বিরাট প্যাঁচ লাগলো লোহা আর জালে! | রূপান্তরের গল্প ৫৯ | Rupantorer Golpo 59 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ৫৯ : ঘট করে একটা আওয়াজ হলো! দ্রুত গতিতে চলা ট্রলারের ইঞ্জিনটা থেমে গেলো। কী হলো আবার? প্রোপেলারে জাল জড়িয়ে গেছে। ইলিশের জাল। ছান্দি জালগুলো চিকন সূতা দিয়ে তৈরি। ট্রলার-জাহাজের প্রোপেলারের মহাশক্রু। সামনে দাঁড়িয়ে মামুন টর্চ দিয়ে পথ দেখাচ্ছিলো। ক্যাপ্টেন বেলায়েদ সরদারও তাঁর ধারণা থেকে পথ চিনে নদীর পারি দেয়ার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু পালানোর সময় এতো কিছু দেখে চলা যায়? মামুনের দেয়া সিগন্যাল বুঝতে বুঝতে জালের উপর দিয়ে চালিয়ে দেই আমরা। ব্যাস! পুরো একটা জাল জড়িয়ে প্রোপেলার জ্যাম করে দিয়েছে! সরদার বললেন.. ওভাই, গামছাটা দেন!
আমার কাঁধে জড়ানো গামছাটা দিলাম। পরনের প্যান্ট বদলে গামছা পড়ে ফেললেন। একটা দা হাতে নিয়ে ঝুপ করে পানিতে ঝাঁপ দিলেন। সাধারণত এমন সময় ট্রলার বা নৌকার মাঝি বা সুকানি শুরুতেই পানিতে নামেন না। কিন্তু আমাদের সরদার এক্ষেত্রে এক সেকেন্ড সময় নষ্ট করেন না। নিজেই নেমে পড়েন। বিষয়টি পরে বুঝেছি। কিন্তু সেই সফরে সরদারের পানিতে লাফিয়ে পড়া নিয়ে একটু শংকায় পড়ে যাই। অতো বড় খরস্রোতা নদীর মাঝখানে গভীর রাতে হুট করে লাফিয়ে পড়া সহজ বিষয় না। পশুর নদীতে বড় বড় কুমির আছে, কামট বা হাঙ্গর আছে! দুর্ঘটনা ঘটতে কতোক্ষণ! এসব ভাবতে বর বিভাগের তাড়ার কথা ভুলতে বসেছিলাম!
এতোক্ষণ পাগলের মতো ছুটছি! পিছন থেকে ধাওয়া করা বন বিভাগের ট্রলারটির দিকে তাকানোর সময় ছিলো না। এবার তো দাঁড়িয়ে পড়েছি আমরা! আরাম করে এবার বন বিভাগ এসে ধরবে আমাদের। মামুনকে বললাম, এবার আর কিছু শুনবো না। চুলা জ্বালাও, চা বানাও বেশি করে। বন বিভাগের ভাইদেরও তো চা খাওয়াতে হবে। উনাদের মাথা গরম আছে নিশ্চয়ই! ওই ট্রলারে পরিচিত কেউ না থাকলে খবরই আছে আমাদের!
কোথায় ওদের ট্রলার? মামুনকে উঠে দেখতে বললাম! সরদার পানির নিচে কাজ করতে গেছে। জেগে আছি আমরা তিনজন। মামুনকে বললাম অন্ধকারে কিছু বুঝতে পারছি না। মামুন ভালে করে দেখলো। তারপর টর্চ জ্বালিয়ে দেখালো। হাড়বাড়ীয়া ফরেস্ট অফিসের ট্রলাটি থেমে আছে আমাদের থেকে আনুমানিক একশ’ মিটার দূরে। মামুন বললো… ভাই, ওদের প্রোপেলারেও জাল জড়াইছে। তার মানে আমাদের পিছু নিতে গিয়ে তাদের ট্রলারটিও ইলিশের জালে ফেঁসে গেছে। কথা বলতে বলতে ভুস করে ভেসে উঠলেন সরদার। উঠেই এক চিৎকার! দাঁড়ায়ে দাঁড়ায় গল্প করলি হবেনে? নাম!
মামুনকেও নামতে হবে আরেকটি ছুরি বা দা নিয়ে। সরদার বললেন.. ভাই, বিরাট প্যাঁচ লাগছে লোহা আর জালে! পপুলার থেকে জাল কাটতে হবে (ওদিকের মানুষ প্রোপ্রেলারকে পপুলার বলে)। জাল আর জালের দড়ি ভয়ঙ্কর ভাবে পেঁচিয়ে গেছে। সরদার ভেবেছিলেন এতোক্ষণে ফরেস্টের ট্রলার চলে এসেছে। বললাম, ওরাও প্যাঁচে পড়ছে ভাই। ওই দেখেন, বিকল হয়ে ওরাও ভাসছে নদীতে। সরদার বললেন, ওদের আর আসা হবে না আমাদের কাছে। বেঁচে গেছি ভাই!
আরেকটা গামছা পড়ে মামুন নামার জন্য প্রস্তুত। কিন্তু ট্রলারে আর ছুরি বা দা নাই। ব্যাগ থেকে একটা মাঝারি আকৃতির ছুরি বের করে দিলাম। ছুরি হাতে লাফিয়ে পড়লো মামুন। মিনিট দশ ডুবোডুবি করে জাল আর দড়ি ছাড়ানো হলো। দু’জনই উঠে আসলো ট্রলারে। বিরাট বড় দুশ্চিন্তা কাটলো। ভাটার স্রোতে ভাসতে ভাসতে আমাদের ট্রলার বেশ খানিকটা দক্ষিনে সরে গেছে। আমাদের জন্য সেটা ভালো খবর। কারণ আমরা দক্ষিণেই যাচ্ছি।
ইঞ্জিন আবার চালু হলো। গিয়ার ফেলে ট্রলার সামনে পিছে করে নিলেন সরদার। এবার পিছনে ফিরে বন বিভাগের বিকল ট্রলারের দিকে টর্চ দিয়ে ইশারা করলাম আমরা। সরদার চিৎকার করে বললেন, বাই বাই…..!!
চোরের মতো অবস্থা আমাদের। ফরেস্টের তাড়ার ওপর আছি সেই মধ্য রাত থেকে। ট্রলার চললো পশ্চিমে। হাড়বাড়ীয়ার উল্টো দিকের জঙ্গল ঘেঁষে আগাবো আমরা। ওদিকে ভেজা শরীর নিয়ে রান্নাঘরের সামনে বসে পড়েছে মামুন। চা-এর পানি তখন ফুটছে টগবগ করে।
(ছবিটি বেলায়েত সরদারের ট্রলারের। পরের কোনো সফরে তোলা ছবি। রূপক হিসাবে ছবিটি দিলাম। সেই রাতে ঘটনা ঘটেছিলো সুন্দরবনের এই জায়গাটিতে)