রূপান্তরের গল্প ৬১ | Rupantorer Golpo 61

ভদ্রা ছিলো বাঘ-কুমিরের আস্তানা | রূপান্তরের গল্প ৬১

ভদ্রা ছিলো বাঘ-কুমিরের আস্তানা | রূপান্তরের গল্প ৬১ | Rupantorer Golpo 61 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ৬১ : মুষলধারে ঝড়-বৃষ্টি গেলো। কালবৈশাখী ঝড় বলে কথা! হঠাৎ করে আসলো, হঠাৎ করে কমে গেলো। আধা ঘন্টার মধ্যে ভারী বৃষ্টি থেমে শুরু হলো টিপ টিপ বৃষ্টি।

আকাশ এখন পরিস্কার। মামুনকে বললাম দ্রুত দড়ি খোলো। শেষ ভাটায় কিন্তু বের হতে পারবো না। আমাদের সুকানি বেলায়েত সরদার একটু বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। চোখে তন্দ্রা। গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসলেন। বললেন, খালের মুখে চর পড়ে গেছে। এখনই বের না হলে হবে না।

ছোট্ট খালটিতে ভাসলো ট্রলার। কিন্তু এতো ছোট খালে নৌযানটি ঘুরিয়ে ফেলা সম্ভব না। সামনে কোনো দোয়া আছে কী না জানি না (দোয়া মানে হলো একাধিক খালের মুখ)। সরসর করে পানি নামছে। আটকে পড়ার ঝুঁকি নেয়া যাবে না। পানি নামার গতি বেড়ে যাচ্ছে। মানে ভাটা শেষের দিকে। বড় নদীতে ভাটা শেষ হওয়ার আগেই ছোট খালগুলোর পানি নেমে যায়। আর ভদ্রা এলাকার সুন্দরবন বেশ উঁচু। খালের পানি নেমে যায় ভাটা শেষ হওয়ার ঘন্টা খানেক আগে।

বেলায়েত সরদারের এবার মাথা গরম! চিৎকার করে ট্রলারের সবাইকে ডেকে তুলতে বললেন। সাথে চললো আঞ্চলিক ভাষায় গালি! ঠেলে ঠেলে ট্রলার বের করতে হবে। খালের মুখটি পড়েছে ভদ্রা নদীতে। ভদ্রা নদী পড়েছে পশুর নদীতে। দ্রুত পশুরে উঠে দক্ষিণের পথ ধরতে হবে।

ছই-এর ভিতর আর ইঞ্জিন রুম মিলিয়ে বিছানা পাতা। আর বৃষ্টির মধ্যে ঘুম গভীর হয়েছে। এতোকিছু চলছে রাতভর, তারা কিছুই জানে না। আমার সহকর্মী বায়েজিদ ইসলাম পলিনের ঘুম ছিলো সবচেয়ে গভীর। ডেকে তোলা গেলো না। সাথে আহসান রাজীব, ইয়ামীন ভাই। তিনজনই ঘুমাচ্ছেন ছইয়ের ভিতরে। আর ইঞ্জিন রুমে গাদাগাদি করে শুয়ে আছেন জলদস্যু সুমন, সোলাইমান আর ট্রলারের আরও দুই সহযোগী। ডেকে তোলা হলো তাদের। ঘুম থেকে উঠে চোখ ডলতে ডলতে খালে নামলো মামুন আর চিলা বাজার থেকে আসা ট্রলারের দুই সহযোগী।

সুন্দরবনের খাল হোক বা বড় নদী, চরে আটকালে সাথে সাথে নামতে হয়। ভাটার সময় হলে এক মিনিটও দেরি করার উপায় থাকে না। প্রয়োজন হলে আমিও নেমে পড়ি।

কোমড় পানিতে নেমে ট্রলার ঠেলতে শুরু করলো তারা। বড় নদীতে বের করতে বেশি বেগ পেতে হলো না। বুকের ভিতর ধকধক করছে। ভাটার সময় ট্রলার আটকে গেলে বিপদ! তখন ট্রলার ছাড়াতে হলে জোয়ার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। মানে অন্তত চার ঘন্টা এখানেই আটকে থাকতে হবে।

