রূপান্তরের গল্প ৬২ | Rupantorer Golpo 62

গভীর ঘুমে সরদার, সুকানিতে আমি! | রূপান্তরের গল্প ৬২

গভীর ঘুমে সরদার, সুকানিতে আমি! | রূপান্তরের গল্প ৬২ | Rupantorer Golpo 62 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ৬২ : পূর্ব আকাশে একটু আলোর ছটা দেখা যাচ্ছে। তখন সম্ভবত ভোর চারটার মতো বাজে। আমরা এগুচ্ছিলাম দক্ষিণে, পশুর নদীর ডান পাশের জঙ্গল ঘেঁসে। একটা সুন্দর খাল পড়লো পশ্চিমে। নাম- বড় কানছিঁড়া। খালটি ধরে ঢুকে পড়লে সোজা ভদ্রা নদীতে বের হওয়া যায়। ডিঙ্গি নৌকা করে এই খাল ধরে যাওয়া যাবে আদাচাকির ভারানী হয়ে শিবসা নদী। আবার চাইলেবগী হয়ে বেলমারী, নিশানখালী, পাশাখালী যাওয়া যায় ছোট ছোট খাল আর ভাড়ানি দিয়ে। বড় কানছিঁড়া খালের সাথে আরেকটা ছোট্ট খাল আছে। সেই খালের নাম ছোট কানছিঁড়া।

ডেক এর ওপর বসা আমরা। ট্রলারের সব আলো নিভানো। শুধু লাল-সবুজ সিগন্যাল বাতি জ্বলছে ডেক এর দুই পাশে উপরের দিকে। বাম পাশে সবুজ বাতি, ডান পাশে লাল। দস্যুদের চেনানোর জন্য সেভাবেই বলা ছিলো। রাতের বেলা দূর থেকে আলো দেখে তারা আমাদের ট্রলারটি চিনবে বা বুঝবে। যাতে ভুল বোঝাবুঝি না হয় সেজন্য আমি নির্দিষ্ট জায়গায় যাওয়ার পর টর্চ হাতে গলুই-এ গিয়ে দাঁড়াতাম। যতোক্ষণ দস্যুদের মুখোমুখি না হই ততোক্ষণ এক ভাবে দাঁড়িয়ে থাকি। যেন আলোর নিশানা দেখার পাশাপাশি আমাকেও তারা দেখতে পায়।

বড় কানছিঁড়া খালটির এমন অদ্ভুত নাম হলো কী করে? কারও জানা নাই। ডেক এ বসে এসব গল্পগুজব চলছিলো। সঙ্গে থাকা দুইজন দস্যু সুমন আর সোলাইমান অবশ্য খুব ভালো সুন্দরবন চিনে না। কারণ বনের সাথে তাদের দীর্ঘ সম্পর্ক ছিলো না। এলাকায় থাকতে না পেরে ফেরারি হয়ে তারা দস্যু হয়েছিলো। বললাম, যেখানে যাচ্ছি সেই জায়গা চিনবেন তো? সোলাইমান বললো, বড় নদী ধরে চলতে থাকি। ওরা ডেকে নিবে।

সামনে একটা আলো দেখা যাচ্ছে। বড় নদীতে কোনো ট্রলার ভেসে নাই তো? বেলায়েত সরদার বললেন, ওটা বয়া, চাইলেবগীর বয়া। পশুর দিয়ে জাহাজ চলাচলের পথ নির্দেশনার জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষের বসানো বয়া। তার মানে ওখানেই চাইলেবগী খাল? সরদার বললেন, ও ভাই আপনি ভুলে গেলেন? গতবার তো ওই খাল থেকেই আমাদের নিয়ে গেলো মাস্টার বাহিনী। বললাম, একবার আসছি, তাও রাতের বেলা!

