথ দেখাচ্ছে মামুন। টর্চ এর ইশারা ধরে এবার চলছে ট্রলার। সামনে জয়মনিরঘোল। তার পর শ্যালা নদীতে চাঁদপাই রেঞ্জ অফিস। বন বিভাগের রেঞ্জ সদর দফতর। বন বিভাগের কোনো আলামত নাই। কিন্তু এর পরেই নন্দবালা ফরেস্ট অফিস। সঙ্গে কোস্টগার্ডের ভাসমান পোস্ট। নন্দবালা খালের মুখে সেই পোস্ট এর বাইরের কয়েকটা বাতি জ্বলছে। সম্ভবত সবাই ঘুম। ততোক্ষণে নদীর পশ্চিমের জোংড়া আর মরাপশুর বন টহল ফাঁড়ি পার হয়ে গেছি। ভাগ্য ভালো কেউ ডাকেনি।

একদিকে বন বিভাগ, কোস্টগার্ডসহ সংশ্লিষ্টদের চোখ এড়ানো যেমন প্রধান কাজ ছিলো। তেমনি নদীর জাল-নৌকা দেখে দেখে এগিয়ে যাওয়া। দুই রকমের চ্যালেঞ্জ নিয়ে ট্রলার নিয়ে এগিয়ে যাওয়াটা অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। মধ্যরাত পেরিয়ে যাচ্ছে, ভাটাও শেষের দিকে। ওদিকে ভোরের আগে পৌঁছাতে হবে পাশাখালী।

নন্দবালা থেকে পশুর নদীর পূর্ব দিকের সুন্দরবন শুরু। সেখানে হাতের বামে ঢুকে গেছে সেলা নদী। বড় দুই নদীর মোহনার পাশেই নন্দবালা খাল। ছোট খালটিতে বনদস্যুদের আনাগোনা ছিলো। তাই কোস্টগার্ড এর পোস্টটি বসানো হয়েছিলো ওই খালের মুখে। আমরা অবশ্য বড় নদী, পশুরের মাঝ দিয়ে যাচ্ছি। নন্দবালা পার হয়ে সরদার ট্রলারের আহ্নি ঘোরালেন বাম দিকে। আহ্নি মানে হলো নৌকা বা ট্রলারের সামনের অংশ বা গলুই।

চিৎকার করে জানতে চাইলাম কূলের দিকে যাচ্ছি কেন? সরদার বললেন, পোণা শিকারের জালের পর এবার শুরু হয়েছে ইলিশের জাল। অসংখ্য জাল ফেলানো নদীতে। ভালো করে খেয়াল করলাম, পুরো মাঝ নদী জুড়ে জাল আর জাল। ইলিশের জালকে এদিকে বলে ছান্দি জাল।

রাতের অন্ধকারে ছান্দি জালগুলো দেখা যাচ্ছে না। সাথে তখন নৌকা-ট্রলারও নাই। জালগুলো যে আছে তা বুঝতে পারছি জালের ওপরে পানিতে ভেসে থাকা আলোর মেলা দেখে। বাতাস আর বিপরীত স্রোতে সেই বাতিগুলো ঢেউ-এর সাথে দুলছে। অন্ধকার রাতে বড় নদীতে সেই আলোর মেলা আমাকে বিমোহিত করেছিলো। তখনও সৌর ও ব্যাটারিচালিত বাতির প্রচলন সেভাবে শুরু হয়নি। কেরোসিনের বাতি বা টেমিহুলো জ্বলছে দপদপ করে। একটা জাল অতিক্রম করতে গিয়ে দেখি সেই বাতি রাখা জালের ফ্লোট বা ভাসনার উপর। হারিকেনের চিমনি দিয়ে ঘেরা প্রতিটি বাতি। ওই বাতাসের মধ্যেও কেন নিভে না বাতিগুলো সেটি বুঝলাম। ভাবছিলাম, কতো উদ্ভাবনী শক্তি এই প্রান্তিক মানুষগুলো। এসব ভাবতে ভাবতে ট্রলার চলে এসেছে নদীর পূর্ব তীরে। জঙ্গলের পাশ ঘেঁসে চলছি আমরা। এবার মামুনকে ডেকে চা বানানোর নির্দেশ দিলেন বেলায়েত সরদার।

চা-এ চুমুক দিতে পারিনি তখনও। সামনে থেকে টর্চ এর ইশারা। একদম বরাবর সামনে থেকে। প্রথমে ভেবেছিলাম জেলেদের ট্রলার বা নৌকা থেকে জ্বলেছে টর্চ। মানে তাদের অবস্থান জানাচ্ছে। কিন্তু সরদার বললেন, ও ভাই সামনে নতুন বিপদ। ওটা হাড়বাড়ীয়া ফরেস্ট অফিসের ট্রলার! নতুন বিপদ!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top