নতুন বিপদ কালবৈশাখী | রূপান্তরের গল্প ৬০ | Rupantorer Golpo 60 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ৬০ : এক কাপ দুধ চা খেতে না পারলে মনে হয় বাঁচবো না! বেলায়েত সরদারকে বললাম সামনে যা হয় হোক। চা খেতে হবে। মামুন হাঁক দিয়ে বললো, আর কোনো কথা শুনবো না ভাই। চা তৈরি হচ্ছে। বাতাসে একটু সমস্যা হচ্ছে। তবে চা এবার হবেই হবে। বেলায়েত সরদার এবার একটা গালি দিয়ে মামুনকে বললেন, আবার জালে জড়াবে পপুলার। তুই টর্চ নিয়ে সামনে যা! পশুর নদীর ওই জায়গায় পানির গভীরতা নাকী ৩০০ হাতেরও বেশি!
রাত তখন সাড়ে তিনটা। কৃষ্ণপক্ষ চলে। চাঁদের আলোর খবর নাই। অন্যদিকে জৈষ্ঠ মাসের আকাশে হঠাৎ করেই মেঘ জমেছে। কালো মেঘ। আর বাতাস ছেড়েছে পূর্ব দিক থেকে। পূবের বাতাস মানে অশনি সংকেত। বড় ঝড়-বৃষ্টি শুরু হচ্ছে! চুলা বন্ধ হলো আবার।
টর্চ নিয়ে মামুন সামনের দিকে চলে গেলো। গলুইয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের পথ দেখালো সে। সরদারকে বললাম, আমার চা-য়ের সাথে এতো শত্রুতা কীসের বলেন তো? বললেন, জঙ্গলে এসর দুধ চা খেতে গেলে একটু কষ্ট করতেই হবে। জঙ্গলে চলে লাল চা। বানাতে সময় লাগে না। কিন্তু দুধ চা বানানো ঝামেলা। সময়ও লাগে বেশি। লিকার কড়া করতে হয়, তারপর দুধ মিলাতে হয়। এরপর আবার জ্বাল দিতে হয়। ছাঁকনি দিয়ে ছেঁকে মগে ঢালতে হয়। নদী-সাগরে চলতে চলতে এতো কিছু করা যায়? তার ওপর সেই রাত একটা থেকে তাড়ার উপর। চোরের মতো দৌড়াচ্ছি আমরা। কী করে দুধ চা বানাই? বললাম, চা ছাড়া আমি আর এক পা নড়বো না। যা হয় হোক! সামনের দুই রাত, দুই দিন আমাকে জাগতে হবে কিন্তু!
এবার মন গললো ক্যাপ্টেনের। বললেন, পশুরের পশ্চিমে যেতে হবে। ছান্দি জালগুলো এড়িয়ে যেতে হবে। জড়ায়ে গেলে তো শুধু আমাদের ক্ষতি না, ওই জেলে ভাই-এরও ক্ষতি। জাল-এসে ছেঁড়া দেখলে তো গালি দিবে। বললাম তাহলে চলেন পার হই আগে। আধা ঘন্টার মতো চললো ট্রলার। পশ্চিম তীরে জঙ্গলের কাছে দ্রুত যেতে হবে। এর মধ্যে কালবৈশাখী ঝড় এসে গেলে নতুন বিপদে পড়তে হবে। দক্ষিণ-পশ্চিমে চলতে চলতে প্রায় ভদ্রা নদীর কাছে চলে আসলাম আমরা। ভদ্রার ঠোঁটায় আসতে আসতে ঝড় উঠলো, কালবৈশাখী ঝড়!
ঠোঁটা শব্দটির সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেয়া দরকার। বন উপকূলে এই শব্দের ব্যবহার করা হয় পথ চিনানোর জন্য। কোনো একটি নদী বা খালের কোনো জায়গায় একটু বাড়ানো ডাঙ্গা থাকে। সুন্দরবনের ক্ষেত্রে সেই জায়গাটি থাকে বন। খাল বা নদীর শুরু বা শেষে বাড়ানো এই ডাঙ্গাকে ঠোঁটা বলে। আমরা ভদ্রার ঠোঁটা পেরিয়ে পশ্চিমে ঢুকে পড়লাম। একটু এগিয়ে একটা জোলা খালে ঢুকিয়ে দিলাম ট্রলার। ভাটায় পানি কমে গেলেও ঢুকতে সমস্যা হয়নি। মামুন একটা কেওড়া গাছের ডালে বেঁধে ফেললো ট্রলার।
ঝড় বাড়ছে, সঙ্গে বেড়েছে বৃষ্টি। সুন্দরবন ও উপকূলের ঝড় বৃষ্টি সম্পর্কে যাদের ধারণা আছে তাঁরা বুঝবেন সেই ঝড়ের তান্ডব কেমন হতে পারে। খোলা নদীতে থাকলে বড় বিপদে পড়তাম। তবে সুন্দরবনে চলাফেরা ও বসবাসের সময় ছোট খালে ঢুকে পড়তে পারলে বুঝবেন বিপদ কেটে গেছে। ছোট সেই খালটির নাম সম্ভবত ছোট আমতলা বা আমবাড়িয়া। এবার সরদারের ব্যস্ততা কমলো। রান্নাঘরের দরজা খুলে আবারও জ্বালানো হলো চুলা। গ্যাসের চুলা বলে ওই বৃষ্টির মধ্যেও চা বানাতে কষ্ট হলো না। মামুনকে বললাম, ট্রলারে বড় মগ আছে? এবার মগ ভর্তি করে চা না খেলে চলবে না।
মনে হচ্ছিলো আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি পড়ছে। সুন্দরবনের বৃষ্টি। উল্টো পাশে ভদ্রা বন টহল ফাঁড়ী। কিন্তু নদীর মুখ বেশ প্রশস্ত বলে আমাদের দেখতে পায়নি তারা। পেলেও এই ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে তারা আসবে না। একটু স্বস্তিতে ছিলাম। কিন্তু দুশ্চিন্তা শেষ হয়নি। ঝড়-বৃষ্টি লম্বা সময় ধরে চললে এখানে থাকতে থাকতেই ফুটবে দিনের আলো। বিপদের সাথে নতুন বিপদ যোগ হবে তখন। এছাড়া ভাটা শেষ হয়ে গেলে ছোট্ট ওই খালে আটকে যাবে ট্রলার! ওদিকে রাতে রাতেই পৌঁঁছাতে হবে পাশাখালী। জলদস্যু মাস্টার বাহিনী অপেক্ষা করছে।