সারা রাতের মানষিক চাপ থেকে বুঝতে পারিনি যে ক্ষুধার্ত আমরা। বাজারের বস্তা খোলা হলো। বিস্কিট বের করতে করতে দেখি আরেক দফা চা হচ্ছে। সবার জন্য রং চা, আর আমার জন্য দুধ চা বানিয়ে সামনে রাখলো মামুন। মামুনের মুখের হাসিটা অসম্ভব সুন্দর। ভিতর থেকে আসা হাসি। অথচ পুরো রাত তার উপর দিয়ে সবচেয়ে বেশি ঝড় ঝাপটা গেছে। লিকলিকে শরীরের তরুণ। চিলা বাজারে বাড়ি। সময় পেলেই আমার সহযাত্রী হয়ে যায়। এতো ঝুঁকি, এতো ঝক্কি, তারপরও উঠে পড়ে ট্রলারে। এতো পরিশ্রম, এতো বকাঝকা শুনেও হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকা, কাজ করে যাওয়া সবার পক্ষে সম্ভব না।

চা-বিস্কিট খেতে খেতে চাইলেবগী পার হলাম। এই অঞ্চলে বন বিভাগ বা কোস্টগার্ডের কোনো তৎপরতা নাই। অন্যদিকে পোণা ধরার জাল বা ইলিশ ধরার ছান্দি জালের সারিও নাই। বেশ নির্বিঘ্নে চলছিলাম আমরা। সারা রাতের ঘটনাবহুল সফরটি ছিলো মনে রাখার মতো। অনেকগুলো বিপদ-আপদ ঘাড়ে এসে চেপে বসেছিলো। ভোর হতে হতে সব প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে আমরা প্রায় পৌঁঁছে গেছি গন্তব্যে।

এতোক্ষণে সুমন আর সোলাইমানের মুখে হাসি ফুটেছে। আসলে সে সময় এক একজন চিহ্নিত বনদস্যুকে তাড়িয়ে বেড়াতো মৃত্যুঝুঁকি। আবার তাদের ভয়ে সন্ত্রস্ত সুন্দরবনের জেলেরা থাকতো আতঙ্কে। তার মানে নির্যাতনকারী ও নির্যাতিত, দুই পক্ষই আতঙ্কিত থাকতো। সেই আতঙ্ক বলেশ্বর থেকে রায়মঙ্গল নদী পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিলো। দস্যুদের ভয়ে ঘুমাতে পারতো না পুরো বঙ্গোপসাগের জেলেরা, তাদের পরিবারের সদস্যরা, ট্রলার মালিকরা, মাছ ব্যবসায়ীরা। আর এই ভয়ের পরিবেশ কাজে লাগাতো এক শ্রেণির মাছ ব্যবসায়ী। আতঙ্কিত জেলেদের ভয়কে পুঁজি করে নিষ্পেষণের চুড়ান্ত উদাহরণ তৈরি করেছিলো তারা। সুন্দরবনের ভিতরের সেই পরিবেশ সম্পর্কে আমরা কিছুই জানতাম না। এবিষয়ে সাংবাদিকরাও কাজ করেননি। তাই রহস্যে ঘেরা সুন্দরবনের জেলে-বাওয়ালী-মাওয়ালীদের জীবনটাও রহস্যে ঘেরা ছিলো। বনদস্যুদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে সেই বনজীবীদের সম্পর্কে জেনেছি, জানানোর চেষ্টা করছি। মূল গল্পে ফিরি।

আরেকটু সামনে গেলেই পাশাখালী ফরেস্ট অফিস। সোলাইমান ও সুমন জানালো ওখানেই আছে মাস্টার বাহিনী। বেলায়েত সরদার বিশ্রামে গেছেন। সামনে খোলা জয়গায় কাঁথা মুড়ি দিয়ে গভীর ঘুম। দেখে মায়া লাগছিলো। মামুনকে বললাম, তুমিও বিশ্রাম নাও। ঝকঝকে সাদা দাঁতগুলো বের করে বিরাট হাসি দিয়ে মামুন বললো, আপনাকে রেখে ঘুমাতে যাবো না। বাতাস ছেড়েছে আবার। আকাশে নতুন করে মেঘ জমছে। রাতের বৃষ্টিতে শীত শীত ভাব নেমে গেছে। সুকানীতে এবার আমি নিজেই। এক হাতে হালটা ধরে দাঁড়িয়ে আমি

সুন্দরবনের প্রথম দস্যু বাহিনী আত্মসমর্পণ করবে। উত্তেজনায় সময় আর কাটছিলো না।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top