একটু একটু করে পিছন ফিরে সরছে ট্রলার। মাঝে মাঝে কেওড়া আর বাইন গাছের ডালে আটকে যাচ্ছি। গাছের ঘষা লেগে কেবিনের একটা কোণা ভেঙ্গে গেলো। ডেক এর একদিকে সরদার আর অন্যদিকে আমি দাঁড়ালাম। গাছগুলো ঠেলে সরাচ্ছি। ওদিকে নিচ থেকে ঠেলছে তিনজন। বনের ভিতরে ছোট খাল থেকে নৌকা-ট্রলার এভাবেই বের করতে হয়।

পনেরো মিনিটের মতো সময় লাগলো খালের মুখ পর্যন্ত আসতে। সেখানে পানি একদম কম। কিন্তু কাঁদা আছে। এক রকম কাঁদার উপর দিয়ে এগিয়ে চলছে ট্রলার। দম বন্ধ করা পরিস্থিতি। নিচের তিনজন মিলে না পারলে আমরাও নামবো। ততোক্ষণে লুঙ্গি পড়ে প্রস্তুত আমি।

ভদ্রা নদী সংলগ্ন বনে বাঘের চাপ খুব। আবার বড় বড় কুমিরের আস্তানাও সেখানে। ভদ্রা দিয়ে চলাচলের সময় কুমির দেখিনি এমন হয়নি কখনও। আর এর দুই পাশের বনের ভিতরে স্পষ্ট বাঘের পায়ের ছাপ দেখেছি অনেক বার। এছাড়া খালের পানি-কাঁদায় বিষাক্ত কাঁটাওয়ালা মাছ-পোকার অভাব নাই। সাপও আছে। আমি সাপ খুব ভয় পাই। কিন্তু প্রয়োজনে সবকিছুই করতে প্রস্তুত।

শেষ পর্যন্ত নামতে হলো না। ভাসলাম ভদ্রা নদীতে। শুরুতে উল্টোপাশে ফরেস্ট অফিসের দিকে নজর দিলাম। আমাদের থেকে সেই অফিসের দূরত্ব হবে আধা কিলোমিটারের মতো।

না! কেউ নাই। বনকর্মীরা ঘুমাচ্ছেন। জেটিতেও কোনো ডিউটি নাই। শুধু বন বিভিগের ট্রলারটি ভাসছে জেটিতে। ঝড়-বৃষ্টির পর নতুন নোঙ্গর করছেন মাঝি। বন টহল ফাঁড়ির মাঝিরা সাধারণত স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে থেকে নেয়া হয়। আমাদের দেখে একটু বুঝার চেষ্টা করলেন তিনি। নাম তাঁর সম্ভবত পিটার, বাড়ি চিলা বাজারে। কয়েক সেকেন্ড পর নজর সরিয়ে নিজের কাজে মন দিলেন তিনি। জেটির সাথে দুটি সৌর বিদ্যুতের বাতি। তার নিচে ট্রলারটি দেখা যাচ্ছিলো স্পষ্ট।

ইঞ্জিন চালু হলো। ভদ্রার ঠোঁটা পেরিয়ে বড় নদীতে পড়বো। আর তার আগে একটু খেয়াল করতে হবে নদীতে বন বিভাগ বা কোস্টগার্ডের অবস্থান আছে কী না! পুরো রাত ধরে যেভাবে বনকর্মীদের সঙ্গে চোর-পুলিশ খেলেছি তাতে পুরো বনের খবর হয়ে যাওয়ার কথা। সেটাও হতো যদি বনকর্মীদের মধ্যে যোগাযোগ থাকতো। সুন্দরবনের ওই অঞ্চলে মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক নাই। সচল ছিলো না ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের ওয়্যারলেস সিস্টেম।

বড় নদীতে ওঠার আগে দুই পাশে দেখে নিলাম। গলুই-এ দাঁড়ানো আমি। ভদ্রার মুখ পার হতে বেশ বেগ পেতে হয়। স্রোত আর বাতাসে ধাক্কা খেতে খেতে দক্ষিণের পথ ধরলাম। ভদ্রা পেরিয়ে জঙ্গল ঘেঁষে চললাম। তখন তিনজন ছাড়া অন্যরা উঠে গেছে। অবশ্য দস্যু দুইজনকে উঠাতেই হতো। কারণ সামনে পথ দেখানোর দায়িত্ব তাদের।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top